আধুনিক ভারতের লক্ষ্যে যুক্তিবাদের পথিক লড়াকু যোদ্ধা রামমোহন রায়কে তাঁর ২৫০তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণ
Rammohun Roy

২২ মে ২০২২ একদিকে ভারত যখন আধুনিক ভারত গঠনের লক্ষ্যে প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারকদের অন্যতম রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে, অন্যদিকে আমরা তখন ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর পরিহাসের মুখোমুখি হয়েছি। ক্ষমতাসীন শাসক একটা গণহিংসা সংঘটনের লক্ষ্যে প্রায় তিন শতাব্দী আগে ভারত শাসনকারী মুঘল রাজবংশের সময়ের কিছু ভুলকে হাতিয়ার করে এবং ইতিহাসের মনগড়া বিকৃতি ঘটিয়ে ২১ শতকের ভারতকে ব্যাপক সহিংস প্রতিশোধ নিতে উস্কে চলেছে। একদিকে আগ্ৰাসী ঔপনিবেশিক শাসন অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও মতাদর্শগত প্রতিরোধের মুখে আধুনিক ভারতের রূপকল্পকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে রামমোহন এবং তাঁর সমসাময়িক সংস্কারকদের যে লড়াই করতে হয়েছিল তার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে এই বিতর্কিত বিরোধাভাস আমাদের সাহায্য করবে।

পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা দখল এবং সমগ্র ভারতবর্ষের উপর তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডে পরিণত হয়”। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমগ্র ভারত দখলের পনের বছর পর অর্থাৎ ১৭৭২ সালে রামমোহনের জন্ম হয়। তাঁর জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরে, রামমোহন সমস্ত প্রধান ধর্মের ধর্মগ্রন্থ এবং প্রধান গ্রন্থগুলি আয়ত্ত করেন, প্রায়শই সেগুলির মূল ভাষার রচনা তিনি পড়তেন কারণ তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি তৎসহ ইংরেজী, ল্যাটিন এবং গ্রীক এইরকম বহু ভাষার ওপর তার অসাধারণ কর্তৃত্ব ছিল। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আধিকারিকের চাকরি করতেন, চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮১৫ সালে কলকাতায় থিতু হন এবং লেখালেখি ও সংগঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন।

সতীদাহ প্রথার বিলোপের জন্য রামমোহনের যে ঐতিহাসিক অবদান, তারজন্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়, এই সতীদাহ প্রথা আসলে তথাকথিত ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’র নামে হিন্দু বিধবাদের আত্মহননে বাধ্য করা যা প্রকৃতপক্ষে তাদের স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীকে ধর্মীয় অনুশাসনের নামে পুড়িয়ে মারা ছাড়া আর কিছুই নয়। তৎকালীন সময়ে বহুবিবাহও একটি স্বাভাবিক প্রথা ছিল, এর অর্থ যুগপৎ একাধিক নারীর সামাজিক বঞ্চনা। রামমোহন তাঁর নিজের পরিবারে এইরকম ঘটনা প্রথম হতে দেখেন, যখন তাঁর বৌদি এই ঘৃণ্য প্রথার শিকার হন। তিনি এই প্রথার বিলোপের জন্যে প্রাথমিকভাবে এই উদ্দেশেই তাঁর নিজের প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা সংবাদ কৌমুদীর পাতায় তেজস্বী, বলদীপ্ত এবং প্রত্যয়ী একাধিক নিবন্ধের মাধ্যমে প্রচার চালাতে থাকেন, এই প্রচার অবশেষে ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য করে।

sati burn

সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি ছিল হিন্দু মহিলাদের অধিকারের সমর্থনে প্রথম ঐতিহাসিক আইনি পদক্ষেপ, যার গুরুত্বকে শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক পদক্ষেপের ফলে প্রবর্তিত ১৮৫৬ সালের বিধবা বিবাহ আইন এবং আম্বেদকর ও নেহরুর নেতৃত্বে ১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালে হিন্দু কোড বিলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ঘটনা হলো যে সতীদাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার প্রায় একশো ষাট বছর পর ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের রূপ কানওয়ার সতী মামলা এবং সতীদাহের সমর্থনে আরএসএস-বিজেপি’র আক্রমণাত্মক প্রচার অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে আবার একটি সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইনের প্রয়োজন হয়েছিল। এই ঘটনা রামমোহনের প্রচারের ঐতিহাসিক তাৎপর্য প্রমান করছে। রামমোহনের কাছে সতীদাহ প্রথা বিরোধী অভিযান ছিল যুক্তিবাদ ও আধুনিকতার যে বৃহত্তর প্রগতিশীল এজেন্ডা তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যা তাঁকে একজন ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক হিসাবে তুলে ধরেছিল। তিনি মহিলাদের জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারের দাবিও উত্থাপন করেন — যেখানে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের নারীরা তাদের বিবাহ পরবর্তী পিতামাতার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের দাবি এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। অবশেষে হিন্দুধর্মকে বর্ণভেদ প্রথা থেকে মুক্ত করতে এবং একে একেশ্বরবাদী ধর্ম বিশ্বাসে সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি হিন্দুধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে একটি সার্বজনীন ধর্মের ধারণার অবতারণা করেন এবং ব্রাহ্মসভা ও ব্রাহ্মসমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন।

সামাজিক সংস্কার, আধুনিক শিক্ষা এবং ন্যায়বিচারের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে জড়িত থাকার পাশাপাশি রামমোহন তার সমসাময়িক মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিলেন। উনিশতম মুঘল সম্রাট আকবর শাহ দ্বিতীয় যিনি ১৮০৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৩৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন, এই উপাধি তাঁর নামের সুপরিচিত সম্মানসূচক বিশেষণ হয়ে উঠেছে। মুঘল সম্রাটের একজন দূত হিসেবে রামমোহন ১৮৩০ সালে ব্রিটেনে যান, সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর তিন বছর পর তিনি সেখানে প্রয়াত হন।

ভারতের স্বাধীনতার ধারণাটি তার জীবদ্দশায় উত্থাপিত না হলেও রামমোহন ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মুক্তির ধারণা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং উনিশ শতকের প্রথম পাদে স্পেনীয় ঔপনিবেশিকতা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জনে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত বোধ করেছিলেন।

রামমোহনের মৃত্যুর দুই দশক পরে, ভারতে স্বাধীনতার দাবিতে সুনির্দিষ্ট একটি জাতীয় জাগরণের সূচনা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে ধারাবাহিক আদিবাসী বিদ্রোহের পর, ১৮৫৭ সালের মে মাসে আমাদের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়, তখনই আজিমুল্লা খান লিখেছিলেন সেই চির-অনুপ্রেরণাময় সঙ্গীত ‘হাম হ্যায় ইসকে মালিক, হিন্দুস্তান হামারা’, বিদ্রোহে গর্জে উঠেছিল উত্তর ভারতের এক বিশাল অংশের মানুষ। ঔপনিবেশিক শাসনের ভয়াবহতা হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের অভূতপূর্ব বীরত্বের কাহিনী রচনা করেছিল। একটাই ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে এই সংগ্রাম ছিল রানী লক্ষ্মীবাই ও বেগম হজরত মহল, কুনওয়ার সিং ও মৌলভি আহমাদুল্লাহ শাহ ফৈজাবাদীর মিলিত উত্তরাধিকার, যা ভারতের পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

১৯তম মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহের দূত হিসেবে রামমোহন ব্রিটেনে মারা যান। ১৮৫৭ সালের যোদ্ধারা আকবর শাহের পুত্র এবং শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বিদ্রোহের নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১৮৬২ সালের ৮ নভেম্বর বাহাদুর শাহ জাফর রেঙ্গুনে নির্বাসনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মুঘল রাজবংশের বিরোধিতা করে একবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করার সংঘ-বিজেপি’র অপচেষ্টার বিপরীতে যদি দেখি, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুক্ত ও আধুনিক ভারতের লক্ষ্যে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে মুঘল সম্রাটদের মিত্র হিসেবে, এমনকি নেতা হিসাবে মেনে নিতেও কোনো সমস্যা ছিল না।

রামমোহন রায় হয়ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করার কোনো সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেননি, কিন্তু তিনি দেশীয় সম্পদ এবং উদ্বৃত্ত সম্পদ দেশের বাইরে পাচারের ঔপনিবেশিক লুঠের বিরুদ্ধে বিতর্ক শুরু করেছিলেন। রামমোহনের মতো, আধুনিক ভারতের সমস্ত স্বপ্নদ্রষ্টা এবং নির্মাতা যারা সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত অগ্রগতির জন্য লড়াই করেছিলেন তাঁদের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক হিসাবে আমাদের দেখতে হবে। বাংলার রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা এবং সাবিত্রীবাই ফুলে এবং ফাতিমা শেখ পর্যন্ত, উনিশ শতকে আমাদের ভারতীয় জাগরণের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রয়েছে। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল সাম্প্রদায়িকতা, ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র, কুসংস্কার এবং শোষণ উৎপীড়ন থেকে মুক্ত একটি বৈচিত্র্যময়, বহুত্ববাদী এবং গণতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন, যেখানে যুক্তি ও সম্প্রীতি হবে মর্যাদাপূর্ণ মানব উন্নয়নের স্তম্ভ। আজ যারা দেশের বর্তমানকে ধ্বংস করতে, ভবিষ্যৎকে পঙ্গু করতে অতীতের উত্থাপন করছে ভারতের সেই অনুপ্রেরণাময় উত্তরাধিকার এবং দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে সেই অশুভ শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে সাহায্য করবে।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

খণ্ড-29
সংখ্যা-20