দেউচা-পাঁচামী দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙার গ্রামবাসীরা খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, যে কোন মূল্যে এই প্রকল্পকে রুখতে চান তাঁরা। সরকারের উচিত মানুষের এই বার্তা শোনা এবং প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেওয়া। গত ১৩ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন। বীরভূম জমি-জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা এই বৈঠককে সদর্থকভাবে গ্রহণ করেছিল বিভিন্ন গ্রাম থেকে ৩১ জন প্রতিনিধি নবান্নে হাজির হয়েছিলেন যার মধ্যে ৯ জন বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী এই প্রকল্পের উজ্জ্বল দিকগুলি সবিস্তারে তুলে ধরে জানতে চেয়েছিলেন কেন গ্রামবাসীরা প্রকল্পটির বিরোধ করছে। মহাসভার প্রতিনিধিরা নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, গ্রামবাসীরা না চাইলে জোর করে কয়লাখনি করা হবে না। প্রতিনিধিরা দুটি আশু দাবি তুলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের ওপর থেকে মামলাগুলি প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং মহিলাদের ওপর পুলিশ ও টিএমসির হামলার বিচার। এবিষয়েও মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা মুখ্যমন্ত্রীর কথাকে সদর্থক ভাবে নিয়েছিলেন এবং তাঁরা প্রত্যাশা করেছিলেন যে মুখ্যমন্ত্রী এই বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে বিবৃতি দেবেন। এই প্রত্যাশা নিয়ে বৈঠক থেকে ফিরে গিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনার পর মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে মহাসভার পক্ষ থেকে ধরণা মঞ্চ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর তরফে কোনোরকম বিবৃতি আসেনি। উল্টে নবান্নের বৈঠক ও ধর্ণা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রকল্পের জয় তথা আন্দোলনের সমাপ্তি হিসেবে দেখিয়ে ব্যাপক প্রচার চালায় সংবাদ মাধ্যমের একাংশ। এই পরিস্থিতিতে মহাসভার নেতৃত্ব দ্রুত সাধারণ সভা ডেকে ১৬ এপ্রিল নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করে। ইতিমধ্যেই জানা যায় যে জেলাশাসক দেওয়ানগঞ্জে জনসভা করে জমিদাতাদের ক্ষতিপূরণের চেক ও চাকরির কাগজ বিলি করবেন। এই খবরে গ্রামবাসীরা প্রতারিত বোধ করেন। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তাঁরা। এবং শেষ পর্যন্ত ১৮ এপ্রিল ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে প্রশাসনকে কর্মসূচি বাতিল করে পালিয়ে আসতে হয়। গ্রামবাসীরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন যে, কয়লাখনি যে কোনও মূল্যে রুখে দিতে চান তাঁরা।
১৮ এপ্রিল দেওয়ানগঞ্জের মাঠে জেলাশাসকের সমাবেশ কর্মসূচিটি ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। এই কর্মসূচির মাধ্যমে রাজ্যবাসীকে বার্তা দিতে চাওয়া হচ্ছিল যে গ্রামবাসীরা জমি দিতে ইচ্ছুক। বিশাল আয়োজন করা হয়েছিল। বিশাল পুলিশ বাহিনীর সাথে বীরভূম জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে আদিবাসীদের আনা হয়েছিল অনেকগুলি বাসে ভর্তি করে। কিন্তু গ্রামবাসীরা এই ষড়যন্ত্রের রাস্তা আটকে দেয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ লাঠিঝাঁটা ও তীরধনুক নিয়ে পথ আটকে দাঁড়ায়। শান্তিপূর্ণভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, কোন রকম প্যাকেজ বা চাকরি নয়, প্রকল্প বাতিল করাই একমাত্র চাইছে গ্রামবাসীরা। জেলা শাসক ও পুলিশ বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে হয়। বাইরে থেকে যে আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে আনা হয়েছিল তারাও সত্যিটা জেনে যায়। অনেকেই গ্রামবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছে।
এই এলাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর মল্লারপুর। এখানে আছে রাজ্যের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘদিনের পুরনো “আদিবাসী কল্যাণ আশ্রম”, আদিবাসীদের মধ্যে হিন্দুত্বকরণের লক্ষ্যে আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। এই সূত্রে বিজেপি আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে বিভাজন ঘটাতে চাইছে। কিন্তু বিজেপি যে দেশ জুড়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করছে, অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এবং প্রতিবাদ করলেই মাওবাদী তকমা দিয়ে গণহত্যা চালাচ্ছে এ বিষয়েও এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। “বীরভূম জমি-জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা” গঠনের সময় গৃহীত রেজলিউশনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল এ বিষয়ক একটি নিষেধাজ্ঞা, যেখানে বলা হয়েছিল, যেসব দল ক্ষমতায় থেকে একইরকম কাজ করেছে বা করছে তাদের মহাসভায় আসতে দেওয়া হবে না। রাজ্যের বিজেপি দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দেওচার আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন বলে ঘোষণা করার পর তাই মহাসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বিজেপি নেতাদের কোনোভাবেই বরদাস্ত করবেন না তাঁরা।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জে মহাসভার পর থেকে অনেক প্রতিকুলতা মোকাবিলা করে লাগাতার ধর্ণা আন্দোলন চলেছে। নবান্নে বৈঠক ও দেওয়ানগঞ্জের প্রতিরোধের পর দেওচার আন্দোলন নতুন পর্বে প্রবেশ করল। সমস্ত বিভ্রান্তি পেরিয়ে আন্দোলনের শক্তি আরও বেড়েছে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে কমরেড পার্থ ঘোষ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে, পার্টি গ্রামবাসীদের আন্দোলনকে পূর্ণ সংহতি জানায় এবং এই বিপর্যয়কর প্রকল্প বাতিল করার জন্য পার্টি তার ঘোষিত অবস্থান থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।