শ্রীলঙ্কা পুড়ছে। এক ক্ষমতালোভী শাসকের অবিবেচক সিদ্ধান্তের জেরে আজ গোটা শ্রীলঙ্কা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশেও আগুন। এ আগুন কখন বিস্ফোরণের রূপ নেবে তা বলা দুষ্কর। কিন্তু আমরাও যে আজ এক চরম দুর্বিপাকে নিমজ্জিত তা রেখেঢেকে বলার আর কোনও উপায় নেই।
জিনিসপত্রের দাম আকাশ স্পর্শ করেছে। গত আট বছরে আমরা সর্বাধিক মূল্যবৃদ্ধির হার অর্জন করেছি (৭.৭৯ শতাংশ)। পেট্রোপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মুদ্রাস্ফীতি রুখতে সরকার গমের ওপর রফতানি-নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে ৮০’র ঘর ছুঁইছুঁই। শেয়ার বাজারে লাগাতার পতন হয়েই চলেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততায় দেশের অবস্থা শোচনীয়।
কেন এমন হল? আমরা কি এক চরমতম বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছি?
আমাদের অবস্থা যে ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে উঠছে তা কেন্দ্রের শাসক বিজেপি’র ইদানীং আচরণেও বেশ স্পষ্ট। ‘অচ্ছে দিন’এর নানারকম গল্পগাথা শুনিয়ে তারা যে এতদিন জনতার এক বড় অংশকে বিমোহিত করে রেখেছিল, তার ঘোর কাটার পালা এখন। গত আট বছরের শাসনকালে জনতার এক বৃহৎ অংশ নানা মায়ামোহে তাদের বহুতর ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিয়ে এসেছে। রাতারাতি বিমুদ্রাকরণের আঘাত, আচম্বিতে জিএসটি প্রবর্তন, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ক্রম-উর্ধ্বগতি, লাভজনক রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে জলের দরে বিকিয়ে দেওয়া, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির বরাদ্দ কমিয়ে আনা, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে শেয়ার বাজার, মিউচুয়াল ফান্ড ও ভাগ্যের হাতে সঁপে দেওয়া এবং ক্ষণে ক্ষণে লকডাউন ঘোষণা করে ও কোভিড মোকাবিলায় থালা-বাসন বাজিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটিয়ে আজ খাদের কিনারে এনে দেশকে তারা দাঁড় করিয়েছে। বার বার মানুষ প্রশ্ন করছেন, আমরা কি শ্রীলঙ্কার মতো এক জাতীয় বিস্ফোরণের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি?
এই দুর্দমনীয় সংকটের আভাস শাসকেরাও পেয়েছে। তাই, আবারও শুরু হয়েছে তাদের মায়ামোহের জাল বিছানো। তারা উন্মাদের মতো, তাজমহল, কুতুব মিনার, জ্ঞানবাপী এবং যেখানে যত ইসলামিক স্থাপত্য আছে সেগুলির উচ্ছেদ অথবা নতুন নামকরণের দাবি তুলে হিন্দুয়ানা আরোপের এক বিস্তৃত রাজনীতির সূচনা করতে চাইছে। এর উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশের মানুষকে যদি আবারও বিদ্বেষ ও হানাহানির পরিসরে ঠেলে দেওয়া যায়, তাহলে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা-উদ্ভুত সম্মিলিত ক্ষোভকে ধর্মে-ধর্মে বিভাজিত করে নিজেদের শাসন ক্ষমতাকে জিইয়ে রাখতে তারা আবারও সক্ষম হতে পারে। তাদের রাজনীতির ভিত্তিভূমিও তাই।
এটা বাস্তব যে, রুশ-ইউক্রন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রায় সর্বত্র মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকতর হয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারত এক বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রাখার ফলে সেখান থেকে আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেল কিন্তু অনেক সস্তায় আনতে পারছে। তাহলে তার প্রতিফলন জ্বালানির মূল্যে মিলছেনা কেন? আজকের আধুনিক রাষ্ট্রে এটাই কি কাম্য ছিলনা যে, দেশের শাসক আপামর জনসাধারণ, বিশেষত গরিব ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল জনসমাজকে সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচ দিয়ে তাদের সক্ষমতাকে অটুট রাখবে। কিন্তু আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার একেবারে উল্টো পথে হেঁটে চলেছে। তারা এই আন্তর্জাতিক সংকটকে বরং হাতিয়ার করে জনতাকে আরও দুর্ভোগে ফেলতে প্রয়াসী হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের সময়ে (যেমন সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন) তারা জ্বালানির মূল্য সহ অন্যান্য বহু কিছুকে ঠেকা দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবারও পুরনো রূপে ফিরে এসেছে। তাদের অর্থনৈতিক নিদানটাই হল, জোগানের দিকটায় সুবিধা প্রদান করা। যেমন, তারা নানা ধরনের ঋণ প্রকল্প ঘোষণা করছে, বড় বড় পরিকাঠামো নির্মাণে প্রভূত ব্যয় করছে কিন্তু চাহিদার দিকটি, অর্থাৎ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রমটিকে চূড়ান্তভাবে অবহেলা করে চলেছে। কোভিডের সময়ে তারা বিনামুল্যে রেশন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল বটে — শুধুমাত্র সেইটুকুতে জরুরি কিছু সমস্যার খানিক সমাধানও হতে পারে — কিন্তু তা কখনই পিছিয়ে পড়া মানুষদের দীর্ঘস্থায়ী সক্ষমতা বাড়াতে পারেনা। আর ঠিক সেই কারণেই দেশের মানুষ আজ এক নিদারুণ সংকটের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু, যে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে সরকার ও ব্যাঙ্ক’এর তরফে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষজনদের প্ররোচিত করা হচ্ছিল, এখন শেয়ার বাজারে ধস নামার ফলে সে বিনিয়োগও বিফলে গিয়েছে। তবুও রক্ষে, বেশ কিছু রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলির সরকার নিজ নিজ রাজ্যে নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম নেওয়ার ফলে এই সংকট এখনও তীব্র বিস্ফোরণের আকার নেয়নি।
অথচ গত এপ্রিল মাসে রেকর্ড পরিমাণ জিএসটি আদায় হয়েছে (১.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা)। রফতানিও এই সময়ে যথেষ্ট বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের তো উচিত ছিল, সংকটের সময় কোষাগারের সোয়াস্তিকে সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা করে তোলা। অর্থাৎ, জ্বালানিতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো, উচ্চহারের কর ছাঁটাই করা। কিন্তু বুঝতে হবে, এই সরকারের উদ্দেশ্যটাই ভীষণ রকম ভাবে কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজিমুখি। কোষাগারের বাড়তি অর্থ দিয়ে তারা কর্পোরেট স্বার্থে বড় বড় পরিকাঠামো গড়ে তুলবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোটি কোটি টাকা আয়ে ব্যবসারত ‘কাশ্মীরি ফাইলস’ ছবিটিকে করমুক্ত করবে, যা কিছু সরকারি সম্পত্তি ও সম্পদ সেগুলিকে ‘অ্যাসেট মনেটাইজেশন’এর নামে কর্পোরেটপতিদের হাতে তুলে দেবে, বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার নামবিহীন ‘ইলেক্টরাল বন্ড’এ শাসক দলের কোষাগার ফুলে-ফেঁপে উঠবে যাতে অন্য কোনও দল ধারেভারে তাদের টক্কর না দিতে পারে; জনকল্যাণের অর্থে তারা বোঝাবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা — এইভাবে এক অলীক অর্থনৈতিক কুযাত্রায় সওয়ার হয়ে তারা দারিদ্রকে আরও সম্প্রসারিত করে চলেছে মাত্র। অথচ, বড় বড় কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধিতে কোনও ছেদ নেই, ব্যাঙ্কগুলিও ভালই লাভালাভের মুখ দেখছে। কিন্তু কীসের বিনিময়ে? দেশের আপামর জনসাধারণের কর্মচ্যুতি ও গড় আয় কমার বিনিময়ে। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। গত ৮ মে অবধি দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৮ শতাংশের ওপরে। যদিও এই হার কখনও কখনও কিছুটা কমে আসে বা তার সঠিক মূল্যায়ন করা যায়না, কারণ, বর্তমানের গিগ অর্থনীতির জমানায় কর্মসংস্থান ও কর্মচ্যুতির মধ্যে এক অবিশ্বাস্য ওঠানামা থাকে। এখানে কারও কাজ স্থায়ী নয়, আবার দীর্ঘ সময় ধরে বহুজনে বেকারও বসে থাকেনা। দেখতে হবে, একটা সময় ধরে (অন্তত টানা দুই কি তিন বছর) আয়ের গড়পড়তা হিসেবটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে। এই তথ্যানুসন্ধান থেকেই সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের স্পষ্ট ছবিটি প্রতীয়মান হবে। কিন্তু এমনতর তথ্য সংগ্রহ কেউ করেছেন বলে তেমন ভাবে জানা নেই।
ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কের দেয় ঋণে সুদের হার বাড়ায় তা সার্বিক ভাবে বিনিয়োগের ওপর আঘাত হানবে। কর্মসংস্থানে আরও ভাটা আসবে। বাজারে টাকার জোগান কমবে — যদিও এরফলে মুদ্রাস্ফীতি মোটেই হ্রাস পাবে না, কারণ, এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মুখ্য কারণ জ্বালানির মূল্যের ঊর্ধ্বগতি যার রাশ সম্পূর্ণত সরকারের হাতে। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘উজালা’ স্কিমে এলপিজি সংযোগ আজ করুণ ও হাস্যকর জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি, এই স্কিমে বিনা পয়সায় এলপিজি’র সংযোগ পাওয়া গেলেও প্রতি মাসে ১০২৯ টাকা দিয়ে সিলিন্ডার কেনার সামর্থ্য প্রায় কারওরই নেই। তার ওপর কেরোসিনও অগ্নিমূল্য। ফলে, সেই পুরনো ঘুঁটে-কয়লা-কাঠের ব্যবস্থাতেই ফিরে যাচ্ছেন আপামর গরিব ও নিম্নবিত্ত জনসাধারণ।
প্রশ্ন হল, এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে কীভাবে? আমরা ক্রমেই এক অতল খাদের অতি কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য