অদ্ভুত শোনাচ্ছে? পরিবার ও সমাজ অহরহ বলে থাকে ‘মা হওয়া কী মুখের কথা!’ মাকে সন্তানের জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু সাজা?
সম্প্রতি প্রকাশিত ১৮৯টি দেশের থেকে সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণ জানাচ্ছে অতিমারীর মধ্যে গোটা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মহিলা ‘মাতৃত্বের সাজার’ মুখোমুখি হয়েছেন! অর্থাৎ কাজ হারিয়েছেন! অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন খুইয়েছেন — স্রেফ শিশু সন্তানের ‘মা’ হওয়ার জন্য! কখনও কর্তৃপক্ষই তাকে কাজের অনুপযোগী মনে করে ছাঁটাই করেছে, কখনও পারিবারিক কাজের চাপে ‘মা’ নিজেই কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের এই পারিবারিক দায়বদ্ধতার চাপ বরাবরই অনেকটা বেশি ছিল, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। কিন্তু অতিমারীর করাল গ্রাসে সেই বাধ্যবাধকতা আরও অনেক প্রকট হয়ে উঠল।
‘ইউএন উইমেন’ এবং ‘আইএলও’ এক যৌথ সমীক্ষা চালায় ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী বাবা-মাকে নিয়ে যাদের অনূর্ধ ৬ বছরের অন্তত একটি সন্তান আছে এবং যাদের শ্রমের বাজারে সক্রিয় অংশগ্রহণ আছে। একা মা বা একা বাবারাও আছেন এই সমীক্ষায় সমান গুরুত্ব নিয়ে।
অতিমারীর আগেও ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী অনূর্ধ ৬ বছরের এক সন্তানের মায়েদের শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণ ছিল ৫৫ শতাংশ যা মহিলাদের সামগ্রিক অংশগ্রহণের (৬২ শতাংশ) থেকে কম এবং বাবাদের অংশগ্রহণ (৯৭.১ শতাংশ) থেকে অনেকটাই কম।
উপরের তথ্যগুলি, শ্রমের বাজারে নারী ও পুরুষের অসম অংশগ্রহণের জন্য শিশু পরিচর্যা ও গার্হস্থ্য দায় দায়িত্বের অসম বিভাজন দায়ী তা নিশ্চিত করে। এই অসম অংশগ্রহণ অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন সামাজিক সুরক্ষা ও সম বেতন, মজুরি বৃদ্ধি এবং ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্বকারী অবস্থানে যাওয়ার আশু ও দীর্ঘ মেয়াদি সুযোগ, হিংসা ও হেনস্থার সহজ শিকার হওয়া — এসব প্রশ্নে প্রভাব ফেলে, বলাই বাহুল্য।
২০২০তে বাইরের এবং ঘরের কাজ দক্ষ হাতে সামলানোর চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্কুল বন্ধ থাকা এবং মহিলা-প্রধান কাজের ক্ষেত্রগুলিতে ব্যাপক কর্মচ্যুতি। ফলে তখন শ্রম বাজারে আরও কম মহিলা অংশ নিতে পেরেছেন। ২০২০তে ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী যেসব নারীর জীবনসঙ্গী ও শিশুসন্তান আছে তাদের মধ্যে ১,১৩০ লক্ষ শ্রমবাজার থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন। সংখ্যাটা সত্যিই বিস্মিত করে, কারণ ঐ সময়ে তাদের পুরুষ সঙ্গীদের কাজ হারানোর সংখ্যা ছিল ১৩০ লক্ষ (কোভিড১৯ পূর্ব সময়ে যা ছিল ৮০ লক্ষ)।
কোভিড১৯ পূর্ববর্তী সময়ে সঙ্গী ও শিশুসন্তানসহ মহিলাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ধীর কিন্তু স্থির গতিতে বাড়ছিল। সেই গতি নাটকীয়ভাবে বিপরীতমুখী হল অতিমারীতে।
অতিমারিতে অর্থনীতির পতনে পুরুষরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে আপেক্ষিক পতন আরও বেশি ছিল। শিশুসন্তানের মায়েরা যারা শ্রমশক্তিতে ছিলেন তাদের অংশগ্রহণ ২০১৯’র তুলনায় ২০২০তে ১.৮ শতাংশ কমেছে যা বাবাদের কর্মচ্যুতির হারের (১ শতাংশ) প্রায় দ্বিগুণ।
বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় ও ক্যারিবিয়ান’এ মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ২০১৯এ ৫৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২০তে দাঁড়ায় ৫১.৫ শতাংশ (অর্থাৎ হ্রাসের হার ৪.৯ শতাংশ অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে হ্রাসের হার ছিল ২.৭ শতাংশ)।
অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি, কাজের ব্যবস্থায় নমনীয়তা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যেমন ছুটির সুলভতা ইত্যাদির উপর শ্রমবাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হার খানিকটা নির্ভর করে এবং অঞ্চলভেদে সেই হার বিভিন্ন হতে পারে। পারিবারিক পরিচর্যার চাপে অনেকে শ্রমশক্তি থেকে নিজেকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। মহিলাদের স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন আয় নিরাপত্তার উপর শ্রমবাজার থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রভাব আগামী দিনে বোঝা যাবে। সামগ্রিকভাবে মহিলাদের ও তাদের কাজের জগতের উপর অতিমারির এই প্রভাবের ভীষণতা ধরা পড়বে বেশ কয়েক বছর পরে।
ভারতে কর্মরত মহিলাদের উপর অতিমারির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কারণ মহিলা শ্রমশক্তির বেশিরভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে — কৃষি, ছোট কারখানায়, কুটির শিল্পে, গৃহপরিচারিকার কাজ ইত্যাদিতে নিযুক্ত।
ভারতে অতিমারীর আগে থেকেই শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ কমছিল। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ২০০৫এ ২৬ শতাংশ থেকে কমতে কমতে ২০১৯এ পৌঁছায় ২০.৩ শতাংশে।
২০২০তে কড়া লকডাউনের সময়ে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে এই হার ছিল ১৫.৫ শতাংশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে ১৬.১ শতাংশ; এই সময়ে মহিলাদের বেকারত্বের হার ছিল ১৫.৮ শতাংশ, পুরুষদের ১২.৬ শতাংশ।
সিএমআইই’র সমীক্ষায় অতি সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে বিগত পাঁচ বছরে প্রায় এক কোটি পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় মহিলা কাজ হারিয়েছেন। এই বিপুল কর্মচ্যুতির অন্যতম কারণ পারিবারিক পরিচর্যা ও গৃহস্থালির দায়িত্ব সামলানোর অনিবার্যতা। শিশু সন্তানের পরিচর্যার দায় মূলত মায়ের। কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব, সমকাজে পুরুষের তুলনায় কম মজুরি, সমাজের মান্ধাতা আমলের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ ইত্যাদি), শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি-কাজের সুযোগ ইত্যাদির মতো প্রযুক্তি শিক্ষা ও ইন্টারনেট পরিষেবার সুলভতার প্রশ্নেও বৈষম্য এমনিতেই নারীর কাজে ঢোকা এবং টিঁকে থাকার ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়। শিশু সন্তানের মায়ের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও তীব্র ও জটিল।
২০২২এ এসেও পরিস্থিতিটা একই রকম। মহিলারা সেই একই চাপে আছেন। করোনা-ভাইরাসের নিত্যনতুন প্রজাতির সংক্রমণের ভয়ে স্কুল এবং আনুষঙ্গিক পরিচর্যা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেক সময়েই ঘন ঘন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা অমিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে মহিলারা সেই একইভাবে পিষ্ট হচ্ছেন। আর এই পেষণ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। ইউএন উইমেন’এর রাপিড জেন্ডার অ্যাসেসমেন্ট শীর্ষক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে — সমীক্ষাভুক্ত ৩৩টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশেই পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও অনুভূতির জগতে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে। আর যে মহিলারা বিনা পারিশ্রমিকে পরিচর্যা ও গৃহস্থালির দায়িত্ব সামলাতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটছে, যে মহিলাদের তা করতে হচ্ছে না তার তুলনায় ১.৬ গুণ বেশি।
তাহলে? হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে, কিংবা কাজের অঙ্গন ছাড়তে বাধ্য করে, শুধু শিশু সন্তানের মা হওয়ার কারণে আর্থিক স্বাবলম্বন কেড়ে নিয়ে ‘নারী-স্বাধীনতা’র কথা আওড়ানো ‘পাগলের প্রলাপ’ মাত্র নয়, ঘোর অন্যায়।
নারীকে তার কাজের জগতে ফিরিয়ে এনে তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে এক সার্বিক পরিকল্পনা নিতে হবে।
চাই উৎকৃষ্টমানের কিন্তু সুলভ শিশুপালন, শিক্ষা ও মিড-ডে-মিল পরিষেবা, চাই পর্যাপ্ত সংখ্যক সচেতন ছুটি। চাই সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ যেখানে হিংসা, নারীবিদ্বেষ ও হেনস্থার শিকার হতে হবে না। চাই লিঙ্গ বৈষম্য মুক্ত সমাজ-দৃষ্টিভঙ্গি। মহিলাদের কাজে ঢোকা, টিঁকে থাকা এবং শ্রমশক্তি হিসেবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথে সমস্ত আইনি অবরোধকে সরাতে হবে। মহিলাদের পরিচালনা ও নেতৃত্বকারী অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে। সকলের জন্য সম্মানজনক কাজের দাবিতে শ্রম আইন লাগু করতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপ নারীবিদ্বেষপূর্ণ। রাজ্য সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বললেও দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অপশাসনে সেসব সদিচ্ছার সমাধি ঘটেছে। তাই মহিলাদের প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নিজের অধিকার।
(সূত্র: ওভার টু মিলিয়ন মমস্ লেফ্ট দ্য লেবার ফোর্স ইন ২০২০, অ্যাকর্ডিং টু নিউ গ্লোবাল এস্টিমেটস্)