বিজেপি’র হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিসন্ধি
 BJP's intention is to impose Hindi

বিজেপি সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবার উদ্দেশ্যপূর্ণ মন্তব্য করে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। সরকারের সংসদীয় ভাষা কমিটির সদস্যদের সম্বোধন করে, যার সভাপতি স্বয়ং তিনি, শাহ বলেন যে হিন্দি দেশের ‘ঐক্যের’ জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং তাই অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির সাথে যোগাযোগের ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে প্রতিস্থাপন করে হিন্দি আনা উচিত। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ৭০ শতাংশ যোগাযোগ এখন হিন্দিতে হয়।

সংস্কৃত করা হিন্দিকে সকলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার এই অভিসন্ধি আরএসএস-বিজেপি’র ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’এর বৃহত্তর মনুবাদী এজেন্ডার অংশ, যা মোদী সরকার ২০১৪ সাল থেকে চাপিয়ে দিতে শুরু করেছে। অথচ সারা ভারত জুড়ে বিরোধী দলগুলি এবং বিরোধী নেতৃত্বাধীন সরকারগুলি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার এই দুরভিসন্ধিকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, বিভিন্ন দপ্তর, কর্পোরেশন এবং ব্যাংকগুলিকে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে হিন্দিকে অগ্রাধিকার দিতে বলছে মোদী সরকার; বিজেপি নেতাদের হিন্দিতে বক্তৃতা দিতে বলছে; জাতিসংঘে হিন্দির ‘সরকারি মর্যাদা’ পাওয়ার চেষ্টা করছে। এসবের মাধ্যমে এমনটাই বোঝান হচ্ছে যে, হিন্দি ভারতের একমাত্র জাতীয় ভাষা। দক্ষিণের রাজ্যগুলির মহাসড়কের মাইলস্টোনগুলিতে হিন্দি দিয়ে ইংরেজিকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে এবং সারা ভারতের স্কুলগুলিতে বর্তমান দ্বি-ভাষা সূত্র সরিয়ে দিয়ে তিন-ভাষা চালু করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হচ্ছে। যদিও মোদী সরকারকে বারবার এই পদক্ষেপগুলি থেকে পিছু হটতে হয়েছে, তবু তারা সারা দেশের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের প্রচেষ্টার পুনরাবৃত্তি করার উপর জোর দেয় কারণ এটি আরএসএস’এর মূল এজেন্ডার অংশ।

এ’কথা অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত যে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ২২টি ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে এবং সংবিধানে ইংরেজি ও হিন্দি উভয়ই দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে সমান মর্যাদা ভোগ করে। হিন্দিকে সরকারি যোগাযোগের একমাত্র ও কার্যকর ভাষা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।

এটাও জোর দিয়ে বলা উচিত যে ‘হিন্দি’ আসলে চলতি হিন্দির একরকম সংস্কৃত সংস্করণ যা সরকারিভাবে ব্যবহৃত হয়। ‘হিন্দি’ মোটেই তথাকথিত ‘হিন্দি বলয়ের’ সাধারণ বুলি বা ‘মাতৃভাষা’ নয়। পরিবর্তে এক ধরণের ‘লিঙ্ক ভাষা’, ঠিক যেভাবে ইংরেজি দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে, বাংলায়, আসামে বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে লিঙ্ক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অলোক রাই বলেছেন, “হিন্দি বলয়ে হিন্দিতে ফেল করা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এই সত্যের মারাত্মক সাক্ষ্য দেয় যে ‘হিন্দি’ তাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিয়েছে”। উত্তরের এই রাজ্যগুলিতে, রাই যুক্তি দেন, “হিন্দি দরিদ্র মানুষের কাছে এক ধরণের ইংরেজিতে পরিণত হয়েছে”, অর্থাৎ ক্ষমতার এবং ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার ভাষা।

যে ভাষায় তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেই ভাষাতেই সমস্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাওয়া প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের অধিকার। বাস্তবে, কেন্দ্র হিন্দি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই নথিকরণ, ফর্ম, আইন ইত্যাদি তৈরি করে; এবং রাজ্য সরকারগুলি তখন এগুলিকে ইংরেজি থেকে রাজ্যে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট ভাষাগুলিতে অনুবাদ করে নেয়। জোর করে অ-হিন্দিভাষী জনতাকে হিন্দি গিলিয়ে দেওয়া বৈষম্যকে উৎসাহিত করে, একতাকে নয়।

একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে হবে যে, হিন্দি আধিপত্য এবং হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামে কেবল তামিলনাড়ু, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জনগণই অন্তর্ভুক্ত নন। বরং ভোজপুরি, মৈথিলি, মাগহি, আওয়াধি এবং উত্তরের রাজ্যগুলির আরও অনেক ভাষাভাষিরাও এই সংগ্রামে আছেন। এই চেতনা নিয়েই হিন্দি কবি ধুমিল ১৯৬৫ সালে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে লিখেছিলেন, “তোমার তামিল ব্যথা/ আমার ভোজপুরি ব্যথার ভাই”।

সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে ‘রাশিয়ান’কে বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে লেনিনের মন্তব্য মনে রাখা দরকার : “মানুষকে মেরেধরে স্বর্গে পাঠাতে চাই না আমরা। ‘সংস্কৃতি’ সম্পর্কে আপনি যতই সুললিত বাক্য উচ্চারণ করুন না কেন, বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা আসলে জোর জবরদস্তি, যারসাথে সবসময় জড়িত থাকবে ডান্ডার ব্যবহার”। গোটা দেশের উপর সংস্কৃত হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে বিজেপি’র একগুঁয়েমির পিছনে এই ‘জবরদস্তির উপাদান’ই আসল চালিকাশক্তি।

কেবল ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, খাদ্যাভ্যাস, বিশ্বাস, রাজনীতি এবং মতাদর্শের ক্ষেত্রেও বিজেপি ভারতীয়ত্ব ও একতাকে সমরূপতার সাথে একাকার করে দিতে চায়। ভারতের জনগণকে অবশ্যই ভারতের বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, বিশ্বাস এবং ভাবধারা রক্ষা করার জন্য লড়াই করতে হবে, বিজেপি’র ‘এক জাতি, এক ভাষা, এক বিশ্বাস, এক মতাদর্শের’ ফ্যাসিস্ট প্রকল্পের বিরোধিতা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই প্রতিটি শিশুর নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষিত হওয়ার অধিকার দাবি করতে হবে। দাবি তুলতে হবে যে, উত্তর ভারতের স্কুলগুলি ইংরেজি, তামিল, কন্নড়, মালায়ালাম, তেলুগু ও উর্দু সহ অন্যান্য ভাষাগুলিকে মাধ্যমিক ও উচ্চতর বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক ভাষা হিসাবে সুযোগ দেবে। এবং ইংরেজিকে হিন্দির চেয়ে ন্যূনতম খাটো না করে সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ এপ্রিল ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-16