বিগত অর্থবর্ষ শেষের সাথে সাথে ভারতবর্ষ বিগত সাত দশকের মধ্যে সবথেকে করুণতম অর্থনৈতিক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ আশা করেছিলেন চলতি অর্থবর্ষ অর্থাৎ মার্চ ২০২২’র মধ্যে দেশ এই বিপর্যয়কর মন্দা থেকে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতেও পারে, হয়তো গড়ে বার্ষিক ৮-৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে পারে সদর্থকতা। এমনকি সদ্য পেশ হওয়া কেন্দ্রীয় অর্থবাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী (যিনি পেঁয়াজ খান না, তাই পেঁয়াজের দাম বাড়লে তার অসুবিধা নেই) এমনও বিজ্ঞাপন দিয়েছেন যে ভারতের বৃদ্ধির হার ৯.২ শতাংশ! কিন্তু কই, এহেন বিজ্ঞাপনে গবেষকরা তো বটেই, ভারতের মুটে-মজুর, খেটে খাওয়া মানুষের দল তো স্বস্তির অবকাশ পেলেন না। নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না, শ্রম বাজারের সবথেকে বঞ্ছিত ও লাঞ্ছিত, মহিলা শ্রমিকরা, জটিল অঙ্কের আড়ালে তাদের জীবনের নাগরিক অধিকার ও উন্নয়ন সূচকতার অবনমন আরও পিছনের সারির ইস্যু হয়ে দাঁড়াল। উল্লেখ্য, গতবছরেই কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যোগদানের হার নেমে গেছিল ১৬.১ শতাংশে এবং এখনও তার কোনও উত্তরণ ঘটেনি।
বিশ্ব শ্রম সংস্থার সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, কোভিডের দরুন ২০১৯’র পরে যে কর্মহীনতা, বেতনহীনতা ইত্যাদি ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা পুরুষ শ্রমিকরা হয়তো ভবিষ্যতে কখনও না কখনও পুষিয়ে নিতে পারবেন, কিন্তু যে ঘাটতি মহিলাদের এমনকি শ্রমিকের অধিকারের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে তা কবে মিটবে বা আদৌ মিটবে কিনা তা জোর দিয়ে বলা যায় না। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে কর্মক্ষম মহিলাদের মাত্র ৪৮ শতাংশ কোনরকম কাজে যুক্ত রয়েছেন। যদিও এই ধরনের আন্তর্জাতিক হিসাবগুলিতে শুধুমাত্র যে কোনোরকম বেতনভুক কর্মচারীদের কথাই বলা হয়। ভারতবর্ষে গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ মহিলাদের ক্ষেত্রেই বিনা বেতনের কর্মী বা সাহায্যকারী হিসাবে কাজের একটা রেওয়াজ আছে, টাকার বদলে খাওয়া, বাচ্চাদের জন্য উপহার, চাল ইত্যাদি নানারকম বন্দোবস্ত। অবশ্য পরে সরকার প্রণীত নানারকমের প্রকল্পে এদের ঠিকাশ্রমিক হিসাবে কর্মনিযুক্তি হয়েছে। সেখানেও বেতন ও মাসোহারা অত্যন্ত কম, তাই লড়ছেন আশা ও অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা, লড়ছেন ঠিকা শ্রমিকরা বছরে ২০০ দিনের কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে। মহিলাদের সাথে সাথে পুরুষরাও সরকারি কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে নিযুক্ত হয়ে থাকেন, কিন্তু সেইসব বেশিরভাগ কায়িক পরিশ্রমে খাটনির তুলনায় রোজগার কম হওয়ায় পুরুষেরা দূর জায়গায় কাজে চলে যাচ্ছেন। ঘর গেরস্থালীর দায়িত্ব তখন আরও বেশি করে চেপে বসছে মহিলাদের উপর, তখন মহিলারা বাইরের কাজের থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন। ভারতে এমন মহিলাদের অংশ মোট শ্রমিক গোষ্ঠীর প্রায় ৪১ শতাংশ।
কাজ হারানোর লিস্টে মেয়েদের নামই বেশি, কর্মী ছাঁটাই করে মুনাফা বজায় রাখতে চাওয়া কর্মনিয়োগকারীর কাছে সহজ ও অগ্রাধিকার অপশন হিসাবে নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদ মহিলাদেরকেই নিশানা করছে। কারণ আজকের পুঁজিবাদ চায় মহিলারা বাইরে নয়, বিনা বেতনের গৃহকর্ম করুক, আর নানা ক্ষেত্রে মহিলাদের যা কিছু টোকেন রিপ্রেজেন্টেশন থাকবে তা হবে পুঁজিবাদেরই পরিচালিত। এমনকি মহিলাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো পর্যন্ত এই পর্বে মহিলা কর্মচারীদের ছাঁটাই করেছে, তাদের ছুটির দিনে কাজ করতে বাধ্য করেছে। কাজেই, কোভিড জনিত দুরাবস্থা মহিলা শ্রমিকদের আগে থেকেই অবনমন হতে থাকা অবস্থানকে আরও তীব্র গতিতে আরও অনেক গভীরে অবনমিত করে চলছে। তবুও মহিলারা লড়ছেন ন্যূনতম মজুরি সহ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ঋতুকালীন ছুটি, কর্মস্থলে শিশুকে স্তন্যপান করার অধিকার চেয়ে, কর্মস্থলে যৌনহেনস্থার প্রতিকার চেয়ে, সমকাজে সম-মজুরির দাবিতে।
- সংগ্রাম মন্ডল