কর্ণাটক হাইকোর্ট আজ তার আদেশে বলেছে যে হিজাব পরা ইসলাম ধর্ম পালনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়, কলেজ ডেভেলপমেন্ট কমিটির (সিডিসি) একটি ইউনিফর্ম বা নির্দিষ্ট পোশাক নির্ধারণ করার অধিকার আছে এবং মুসলিম মেয়েদের অবশ্যই তাদের কলেজের দ্বারা নির্ধারিত ইউনিফর্ম মেনে চলতে হবে।
১) আমরা, মহিলাদের অধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কাজ করা নিম্নস্বাক্ষরিত সংগঠনগুলি মনে করি যে সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। আমরা নিশ্চিত যে স্কুল বা কলেজ ইউনিফর্মের নামে হিজাব পরা মুসলিম মেয়ে এবং মহিলাদের প্রতি বৈষম্য এবং বঞ্চনা থেকে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রক্ষা করবে।
২) কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ে কলেজের সিডিসি’র ইউনিফর্ম সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ এই কর্ণাটকেই অনেক কলেজ তাদের বিধিতে সংযোজনী এনে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে ইউনিফর্মের সাথে হিজাব পরা যেতে পারে। একইভাবে আমরা কর্ণাটকের সমস্ত সিডিসি’র কাছে আবেদন জানাই মেয়েদের এবং মহিলাদের ইউনিফর্মের সাথে হিজাব পরার অনুমতি দেওয়া হোক ঠিক যেমন শিখ ছেলেরা এবং পুরুষরা পাগড়ি পরতে পারে এবং হিন্দুরা বিন্দি, তিলক, সুতো, সিঁদুর ইত্যাদি পরতে পারে।
৩) আমরা সিডিসি সমূহকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আদতে কর্ণাটকের কোনো কলেজেই হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার কোনো নিয়ম ছিল না; এমনকি একটি কলেজের নিয়মবিধিতে নির্দিষ্ট করে এও বলা ছিল যে ছাত্রীরা ইউনিফর্মের রঙের সাথে মিল রেখে হিজাব পরতে পারে। তাই হিজাব পরা মেয়েরা কোনোভাবেই নির্ধারিত ইউনিফর্ম বিধিকে ভঙ্গ করেনি। বস্তুত বেশ কিছু হিন্দু-আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীরাই কলেজগুলিতে অরাজকতা সৃষ্টি করে তাদের নিয়ম সংশোধন করিয়ে নির্দিষ্টভাবে হিজাব নিষিদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। কর্ণাটক হাইকোর্টের কাছে সুযোগ ছিল স্কুল, কলেজ এবং উভয় প্রতিষ্ঠানে চলা এই গুন্ডামি মোকাবিলা করার, কিন্তু কোর্ট তা করতে ব্যর্থ হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসা বা সংখ্যালঘু পরিচয়ের বহু মানুষ যাদের পোশাক হয়তো অন্যদের থেকে দেখতে আলাদা তাঁদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে।
৪) কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ের উপর অবিলম্বে স্থগিতাদেশ দেওয়ার জন্য আমরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করছি। এই রায় মুসলিম মেয়ে ও মহিলাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং শিক্ষার অধিকারের উপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে কর্ণাটক হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী রায়ের ফলে শুধুমাত্র মুসলিম ছাত্রীদেরকেই নয়, এমনকি মুসলিম মহিলা শিক্ষকদেরও স্কুল/কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই রায়কে অজুহাত করে ভিতরে ঢোকার শর্ত হিসেবে স্কুল/কলেজের গেটে প্রকাশ্যে মুসলিম মেয়েদের এবং মহিলাদেরকে হিজাব খুলিয়ে তাদের প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে। এই রায়ের ফলে হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীরা ক্লাস এমনকি পরীক্ষা মিস করতে বাধ্য হয়েছে; এবং কিছু মুসলিম মহিলা পোশাকের একটি অংশ খুলে ফেলতে বাধ্য করার অসম্মানের প্রতিবাদে শিক্ষক হিসাবে পদত্যাগ করেছেন। এছাড়াও, কর্ণাটক হাইকোর্টের আদেশটি সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষকে হিজাব পরিহিত ছাত্র এবং শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে উত্সাহিত করেছে। এমনকি হিজাব পরিহিত মহিলাদের বিভিন্ন পাবলিক স্পেসে হেনস্থা ও হয়রানির ঘটনা ঘটে চলছে — যেমনটি ঘটেছে বিহারের একটি ব্যাঙ্কে। তাই হিজাব পরা মুসলিম মেয়ে এবং মহিলাদেরকে আরও যে কোনও গুরুতর বৈষম্য, বঞ্চনা, প্রকাশ্যে অপমান এবং হয়রানির থেকে রক্ষা করার জন্য, আমরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করছি বিন্দুমাত্র সময় না নষ্ট করে অবিলম্বে কর্ণাটক হাইকোর্টের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করা হোক।
৫) কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ের যুক্তি বহু ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর এবং অসন্তোষজনক।
ক) রায়টি তার বেশিরভাগ সময় এই যুক্তিতে ব্যয় করেছে যে হিজাব (হেডস্কার্ফ) পরা ইসলামে একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুশীলন নয়। কিন্তু এটা যে মূল প্রশ্নের সমাধান করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা হল, হিজাব পরার কারণে কোনো মুসলিম মেয়ে বা মহিলাকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা কি বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক নয়?
খ) রায়টিতে ডক্টর আম্বেদকরের লেখার একটি অনুচ্ছেদ কীভাবে ‘বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথা’র ফলে মুসলিম মহিলাদের বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্বের মধ্যে পড়তে হয়, উদ্ধৃত করে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে হিজাব/বোরখা ইত্যাদি মুসলিম মেয়ে এবং মহিলাদের মুক্তি, জনসমক্ষে অংশগ্রহণ এবং শিক্ষার অধিকারের পথে বাধা হয়ে উঠতে পারে। এটি ডঃ আম্বেদকরের বক্তব্যের দিশা এবং উদ্দেশ্যের একটি মর্মান্তিক বিকৃতি। ডঃ আম্বেদকরের মন্তব্য পোশাকের কোনো অংশ সম্পর্কে ছিল না। ডঃ আম্বেদকর নির্দিষ্টভাবে বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন যা মেয়েদের এবং মহিলাদের প্রকাশ্যে বাইরে উপস্থিত হতে বাধা দেয়; এক প্রকার জোরপূর্বক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে তাদেরকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং ‘বাইরের জগতের কার্যকলাপ’ করতে বাধা দেয়। ডঃ আম্বেদকর কখনোই বলেননি যেমনটা হাইকোর্টের রায়ে বোঝানো হয়েছে যে, স্বেচ্ছায় হেডস্কার্ফ (হিজাব) পরা মুসলিম মেয়ে বা মহিলাদের শিক্ষার জগতে প্রবেশ করা থেকে বিরত করে রেখে তাকে বাড়ির ভিতরে বন্দীদশায় ফিরে যেতে বাধ্য করা হবে বা আলাদা মুসলিম স্কুল বা কলেজে পড়াশোনা করতে বাধ্য করা হবে!
গ) রায়টিতে ইন্ডিয়ান ইয়ং লইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন বনাম কেরালা রাজ্যের জাজমেন্ট (জনপ্রিয়ভাবে ‘শবরিমালা রায়’ নামে পরিচিত) উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে, সংবিধান প্রদত্ত ‘ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার’ সমস্ত ধর্মাচরণকে সুরক্ষিত করতে অপারগ; এবং তাই হিজাব পরার প্রচলনকে সুরক্ষিত করা সম্ভব নয়! মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে শবরিমালার রায়কে কীভাবে স্কুল বা কলেজে হিজাব পরা মেয়ে এবং মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে?
ঘ) রায়টিতে ইউনিফর্মের সাথে ‘ইউনিফর্মিটি’ (অভিন্নতা)-কে এক করে দেখানোর ভুল করা হয়েছে। ভারতবর্ষে স্কুল/কলেজের ইউনিফর্ম সর্বদা সামাজিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে আত্তীকৃত করে নিয়েই বাছা হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, শিখ ছেলে এবং মেয়েদের পাগড়ি পরতে দেওয়া। এই বৈচিত্র্য যা পাগড়ি বা হিজাবকে অঙ্গাঙ্গী করে নেয় তা কখনই ইউনিফর্মের সাথে বিরোধপূর্ণ নয়। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ‘অভিন্নতা’ কখনই ভারতীয় স্কুল এবং কলেজগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল না। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে ‘MEC EDUCATION: KWAZULU-NATAL’ রায় যা দক্ষিণ আফ্রিকার একটি স্কুলের একজন হিন্দু মেয়েকে তার ইউনিফর্মের সাথে নাকের নথ পরার অনুমতি দেওয়ার অস্বীকৃতিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। বলা হয় এই কেসটি হিজাবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না যেহেতু নাকের নথ ‘নজরে পরার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নগণ্য’! একটি আদালতের নৈতিক এবং সাংবিধানিক যুক্তিগুলি এই ধরনের বিষয়গত পক্ষপাতের উপর কখনই নির্ভর করা উচিত নয় যেখানে একটি হিন্দু মেয়ের নাকের নথ নজরে বিরক্তির উদ্রেক করে না, কিন্তু একটি মুসলিম মেয়ের মাথার স্কার্ফ তা করে!
ঙ) যেমনটি আমরা উল্লেখ করেছি, কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ে নারীদের বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন করা প্রসঙ্গে আম্বেদকরের উদ্বেগকে ঐচ্ছিকভাবে মেয়েদের হিজাব পরিধানের উপরে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এটা প্রকারান্তরে বলতে চাওয়া হয়েছে যে হিজাব পরার আচার মেয়েদের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং তাই স্কুল ও কলেজে এটা অনুমোদন করা উচিত নয়। রায়টি মহিলাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের উপর জোরপূর্বক ধর্মীয় বিধি আরোপ করা ও মহিলাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে কিছু বিধি বেছে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি; এবং বস্তুত এই রায় নারীর স্বাধীকার এবং সম্মতির ধারণাটিই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। রায় প্রদানের ক্ষেত্রে শবরীমালা রায়’এর উদাহরণে এই বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে দেয়। মহিলারা শবরীমালায় প্রবেশের অধিকারের জন্য আদালতে আবেদন করেছিলেন কারণ মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা তাদের অধিকার ও সমতার দাবিকে খর্ব করছিল। মন্দির কর্তৃপক্ষের ‘ধর্মীয় রীতি পালনের স্বাধীনতা’র দোহাই দিয়ে নারীদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে আদালত কোনোভাবেই শবরীমালায় প্রবেশ করা উচিত নয় বলে বিশ্বাস করেন এমন মহিলাদেরকে ‘মুক্তি’র নামে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধ্য করেনি। একইভাবে ‘মুক্তি’র নাম করে হিজাব পরা মেয়ে বা নারীদের স্কুল বা কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া এক অতিব জঘন্য বিষয়। নারীমুক্তি মহিলাদের স্বাধীকারকে সম্মান করার মধ্যে নিহিত আছে, ধর্ম বা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তাদের ওপর জোরপূর্বক বিধি চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে নয়।
হিজাব পরিহিত সকল মুসলিম শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, মর্যাদা এবং স্বাধীকারের লড়াইয়ে সাথে আমাদের পূর্ণ সংহতি আছে।
স্বাক্ষর করেছেন,
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি — ডাঃ রতি রাও, মীনা তেওয়ারি, কবিতা কৃষ্ণান।
সহেলি, উওমেন্স রিসোর্স সেন্টার — শতনাম কৌর, সবিতা শর্মা, অসীমা রায় চৌধুরী।
ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উওমেন — অ্যানি রাজা, রুশদা সিদ্দিকি।
প্রগতিশীল মহিলা সংগঠন — পুনম কৌশিক।
পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস — লারা জেসানি, কবিতা শ্রীবাস্তব, সীমা আজাদ, শালিনী গেরা।
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্টস — অরুন্ধতী ধুরু, মীরা সঙ্ঘমিত্রা।
উওমেন এগেইন্সট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যান্ড স্টেট রিপ্রেশন — নিশা বিশ্বাস।
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি — মারিয়ম ধাওয়ালে, মৈমুনা মোল্লা।
ফোরাম এগেইন্সট অপ্রেশন অফ উওমেন — আম্মু, অমৃতা, চয়নিকা, স্বাতিজা।
ফেমিনিস্টস ইন রেজিস্টেন্স — পৌষালি বসাক।
বেবাক কালেক্টিভ — হাসিনা খান।
নভশরন সিং, স্মিতা গুপ্তা, কানিজ ফাথিমা, ফারহা নাকভি, বানি সুব্রাহ্মনিয়ম, মানসী আশার, অনুরাধা ব্যানার্জি।