এদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই, বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা যেমন মনস্যান্টো, মিত্তাল-ভারতী, পেপসিকো ইত্যাদি কোম্পানি একলপ্তে একরের পর একর জমিতে কৃষকদের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে আধুনিক পদ্ধতিতে রকমারি চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। এরাজ্যেও এই ধরনের চুক্তি চাষের, বিশেষত পেপসিকোর হাত ধরে আলু চাষের ভালই প্রসার ঘটেছে। পেপসিকোর উদ্যোগে আলু চাষে ধনীচাষিদের সঙ্গে যেমন চুক্তি হচ্ছে তেমনই দু’এক বিঘে জমির মালিক — এমন গরিব চাষিও পেপসি কোম্পানির চুক্তিতে সই করে আলু চাষ করছেন। কর্পোরেট উদ্যোগে এই যে চুক্তি চাষ তাকে ঘিরে আমরা এখানে আলোচনা করছিনা। গ্রাম বাংলার সর্বত্রই জমির মালিক তথা সম্পন্ন কৃষকরা নিঃস্ব, ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকদের বা নিতান্ত গরিব কৃষকদের (অর্থাৎ যারা মাত্র এক-আধ বিঘে জমির মালিক) মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে জমি ঠিকা দিচ্ছেন। গরিব এই ঠিকা চাষিদের এধরনের চাষে লাভ-লোকসান কেমন হচ্ছে তা নিয়েই বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা। এই জাতীয় ঠিকা চাষের গতি-প্রকৃতি জানার জন্য হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকের দু’টি গ্রামের চাষিদের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হয়। তারই ভিত্তিতে এই নিবন্ধটি রচিত। আশা করা যায়, অনুসন্ধানে উঠে আসা বৈশিষ্ট্যগুলো রাজ্যের অন্যান্য অংশের জন্যও প্রযোজ্য। ঠিকা-চাষিদের সঙ্গে ভাগচাষিদের কথাও এখানে আলোচিত হয়েছে।
ঠিকা-চাষ আর ভাগচাষের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। ভাগচাষের ক্ষেত্রে মালিক সার, কীটনাশক ও সেচের জলের খরচের অর্ধেক বহন করে। আর ট্রাক্টর, বীজ ও শ্রমিকের মজুরির খরচ পুরোটাই ভাগচাষিকে বহন করতে হয়। ঠিকাচাষে মালিক জমির ভাড়া বাবদ টাকা বা ফসলের অংশ পায়। চাষের যাবতীয় খরচ ঠিকা-চাষির।
ঠিকা-চাষ আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়ার একাধিক কারণ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, চাষের খরচ দিন দিন বাড়তে থাকায় এক শ্রেণীর জমির মালিক ঝুঁকিপূর্ণ চাষে না গিয়ে জমি ঠিকায় দিয়ে মরশুমের শেষে নিশ্চিত কিছু নগদ অর্থ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল আদায় করে নিতে পারছেন। অনুপস্থিত জমি মালিক, বিধবা বা মহিলা প্রধান পরিবার, চাষ ভিন্ন অন্য পেশাই যাঁদের রোজগারের মূল উৎস তাঁরাই প্রধাণত জমি ঠিকায় দিতে বেশি আগ্রহী। দ্বিতীয়ত, ব্যয়বহুল কোনো কোনো চাষে জোতদার ও ধনী চাষিরাও পুঁজি না ঢেলে গরিব ভূমিহীনদের জমি ঠিকাতে দিয়ে দেন। যেমন বোরো ধান ধনীচাষিরা আর চাষ করেন না। বোরো ধান ওঠার সময় একদিকে যেমন ঝড়-বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে যথেষ্ট সংখ্যক মজুর না পাওয়ার বিপদ। ঠিকা বা ভাগচাষ বৃদ্ধির অপর আরেকটি কারণ রাজনৈতিক। আমন চাষ না করলে অথবা কেবল এক মরশুম চাষ করলে ঠিকা বা ভাগচাষি বর্গা রেকর্ড করার সুযোগ পাবেনা। সুতরাং ঠিকা প্রথায় চাষ বা ভাগচাষ মালিকের পক্ষে নিরাপদ। মালিক ফসলের ভাগ বা টাকাও পেলেন, চাষ না করেও কেসিসি ঋণ পেলেন, কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা পেলেন আর আলেকালে বাংলা শস্য বীমার আওতায় ফসলের ক্ষতিপূরণও পেলেন। কিন্তু ভাগচাষিরা কী পেলেন?
দেখা যাচ্ছে, একজন ভূমিহীন ভাগচাষি ২ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করে ১৬ বস্তা ধান ফলিয়েছেন। মালিক পেলেন ৮ বস্তা ধান। বীজ, লাঙ্গল (ট্রাক্টর) ও শ্রমিকের মজুরি পুরোটা নিজে মেটানো এবং বাকি খরচের অর্ধেক বহন করার পর দেখা যাচ্ছে, তাঁর ওই দুʼবিঘে আমন চাষ করে মাত্র দুʼহাজার টাকা লাভ হয়েছে। হ্যাঁ, খড় বিক্রি করে তিনি আরও আটশো টাকা পেয়েছেন।
আবার একজন ভূমিহীন ভাগচাষি ২২ কাঠা জমিতে বোরো ধান চাষ করে ১০ বস্তা ধান ফলিয়েছেন। মালিককে অর্ধেক ধান দেওয়ার পর তাঁর ঘরে ঢুকেছে ১,৭৫০ টাকা মাত্র। খড় বেচে যে তিনি আরও কিছু টাকা পাবেন সে উপায়ও নেই। কারণ বোরোতে ধানকাটা মেশিনে ধান কাটা হয়। ফলে খড় সব খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। এই দুই ভাগচাষির চাষ করার জন্য সমবায় সমিতি থেকে কোন ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই। বছরের পর বছর মাটির বাড়িতেই রয়েছেন, সরকারি প্রকল্পে এক কুঠুরি ঘরও তাঁরা পাননি।
একজন ভূমিহীন কৃষক (কৃষিমজুর) ২ বিঘে জমিতে চুক্তি ভিত্তিতে (ঠিকায়) বোরো ধান চাষ করে ১৮ বস্তা ধান ফলিয়েছিলেন। মালিককে চুক্তি অনুযায়ী দিতে হল ৪ বস্তা ধান। বাকি যে ধান রইল তারমধ্যে ৫ বস্তা ধান চাষের খরচ মেটাতেই চলে গেল। বাকি ধান যা রইল তা ওই চাষির কথায়, “মাস চারেক ঘরের চালে খেয়ে মেখে, আর কিছু ধান দু’মাস পরে বেচে হাজার পাঁচেক টাকা হাতে পেলাম।” কয়েক মাসের খোরাকি আর পাঁচহাজার টাকার জন্য এত প্রাণপাত পরিশ্রম! এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার, সেটা হল সব মালিক সমান নয়। বিঘেয় তিন বস্তা ধান দেওয়ার শর্তেও গরিব চাষিকে রাজি হয়ে যেতে হয়। সে যাক। যাঁরা একটু বেশি জমিতে আবাদ করেন, তাদের অবস্থা? একটু যাচাই করা যাক। নিজের সামান্য একটু জমি থাকলে তবেই তো বেশি জমি ‘ঠিকে’ করার জন্য পাওয়া যাবে। এই গরিব চাষিটির নিজস্ব জমি দশ কাঠার সামান্য বেশি। তিনি ঠিকাতে এবছর প্রায় ৯ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছিলেন। মালিককে বিঘে পিছু ২,৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি ৮২ বস্তা ধান ফলিয়েছেন। সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে তিনি সাকুল্যে লাভ করেছেন মাত্র ২,৫৭০ টাকা। অন্য বছর অবশ্য এত খারাপ পরিস্থিতি হয় না। এবার দুʼবিঘে ধান জলের তলায় চলে গিয়েছিল। অন্যবারে তা হয়নি; এমনকি গতবছর তিনি মোট ১১৫ বস্তা ধান ফলিয়েছিলেন এবং ৫৭ বস্তা বেঁধে রাখতে পেরেছিলেন। গড় হিসেব করলে বলা যায়, বেশি জমি চাষ করার ফলে কিছু আয়ের মুখ তিনি দেখেছেন। পাকা বাড়িও করেছেন। তবে ঠিকা-চাষের যদি সামগ্রিক ছবি বিচার করা যায় তাহলে ওই পর্যন্ত। অর্থাৎ “ক’মাস ঘরের চালেই রান্না বাদেও দু’চার হাজার টাকা লাভ”। আর হুড়মুড়িয়ে সব গরিবই যে ঠিকা-চাষ করেন, তথ্য তা বলে না। ২৭৫টি গরিব পরিবারের মধ্যে সর্বাধিক ৭৬টি পরিবার বোরো চাষ করেন (প্রায় ২৮ শতাংশ)। এবছর ডিভিসি জল না দেওয়ায় পরিমাণটা আরও কমে গেছে।
বোরো ধান ছাড়া অনেক গরিব আলু চাষও ঠিকা প্রথায় করে থাকেন। অবশ্যই নিজের জমানো টাকায় বা কারো কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে এই যে চাষ, তাতে এবছর গরিব ঠিকা চাষিদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। অসময়ের বৃষ্টিতে দু’বার করে চাষ করতে গিয়ে দেখা গেছে, চড়া দামে নিম্নমানের বীজ ব্যবহারের ফলে ও সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় বিঘা পিছু মাত্র ৩০-৩২ বস্তা (৫০ কেজি বস্তা) ফলন হয়েছে (হওয়ার কথা ৮০ থেকে ৯০ বস্তা)। অর্ধেকেরও বেশি গরিব চাষির সমূহ লোকসান হয়েছে। আলুচাষে গরিব চাষিরা আড়তদারের (মহাজন) কাছ থেকে দাদন নিয়েও অনেকে চাষ করেন। মহাজন বেশি দামে সার ও বীজ গছিয়ে পরে কম দামে আলুটা কিনে নেয়। এতে লোকসান হলেও আবার মহাজনের থেকে ঋণ করে ক’মাস চালিয়ে পরের বছরের জন্য ভাগ্য পরীক্ষা করতে হয়। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। ‘উদার’ মালিকের কাছে বিঘে পিছু তিন বস্তা আলু দেওয়ার শর্তে (কোন কোন মালিক বিঘেয় ১০ বস্তা পর্যন্ত নেয়) কঠোর পরিশ্রমী এক আদিবাসী কৃষক দু’বিঘে জমিতে ১১০ বস্তা আলু ফলিয়ে মহাজনের ঋণ মিটিয়েও ৫০ বস্তা আলু হিমঘরে মজুত করেছেন। তবে এমন চাষির সংখ্যা খুবই কম।
গরিব চাষিরা লিজ নিয়ে সবজি চাষও করেন। সেক্ষেত্রে ভালো লাভের মুখও দেখেন অনেকে। অনেক মধ্যচাষিও সবজি চাষে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু আমরা বলছি গরিব লিজ চাষিদের কথা। কখনোই গরিব ভূমিহীনদের বড় অংশ এই ব্যয়সাধ্য চাষ করতে পারেন না। ওই ২৬৫টি পরিবারের মধ্যে সবজি চাষ করেন মাত্র ২০টি পরিবার। ঘটনাক্রমে সুনা জমি (আউশের জমি) যারা পেয়ে যান, সেখানে সারা বছরই পালা করে বিভিন্ন সবজি (কপি, টম্যাটো, ভেন্ডি, শসা ও করলা) চাষ করে ভালো লাভ করেন। আর যে ব্যক্তি কয়েক মাসের জন্য শুধু আমন জমিতে একটি মাত্র সবজি ফলান তাঁর সংসারে কোন শ্রীবৃদ্ধি হয় না।
অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ঠিকা বা ভাগচাষিদের আর্থিক অবস্থার কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। পরিশ্রমী এই কৃষকরা যদি ‘কৃষকের’ স্বীকৃতি পান তাহলেই কেবল এঁদের সংসারের হতশ্রী চেহারাটা বদলাতে পারে। জমির কাগজ নেই, সুতরাং তাদের কিছুই নেই। এই নীতির বদল ঘটাতে হবে। জমির মালিকানার প্রশ্ন আপাতত নাহয় দূরে রাখা যাক। কিন্তু সরকার প্রকৃত এই কৃষকদের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে সমীক্ষা চালাক। কারা কোন জমি একটি শস্য-মরশুমে চাষ করলেন — তার পূর্ণ পরিসংখ্যান তৈরি করে ঠিকা ও ভাগচাষিদের শংসাপত্র দেওয়া হোক। এই শংসাপত্রের ভিত্তিতেই তাঁরা সমবায় ঋণ, শস্যহানির ক্ষতিপূরণ, সুলভে সার-বীজ-ডিজেলের মতো উপকরণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। আর এ মুহূর্তে কৃষি দপ্তরের কাজ হওয়া উচিত, পাম্পসেট, থ্রেশার, স্প্রে মেশিন ইত্যাদি কৃষি সরঞ্জাম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গরিব ঠিকা ও ভাগচাষিদেরই সরবরাহ করা।
- মুকুল কুমার