(এখানে দুই কিস্তি একত্রে দেওয়া হল)
আজ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে দুর্নীতি কোনো পৃথক শব্দ নয়। এ যেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সংবাদ শিরোনামে দুর্নীতি শব্দটা এতটাই প্রতিফলিত যে শিক্ষিত বেকাররা সরকারের বিশেষ প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে বলছে – “দুয়ারে দুর্নীতি”। কিন্তু প্রশ্ন হল এই দুর্নীতির জয়যাত্রার শুরু কবে থেকে? এর শিকড়ের সন্ধান অবশ্য পুরোপুরি পাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা যারা চাকরির দাবিতে বছরের-পর-বছর রাস্তায় পড়ে ছিলাম এবং আছি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে। তাদের কাছে এই ব্যাপারটা অনেকটাই স্পষ্ট।
পূর্বতন সরকারের আমল থেকেই এ রাজ্য শিল্প শ্রীহীন, কর্মসংস্থানহীন। তাই সরকারি চাকরি বলতে এ রাজ্যের শিক্ষিত বেকাররা বুঝতো এসএসসি (শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষা)। বাম আমলে একটা সময় ছিল যখন ম্যানেজিং কমিটির হাত ধরে, নেতা মন্ত্রীর সংস্পর্শ প্রাপ্ত ব্যক্তিদেরই মিলতো নিয়োগপত্র। এই বিষয়ে জনরোষ বাড়তে থাকলে সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল স্ব-শাসিত সংস্থা — এসএসসি ( স্কুল সার্ভিস কমিশন)। ধারাবাহিকভাবে নিয়মমাফিক প্রতিবছর সংঘটিত এই পরীক্ষা ছিলো পশ্চিমবাংলার গরিব মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বেকারদের স্বপ্ন সাফল্যের সোপান। তারপর একদিন পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হল। দীর্ঘ এক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তারা বুঝতে পেরেছিল অবস্থা আরো ভয়ানক হতে চলেছে। হলোও তাই। ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের যে পরীক্ষা তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সালে যে পরীক্ষা হয়েছিল সেই পরীক্ষার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বড়োসড়ো অভিযোগ ওঠে। তৈরি হয় সিএমপি কেস (কম্বাইনড মেরিট প্যানেল) প্রাইমারির ক্ষেত্রেও উঠে একই অভিযোগ। টেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসলেও তার সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। কোনো নেতা, মন্ত্রী, আমলাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই সময়ের দুর্নীতি প্রসঙ্গে সাম্প্রতিককালে একটি সংবাদ মাধ্যমের সাক্ষাত্কার দিতে গিয়ে সেই সময়কার স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মাননীয় চিত্তরঞ্জন মণ্ডল মহাশয়ের বক্তব্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার বিভিন্ন বক্তব্যের পাশাপাশি — পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে কি হয়েছিল আপনি কি জানেন না? তার এই ইঙ্গিত যে বিশেষ এক অধ্যায়কে নির্দেশ করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কে ছিলো সেই সময়কার প্রভাবশালী তা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মধু শেষ হলে মৌমাছিরা ফুল বদলাতে পারে কিন্তু নিজেদের স্বভাব পরিবর্তন সম্ভব নয়।
২০১২ সালের এই অমীমাংসিত দুর্নীতির উপরে আছড়ে পড়ল নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি (২০১৪-১৫ সাল নাগাদ) সে বিজ্ঞপ্তিও সহজভাবে আসেনি। চাকরি প্রার্থীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ শহর কলকাতার বুকে আছড়ে পড়েছিল একটার পর একটা আন্দোলন। তার ফলে নতুন বিজ্ঞপ্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। এবার পরীক্ষা পদ্ধতিতেও একটা আমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। আগে এসএসসি শিক্ষক নিয়োগের যে পরীক্ষা নিতো তা ছিল আরএলএসটি (অর্থাৎ রিজিওনাল লেভেল সিলেকশন টেস্ট) এইবার সেই নিয়ম পরিবর্তন করে বানানো হলো এসএলএসটি (স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট)। বর্তমানে এই এসএলএসটি-র মাধ্যমে তৈরি হওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের যে প্যানেল তা বিশেষভাবে চর্চিত এবং কাঠ গড়ায় দণ্ডায়মান।
এসএলএসটি-র নিয়োগ দুর্নীতি সম্পর্কে আলোচনার আগে এসএসসি — গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়টা সামনে আসা দরকার। এসএলএসটি-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রকাশ এর পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল গ্রুপ-ডি এবং গ্রুপ-সি কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত মেধা তালিকা। প্রথম থেকেই চাকরিপ্রার্থীরা নানা অভিযোগ নিয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য তাদের অভিযোগগুলিকে মধুমাখা বাক্যলাপে খন্ডন করে, প্যানেলের স্বচ্ছতার পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলো। তারপর বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের বুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটা পাথরের মতো কঠিন বছর। সাম্প্রতিককালে আদালতের রায়ে তাদের উপর নেমে এসেছে স্বস্তির বৃষ্টি। কিন্তু বৃষ্টি হলেও যে মাটি ভিজছে না সে বিষয়ে পরে আলোচনা করছি। আপাতত বলি গ্ৰুপ-সি এবং গ্ৰুপ-ডি এর দুর্নীতি ও কোর্টের রায় প্রসঙ্গ।
সম্প্রীতি কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বেশ কয়েকটা যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম গ্ৰুপ-ডি ও গ্ৰুপ-সি-এর নিয়োগ দুর্নীতি যাচাই করতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দান। প্রাথমিক তথ্যর উপর ভিত্তি করে অভিজিৎ বাবু গ্ৰুপ-ডি এবং গ্ৰুপ-সি-এর যথাক্রমে — ৫৭৩ এবং ৩৫০ জনের চাকরি বরখাস্ত ও বেতন বন্ধের নির্দেশ দান করেন। যদিও পরবর্তী কালে ডিভিশন বেঞ্চে সেই রায়ের উপরে স্থগিতদেশ দেওয়া হয়। ডিভিশন বেঞ্চের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিবিআই-এর পরিবর্তে গ্ৰুপ-ডি মামলার তদন্ত ভার নস্ত্য হয় একটা কমিটির উপরে। এই কমিটি ছিল প্রাক্তন বিচারপতি ও শিক্ষা দিপ্তেরের কয়েকজন আধিকারিকদের নিয়ে তৈরি, যার নেতৃত্বে ছিলেন আর কে বাগ। আর কে বাগের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী গ্ৰুপ-ডি-তে প্যানেল বহির্ভূত নিয়োগ হয়েছে ৬০৯ জন। সমান্তরালে চলতে থাকা আরও দুটি মামলা তথা গ্ৰুপ-সি এবং এসএলএসটি-র চূড়ান্ত রায় এখনো আসেনি। তবে এসএলএসটি-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের যে মামলা চলছিল সেই মামলা এবং এই গ্রুপ-ডি মামলা উভয় মামলার প্রাথমিক তদন্তে এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট উঠে আসে। এই নিয়োগ দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড একটা কমিটি। এই কমিটি গঠিত হয়েছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নেতৃত্বে। এই কমিটিতে ছিলেন পাঁচ জন ব্যক্তি — শান্তি প্রসাদ সিনহা (এ্যাডভাইসর, স্কুল সার্ভিস কমিশন), অলোক সরকার (ডেপুটি ডাইরেক্টর), সুকান্ত আচার্য (পার্সোনাল সেক্রেটারী অফ মিনিস্টার), প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় (ওএসডি) ও তাপস পাঁজা (বিকাশ ভবন ল সেকশন)। আর এই কমিটির কূট বুদ্ধিতেই তৈরি হয়েছিল অবৈধ নিয়োগের কলাকৌশল। তারপর যখন আদালতে এই বিষয় নিয়ে জলঘোলা হতে শুরু হয়, ঠিক তখন কম্পিউটারের উপর সামগ্রিক দোষ চাপিয়ে বিষয়টা থেকে পরিত্রান পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন শান্তি প্রসাদ। পরে অবশ্য সত্যতা জানা যায়। তাদের সূক্ষ্ম হাতের নিপুণতায় জাল হয়েছে রিকমেন্ডেশন লেটারের সই, পোড়ানো হয়েছে ওএমআর শিট, ডিলিট করা হয়েছে কম্পিউটারের সমস্ত ডেটা। কিন্তু তাতেও পরিত্রাণ নেই। একটা দুটো কান টানতে টানতে মাথা পর্যন্ত পৌঁছাতে চলেছে দুর্নীতির মামলা। এই অবৈধ নিয়োগের গল্প থেকে বাদ যায়নি স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তনদের নাম — সুবীরেশ ভট্টাচার্য (চেয়ারম্যান স্কুল সার্ভিস কমিশন), শর্মিলা মিত্র (অস্থায়ী সময়ের চেয়ারম্যান স্কুল সার্ভিস কমিশন ও রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান), মহুয়া বিশ্বাস (রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান), শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায় (রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান), শেখ সিরাজউদ্দিন (রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান)। এই দুর্নীতির নিয়োগ কান্ডারীদের তালিকায় নাম রয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলীর। রিপোর্ট অনুযায়ী ভুয়ো সুপারিশপত্রগুলি শান্তিপ্রসাদ সিনহা নিজে কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন। কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় নিয়োগপত্র ছাপার জন্য রাজেশ লায়েক বলে একজন কর্মীকে নির্দেশ দিতেন। এই নিয়োগপত্রগুলি পর্ষদের অফিস থেকে না দিয়ে এসএসসির নবনির্মিত ভবন থেকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিচারপতি বাগের কমিটি। এমনকি লেনদেনের হিসাব নিকাশ করার জন্য ছিল আলাদা রেজিস্টার। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি স্ব-শাসিত সংস্থান। সেই স্ব-শাসিত সংস্থার উপরে ছড়ি ঘোরানোর জন্য কোন কমিটি গঠন করায় চূড়ান্ত বেআইনি। এসব ঘটনা মনে করায় অনিল কাপুরের নায়ক সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়ালগ — 'স্যাব কে স্যাব চোর হে শালা।' অথচ চাকরি প্রার্থীরা বা বর্তমান শিক্ষকরা দুর্নীতির কথা তুলে ধরে কোন ডেপুটেশন নিয়ে গেলে। এই সমস্ত আধিকারিকরা আক্রমণাত্মক কথা বলতেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় — “চোরের মায়ের বড় গলা।”
তদন্তের শেষ দিকে যখন বেরিয়ে আসলো রাঘব বোয়াল তথা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম তখন বিস্ফোরণ ঘটল হাইকোর্টে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই গল্পের অন্যতম অংশীদার হিসেবে নির্দেশ করেন রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। ১২ এপ্রিল যখন এই দুর্নীতির মামলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সিবিআই দপ্তরে হাজিরা নির্দেশ দেন। তখন তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপরে। শুরু হল ধুমধুমার। সঙ্গে সঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ মন্ত্রীর সিবিআই তদন্তের উপরে স্থগিতাদেশ জারি করল। প্রসঙ্গত বলা দরকার অভিজিৎ গাঙ্গুলি এই দুর্নীতি মামলায় বারংবার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেও ডিভিশন বেঞ্চ বারংবার তা খারিজ করে দেয়। ফলে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বাধ্য হয়ে এই সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে। তারপর লক্ষ্য করা যায় আরও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এসএসসি, গ্রুপ-ডি, গ্রুপ-সি মামলা যেন অরুচি হয়ে উঠেছিল সমস্ত বেঞ্চের কাছে। কোনো বেঞ্চই আর মামলা গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তৃণমূল বার অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্নভাবে এই মামলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা অব্যাহত। সুতরাং বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ এবং আতঙ্ক কতটা গভীর তা সহজেই অনুমান করা যায়। পার্থবাবু মুখে যতই বলুক আইন আইনের পথে চলবে। পিছন থেকে আইনের হাত পা বেঁধে রাখার যে চক্রান্ত চলছে তাতে মনে হচ্ছে — বিচারের বাণী যেন নিভৃতে কাঁদে।
এদিকে রাজ্যের বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম ২০১৯ সালে এসএলএসটি’র মেধা তালিকায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অনভিপ্রেত। এই ইস্যুকে সামনে রেখে এবং গেজেট মেনে নিয়োগ না করার দাবিতে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কোলকাতার মেয়ো রোডে প্রেসক্লাবের সামনে যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের ব্যানারে শুরু হয় অনশন আন্দোলন। যদিও এই অনশন আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চ স্বচ্ছ নিয়োগের দাবি নিয়ে বিকাশ ভবন, আচার্য সদন, এমনকি নবান্ন অভিযানের মতো কর্মসূচিও পালন করেছে। এই সমস্ত দাবিগুলির অন্যতম ছিল প্রাপ্ত নম্বর সহ মেধাতালিকা প্রকাশ করা, গেজেট মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা। অন্যান্য দাবি পূরণ না হলেও স্কুল সার্ভিস কমিশন ২টি কাউন্সিলিং করতে বাধ্য হয়। যার প্রথমটা ছিল এম্পানেল কাউন্সিলিং এবং দ্বিতীয় থেকে ওয়েটিং-এ থাকা ক্যান্ডিডেটদের কাউন্সিল। ওয়েটিং কাউন্সিলিংয়ের বিষয়টি একটু স্পষ্ট করা দরকার। যেহেতু মেধাতালিকা ছিল মাল্টিপল রাঙ্ক যুক্ত। তাই এক একটা কাউন্সিলিংয়ের পর একাধিক সিট ফাঁকা থেকে যেত। যেমন — একজন এসসি ফিমেল ক্যান্ডিডেট মেধা তালিকায় চার জায়গায় এম্পানেল হিসাবে স্থান পেয়েছিল (জেনারেল-পুরুষ/মহিলা, জেনারেল-মহিলা, এসসি পুরুষ/মহিলা, এসসি-মহিলা) এই চার স্থানে তার নাম থাকলেও সে পছন্দ করবে একটাই। ফলে তার একটা পছন্দের সিট গ্রহণ করার পরে তিনটি ফাঁকা হয়ে যাবে। পরবর্তীকালে তিনজন ওয়েডিং এম্পানেল হিসেবে উঠে আসবে। এইভাবে সর্বমোট আটটা কাউন্সিলিং-এর খবর প্রকাশিত। এই বিষয়ে পরবর্তীকালে বিস্তারিত আলোচনা করছি। আপাতত অনশনের প্রসঙ্গে আসা যাক। দীর্ঘ ২৯ দিন যাবৎ চলতে থাকে এই আন্দোলন। সেই মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে চাকরিপ্রার্থীদের আশ্বস্ত করেছিলেন। তিনি তাদের ন্যায় পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। লোকসভা ভোটের পরে প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করেও এই সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। ঐ মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি শিক্ষা দপ্তরকে ঘুঘুর বাসা নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। এখান থেকেই তিনি সরকারপক্ষের ৫ জন এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে ৫ জনকে নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রীকে। বলাবাহুল্য সরকারপক্ষ দ্বারা মনোনীত পাঁচজন সদস্য আর কেউ নন পূর্বোক্ত ব্যক্তিরাই। শোনা গেছে এদের মাথায় ছিলেন শিক্ষাসচিব এবং শিক্ষামন্ত্রীও। আন্দোলনকারীদের ৫ কমিটির কাজ হবে সরকারি কমিটির কাছে সমস্ত দুর্নীতির প্রমাণ এবং অভিযোগগুলি প্রদর্শন করা। সরকারি কমিটি মারফত প্রাপ্ত প্রত্যুত্তর আন্দোলনকারীদের কাছে সরবরাহ করা। এককথায় একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে লক্ষ্য করা গেল আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধ্বংস করতে আন্দোলনকারীদের এই পাঁচ কমিটি এবং তাদের আত্মীয়স্বজনকে অবৈধভাবে চাকরিতে নিয়োগ করে দেওয়া হল। যাদের রাঙ্ক ছিল অন্যান্য আন্দোলনকারীদের অনেক পরে। অনশন আন্দোলন শুরু হলো চতুর্থ কাউন্সেলিং। এই কাউন্সেলিং এরফলে আনুমানিক ৪,০০০ জনের চাকরি হয়েছিল। এরপরেও আরো চারটি কাউন্সিলিং হয়। লকডাউন পিরিয়ডে সম্পন্ন করা হয়েছিল অষ্টম কাউন্সিলিং। এই কাউন্সিলিং হয়েছিল এসএমএস’এর মাধ্যমে। যা সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। বলা বাহুল্য প্রথমদিকে কাউন্সিলিংয়ের যেভাবে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল শেষের দিকের কাউন্সিলিংগুলোতে তেমনভাবে তথ্য সরবরাহ করেনি স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইট। লকডাউন পিরিয়ডে দেওয়া হয়েছে অজস্র অবৈধ নিয়োগ। যার প্রমাণ রয়েছে যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের হাতে। সেই প্রমাণ সমূহ নিয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশন, বিকাশ ভবন, শিক্ষামন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে দপ্তরে ঘুরলে। তাচ্ছিল্য আর পুলিশ দিয়ে অ্যারেস্ট করিয়ে দেওয়ার হুমকি ছাড়া আর কিছু মেলেনি চাকরিপ্রার্থীদের। লকডাউন, মহামারীর অজুহাত দেখিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার স্বাধীনতাও ধ্বংস করা হয়েছিল। অবশেষে বাধ্য হয়ে কোর্ট পারমিশনের মাধ্যমে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে নবম থেকে দ্বাদশ স্তরের দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের ব্যানারে আজ ১৭৮ দিন যাবত চালিয়ে যাচ্ছে তাদের হকের লড়াই।
নিয়োগ দুর্নীতির অগ্নিকুণ্ড চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে। রাস্তায় রাস্তায় দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে প্রতিদিন। দুর্নীতির প্রমাণিত সত্যগুলো হাইকোর্টের দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমবাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে। নেতা-মন্ত্রী আমলাদের ললাটে স্বর্নাক্ষরে লেগে যাচ্ছে দুর্নীতি পরায়ণতার সীলমোহর। কিন্তু তাতে চাকরিপ্রার্থীদের কী কোনো লাভ হচ্ছে? দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, মন্ত্রী আমলাদের কি আদৌ কিছু শাস্তি হচ্ছে? অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে যে সমস্ত চাকরিপ্রার্থী হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে পারছে না, তাদের ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখাবে কে? নেতা-মন্ত্রী-আমলাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার পরে যে ছেলেগুলো হাইকোর্টের নির্দেশে চাকরি হারাল সে না হয় শাস্তি পেল। কিন্তু যে পিটিশোনার নিজের প্রাপ্যের আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল সে কি তার হকের চাকরি পেল? যে নেতা-মন্ত্রীকে মোটা টাকা দিয়ে অবৈধ চাকরি পাওয়ার পরেও কর্মহীন হল, সেই নেতা বা মন্ত্রীর কি কোনো শাস্তি হল? এই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের কাছে নেই। চোখের সামনে অবৈধ নিয়োগকারীদের বুক বাজিয়ে দুর্নীতি স্বীকার করতেও দেখেছি। কিন্তু কিছু কি হয়েছে তাদের? প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু প্রকাশ্য স্বীকার করেছেন ২০১৪ প্রাইমারিতে তিনি তার বউ, বৌদি সমেত ৬২ জনকে চাকরি দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এখানে স্বপন দেবনাথ (মন্ত্রী) থেকে শুরু করে তপন চট্টোপাধ্যায় (পূর্বস্থলী ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ও প্রাক্তন বিধায়ক), অনুব্রত মণ্ডল (তৃণমূল জেলা সভাপতি, বীরভূম) সহ অনেক নেতারাই এই প্রাইমারিতে চাকরি দিয়েছেন। তারপর তিনি একলাফে চলে গেলেন ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মফুলের মধু খেতে। আবার প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে আদালত নির্দেশ দিয়েছিল ১৯ জন মামলাকারীকে নিজের পকেট থেকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেওয়ার। সেটাও স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বন সহায়ক কর্মী নিয়োগ দুর্নীতিতে বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা গিয়েছিল একে অপরকে অভিযুক্ত করতে। তারপর নির্বাচন শেষ হলে সেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গা স্নান করে আবার মুখ্যমন্ত্রীর চরণতলে আশ্রয় উপায়। তারপর সব দুর্নীতিগ্রস্ত রায় ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যায় একসময়। অনেক দুর্নীতি অনেক প্রমান শুধু শাস্তির ক্ষেত্রে প্রহসন। সত্যি সত্যি খেলা হচ্ছে কিনা জানিনা। তবে বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়ে সবাই খেলা করছে। বেকার যুবক-যুবতীরা যেসব দুর্নীতি হাইকোর্টকে ধরিয়ে দিয়েছে, সেই সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্তরা যদি চুনোপুটি হয়ে থাকে তবে তারা ধনঞ্জয় হয়েছে। বাকিরা স্কুলে, অফিসে রমরমিয়ে তাদের স্ট্যাটাস দেখিয়ে চলেছে। আর এভাবে পথ চলতে চলতে কখনো রাস্তার আন্দোলন, কখনো হাইকোর্টের দরজায় দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে পাক ধরেছে তাদের চুলের। সরকারের নেতা-মন্ত্রী এবং আমলাদের দুর্নীতির পাপ ভোগ করতে হচ্ছে বেকারদের। কোর্টে গেলে উকিলদের পকেট ভরছে, আর কোর্টের বাইরে এলে নেতা-মন্ত্রী আর দালালদের পকেট ভরছে। ২০১৬ সাল থেকে এসএলএসটি’র হবু শিক্ষক শিক্ষিকা দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত হয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। মাথার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছয়টা বছর। ২০১৫ সালে সংঘটিত আপার প্রাইমারি প্যানেলের মধ্যে তীব্র অসঙ্গতি থাকায় আদালত নির্দেশ দিয়েছিলো তা সংশোধন করতে। কিন্তু নেতা-মন্ত্রীরা এত টাকা তুলে রেখেছিল যে চার চারবার সংশোধনের পরেও প্যানেলর স্বচ্ছতা আসেনি। আজও এই নিয়োগ সম্পন্ন হলো না। ফলে প্যানেলের মধ্যে থাকা যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা ২০১৫ থেকে ২০২২ দীর্ঘ সাত বছর ধরে স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গুমরে গুমড়ে মরছে।
এই হতাশা পশ্চিমবাংলার আমজনতা বুঝতে পারবে না। আমরা জানি এই যন্ত্রণা কতটা। দুর্নীতির অগ্নিকুন্ডে প্রতিনিয়ত পুড়ে ছাই হওয়া আমাদের ইতিহাস একদিন ধারালো অস্ত্রে পরিণত হবে। মাস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে একদিন শিক্ষিত বেকাররা মাস্টারদা সূর্য সেনে পরিণত হবে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আবার কোনো চট্টগ্রাম নতুন দিনের সূচনা করবে।
- মহঃ মেহবুব আলম, সভাপতি, প্রোগ্রেসিভ টিচার্স এ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল