(জম্মুর দুর্গানগরের বাড়িতে স্ত্রী, সাত বছরের মেয়ে ও মা-বাবাকে রেখে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসংস্থান প্রকল্পে কাশ্মীর উপত্যকার বডগামে সরকারি কর্মী হিসাবে কাজ করতে গিয়েছিলেন কাশ্মীরী পণ্ডিত রাহুল ভাট। গত ১২ মে জঙ্গিরা তাঁর অফিসে ঢুকে রাহুল ভাটকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড পণ্ডিতদের নিরাপত্তাহীনতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই প্রকল্পে কাজ করা আর এক কাশ্মীরী পণ্ডিত অজয় কল জানিয়েছেন, “উপত্যকায় আমরা নিরাপদ বোধ করছিনা। জঙ্গিরা বারবারই আমাদের হিংসার লক্ষ্যবস্তু করছে। কেন্দ্রের মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আমাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।” উপত্যকাকে নিরাপত্তা বাহিনীতে ভরিয়ে দিলেও পরিস্থিতি যে একেবারেই স্বাভাবিক নয়, এই হত্যাকাণ্ড তার জ্বলন্ত প্রমাণ। পণ্ডিতদের মধ্যে এই ধারণা ক্রমেই আরও বেশি করে দানা বাঁধছে যে, মোদী সরকার ও বিজেপি তাঁদের বলির পাঁঠা করছে, নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতে ও ভোট কুড়োতে কাজে লাগাচ্ছে তাঁদের অসহায় পরিস্থিতিকে। তাঁদের উপলব্ধিতে এই ধারণা জোরালো হচ্ছে যে, ৩৭০ ধারা বাতিল ও ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমা কাশ্মীরের পরিস্থিতির সঙ্গে পণ্ডিতদের অবস্থাকেও আরও বিপন্ন করে তুলেছে। পণ্ডিতরা পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, পুলিশের লাঠি ও কাঁদানে গ্যাসের মুখেও পড়ছেন। রাহুল ভাটের হত্যার পরদিন তাঁর শেষকৃত্যে হাজির হওয়ার সময় জম্মু ও কাশ্মীরের বিজেপি প্রধান রবীন্দ্র রায়না, প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী কবীন্দ্র গুপ্ত ও অন্যান্য বিজেপি নেতাদের ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট পণ্ডিতদের প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়। তবে, শুধু রাস্তাতেই নয়, সামাজিক মাধ্যমেও ক্ষোভ ধ্বনিত হচ্ছে। “মোদী হায় হায়, অমিত শাহ হায় হায়, বিজেপি হায় হায়” শ্লোগান নিয়ে ভিডিও সমাজ মাধ্যমে ঘুরছে। পণ্ডিতরা জানাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসংস্থান প্রকল্পে আবেদন করার সময় তাঁদের এই মর্মে একটা বণ্ডে স্বাক্ষর করতে হচ্ছিল যে, তাঁরা কাশ্মীরেই থাকবেন। এখন তাঁরা বলছেন, ঐ বণ্ড বাতিল করতে হবে, কাশ্মীর থেকে বদলি করে জম্মুতে তাঁদের পোস্টিং দিতে হবে। সমবেত প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত রেখে ৩৫০ জনেরও বেশি কাশ্মীরী পণ্ডিত প্রশাসনের কাছে গণইস্তফাপত্র পাঠিয়েছেন। রাহুল ভাটের হত্যা মোদী সরকার এবং জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনের এক কলঙ্ক রূপেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। রাহুল ভাটের হত্যাকাণ্ডে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতির ভাষান্তর পড়ুন নিচে। – সম্পাদকমন্ডলী)
বডগামে জঙ্গিদের হাতে কাশ্মীরী পণ্ডিত সম্প্রদায়ের সরকারি কর্মচারী রাহুল ভাটের হত্যা সন্ত্রাসবাদের এক ঘৃণ্য কাপুরুষোচিত কাজ যেটাকে কঠোরতম ভাষায় ধিক্কার জানাতে হবে। বিভেদকে আরও উসকিয়ে তোলার জন্য এটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত এক হত্যাকাণ্ড।
যে মোদী সরকার ২০১৯ সাল থেকে অগণতান্ত্রিক পথে জম্মু ও কাশ্মীরে শাসন চালিয়ে যাচ্ছে, কাশ্মীরী পণ্ডিতদের বিক্ষোভ মিছিলে তাদের কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ ও লাঠি চালানোর ঘটনাকেও ধিক্কার জানাতে হবে। কাশ্মীরের মুসলিম জনগণই হোক আর কাশ্মীরী পণ্ডিতরাই হোন, তাদের প্রতিবাদ জানানো ও মত প্রকাশের অধিকারকে মোদী সরকার যে দমন করে সেটা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। ১৩ মে’র শোক ও প্রতিবাদ মিছিলে বহু সংখ্যক কাশ্মীরি পণ্ডিত ও কাশ্মীরের মুসলমান জনগণ অংশ নেন। বিরোধী পক্ষের নেতারা বডগামে গিয়ে সংহতি জানাতে গেলে তাদের আটকানো হয়।
বিজেপি ও আরএসএস কাশ্মীরী পণ্ডিতদের যন্ত্রণাকে হাতিয়ে নিয়ে অবশিষ্ট ভারতে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়ায় এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর পক্ষে যুক্তি দেয়। কিন্তু, প্রতিটি স্তরে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা জম্মু ও কাশ্মীরে কাশ্মীরী পণ্ডিত বা অন্যান্য নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে চরম ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মুখপাত্ররা বিরোধী দলগুলোর দিকে আঙুল তুললেও নিজেদের দায়বদ্ধতা ও ব্যর্থতার স্বীকারে অপারগ।
বিজেপি সরকার শান্তি ও সুরক্ষা জোগাতে ব্যর্থ হওয়ায় বহু সংখ্যক কাশ্মীরী পণ্ডিত সরকারি চাকরি থেকে গণইস্তফা দিয়েছেন। নোট বাতিল এবং ৩৭০ ধারার বিলোপ সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করবে বলে যে দাবি মোদী করেছিলেন তা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়েছে — আর এর বিপরীতে আমরা দেখছি, দীর্ঘকাল নিষ্ক্রিয় থাকার পর জঙ্গি সক্রিয়তা এক নতুন জীবন পেয়েছে।
ঘটনা হল, কাশ্মীরের অনেক মুসলিম জনগণও জঙ্গি হিংসার বলি হয়েছেন। কাশ্মীরের মুসলিম জনগণ এবং কাশ্মীরী পণ্ডিতরা উভয়েই জঙ্গি হিংসার শিকার হয়েছেন এবং রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে হেফাজতে তাঁদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে ও তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। এদের একের ন্যায়বিচারকে অপরের ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে খাড়া করা যাবেনা। জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ এবং দেশের অন্যান্য অংশের গণতন্ত্র-প্রেমী জনগণকে শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। সাম্প্রদায়িকীকরণকে বাড়িয়ে তোলা এবং ঘৃণাকে উসকিয়ে তোলার গোটা অপচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে পরাস্ত করতে হবে।