গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি সোশাল মিডিয়া গ্রুপ থেকে দলের সাথীদের সঙ্গে নিয়ে বীরভূমে প্রস্তাবিত কয়লাখনি এলাকার চারটি গ্রাম দেওয়ানগঞ্জ, হরিনসিঙ্গা, কেন্দ্রপাহাড়ি ও সগেলেতে বাস্তব পরিস্থিতি দেখা, জানা ও পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। প্রথমেই বলে রাখি ওখানের সিংহভাগ বাসিন্দা সাঁওতাল আদিবাসী ও কিছু মুসলিম। তাঁরা কিন্তু কেউ কয়লাখনি চান না। চারটি গ্রাম ঘুরে কোনো কয়লাখনি সমর্থককে আমরা খুঁজে পাইনি। সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম তারা সরকারি প্যাকেজে খুশি কিনা, বা এলাকায় কয়লা খনি চান কিনা। তাঁরা কিন্তু কেউ কয়লা খনি চান না, এবং শুধু প্যাকেজ কেন, কোনো কিছুর বিনিময়েই তাঁরা নিজেদের বাড়ি ঘর, ভিটা মাটি ছাড়তে রাজি নন। তাঁরা এমনও জানিয়েছেন যে দরকারে তাঁরা জীবন দেবেন তবুও গ্রামের মাটি, চাষ জমি ছাড়বেন না। এবং অবশ্যই উনারা পুরো আদিবাসী সমাজ, সাঁওতাল সমাজ ও আদিবাসীপ্রেমী, মানবপ্রেমী সহৃদয় ব্যক্তিদের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে।
খুবই অবাক হয়েছিলাম ওখানে চারদিকে চাষজমি দেখে। জিজ্ঞাসা করছিলাম যে খবরে বেরিয়েছে এখানে চাষবাস হয় না, কিন্তু আমরা তো দেখছি চারদিকে চাষজমি? উনারা খুব অবাক হয়ে বলেছেন যে উনারা যা বলেন, বা ওখানের যা বাস্তব পরিস্থিতি সেগুলো মিডিয়া দেখাচ্ছে না! অনেক মিডিয়া নাকি উনাদের গ্রামে গেছে কিন্তু বাস্তব ও সঠিক খবর বাইরে আসেনি! এই কারণে কিছু গ্রামে আমরা অপ্রত্যাশিত কিছু অভিযোগের শিকার হয়েছি যে আমরাও হয়তো সত্য প্রকাশ করবো না। কিন্তু আমরা কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রেখেছি। যা সত্য তাই আমাদের সোশাল মিডিয়া গ্রুপের মাধ্যমে দেখিয়েছি, যা আমাদের দর্শকরা ইতিমধ্যে দেখেছেন।
আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে বলতে চাই যে ওখানে শুধু চাষবাসই হয় বলবো না, খুব ভালো চাষবাস হয়। উনারা বেশিরভাগ পরিবারই দুবার চাষ করেন। ধান ছাড়াও অন্যান্য শস্য দানা, সর্ষে চাষ হয় যা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি এবং যে কেউ এই এলাকায় গিয়ে দেখে আসতে পারেন। এত সুন্দর আদিবাসী গ্রাম, এত ভালো ও শান্তিপ্রিয় মানুষদের জীবন এইভাবে কয়লাখনির নামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ভাবতেও পারছি না। কি সুন্দর সব ঘরবাড়ি বানিয়ে আদিবাসীরা শত বছর ধরে বসবাস করছেন, উনাদের গ্রাম ও উনাদের দেখেও ভালো লাগে। চাষজমি, বাগান, গবাদিপশু, ধর্মীয় জাহের থান, মাঝিথান ও পরস্পরের সাথে সুন্দর ও হার্দিক সম্পর্ক নিয়ে, এবং সর্বোপরি শতাব্দী প্রাচীন সামাজিক মাঝিআরি নিয়ে জীবন যাপন করছেন ওখানের মানুষজন, কোন অপরাধে নিজেদের শান্তির বাসা ছাড়বেন, এটা এই অধম প্রতিবেদকেরও প্রশ্ন?
আমরা ওখানের বাসিন্দাদের সাথে যখন কথা বলেছিলাম, উনাদের চোখ ছল হতে দেখেছি। কিন্তু এরসাথে মনে জোর, চোখে আগুনও লক্ষ্য করেছি। উনারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে কোনোভাবে নিজের গ্রাম ছেড়ে যাবেন না, কোনোভাবেই না। উনাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, তাই এই মুহূর্তে আন্দোলন ছাড়া উনাদের উপায় নেই। উনাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম যে সরকার তো বলছে এখানে কয়লাখনি করবেন, যদি কয়লাখনি হয় কি করবেন? উনারা বলেছেন উনারা যেভাবেই হোক আটকাবেন এবং কোনোভাবেই খনি হতে দেবেন না।
আর একটি কথা না বলে পারছি না যে একটি গ্রামে কিছুদিন আগে শাসক দলের কয়লাখনি সমর্থনে মিছিলে গ্রামের মহিলারা বাধা দেওয়ায় তাঁদের মারধর করার অভিযোগ যে মিথ্যা নয় সেটাই উনারা বলেছেন। এবং উনাদের বিরুদ্ধে নেশা খেয়ে মাতলামি করার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা সেটা উনারা আমাদের জানিয়েছেন।
আর একটি কথা না বলে পারছিনা যে ওখানের কিছু গ্রামে আমরা মাঝি বাবাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে ওই এলাকার একসময়ের আদিবাসী গাঁওতার আদিবাসী দরদি নেতা সুনীল সরেন ও রবিন সরেন ওখানে একাধারে ভগবান ও সুপ্রীমকোর্ট! কিছু মাঝিবাবা খনি বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামবাসীদের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করলেও সরেন শাসনের চোখ রাঙানিতে সেই কাজও অসমাপ্ত থেকে গেছে। উনাদের অনুমতি ছাড়া নাকি ওখানের গাছের পাতাও নড়ে না! ওই এলাকা ও পার্শবর্তী গ্রামের মাঝি বাবারা এবং অনেক ব্যক্তি নিজেদের নাম ও পরিচয় দিতে ভয় পেয়েছেন। এবং নাম বললেও প্রকাশ করতে বারণ করেছেন। ওই এলাকার আদিবাসী ও মুসলিমরা কোন পরিস্থিতিতে আছেন নিশ্চয় পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন। অসহায় আদিবাসীদের এক সঙ্গীন মুহূর্তে বীরভূমের কয়লাখনি এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
- রাজীব বাস্কে, ঝাড়গ্রাম
(২০ ফেব্রুয়ারি বীরভূম জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার ডাকে দেওয়ানগঞ্জে প্রতিবাদী সমাবেশ সংগঠিত হওয়ার পর গ্রামবাসীদের ওপর যে পুলিশ-শাসকদল যৌথ বাহিনীর সন্ত্রাস নামে সেই প্রেক্ষিতে প্রতিবেদকের দেওয়া ফেসবুক পোস্ট থেকে প্রতিবেদনটি সংগৃহীত)