৭ মার্চ সকালে বেশ কয়েক শত গ্রামবাসী মিছিল করে দেওয়ানগঞ্জে বনবিভাগের জমিতে নেমে নিজেদের অধিকার জাহির করেন। সমবেত হয়ে ঘোষণা করে জমিতে খুঁটি পুঁতে চড়কা দেওয়া হয়। আদিবাসী সমাজের সামাজিক-প্রশাসনিক প্রথা অনুসারে কোনও জমিতে চড়কা দিলে সে জমিতে নতুন করে কেউ কোনও কাজ করতে পারবে না। দেওয়ানগঞ্জের সরকারি জমিতে গ্রামবাসীদের চড়কা দেওয়া প্রকৃতপক্ষে গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে এক নতুন ঘোষণা, সরকার যদি ‘সরকারের হাতে থাকা’ জমিতে খনির কাজে নামে তাহলে গ্রামবাসীরাও সমবেতভাবে জমিতে নেমে প্রত্যক্ষভাবে বাধা দেবে। বারোমেসিয়া গ্রামের ধরণাস্থল থেকে মিছিল করে এসে সরকারি জমিতে চড়কা দিয়ে সরকারকে এই বার্তা দিল গ্রামবাসীরা।
২০ ফেব্রুয়ারির মহাসভা সমগ্র এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করায় পরদিন মুখ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে দেউচা প্রকল্প সম্পর্কে কিছু ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমত, পুনর্বাসন প্যাকেজে জমির দাম বা ঘরের সাইজ একটু বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা করেন তিনি। এবং একথা উল্লেখ করেন যে, সরকারের হাতে যে জমি আছে সেখানেই প্রথম খনির কাজ শুরু হবে, সেখানে তো আর কারও সম্মতির প্রয়োজন নেই। মুখ্যমন্ত্রীর এই দুটি ঘোষণাকেই কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে প্রশ্নটা নিছক প্যাকেজের কমবেশির নয়। কোনওরকম প্যাকেজই তাঁদের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না, কোনওরকম প্যাকেজের বিনিময়েই মানুষ নিজেদের জমি জায়গা ছেড়ে, ভিটেমাটি ও সমাজ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে চাইছেন না। তড়িঘড়ি নবান্নে ডেকে দু’চারজনকে চেক দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছুক চাষির কুমির ছানা দেখিয়েছেন মাত্র। ওইদিন জেলা দপ্তরে যারা এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই আসলে খাস জমিতে বসবাসকারি মানুষ যারা জমির পাট্টা নিতে এসেছিলেন। সিঙ্গুরের মতো এখানেও অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ডদের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের জমি দখল করতে চাইছে সরকার। গ্রামবাসীদের সিংহভাগই প্রতিরোধে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি কোনও পরিবারের একজন যদি চাকরির ফর্মে সই করে থাকে তাহলেও পরিবারের বাকি সদস্যরা, বিশেষত মহিলা সদস্যরা, প্রতিরোধে সামিল। দ্বিতীয়ত, নিজেদের জমি দেওয়া তো পরের কথা, সরকারি জমিতেও খনি করার অনুমতি যে তাঁরা দিচ্ছেন না, তা সরকারি জমিতে চড়কা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন গ্রামবাসীরা।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সংবাদ সম্মেলনে তৃতীয় একটি কথা বলেছিলেন। তিনি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলেন যে, দেউচা-পাঁচামীর অবৈধ পাথর খাদান মালিকরা মদত যোগাচ্ছে আন্দোলনকারীদের। এভাবে তিনি আন্দোলনকারীদের গায়ে কাদা ছুঁড়তে চেষ্টা করেন। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি যখন মুখ্যমন্ত্রী এই প্রেস কনফারেন্স করছেন তখন গ্রামবাসীদের মিছিল এলাকার খাদান ও ক্রাশারগুলি বন্ধ করতে করতে এগোচ্ছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জ ফুটবল ময়দানে মহাসভা সংগঠিত হওয়ার পর থেকে মিটিং মিছিল সমাবেশ এক দিনও বন্ধ থাকেনি। প্রতিদিন সকালে আরও বেশি বেশি মানুষ ভয় কাটিয়ে প্রতিবাদে সামিল হতে থাকে। ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার ধরণা শুরু হয়, প্রথম দু’দিন হরিণসিঙায় চলার পর ধরণা বারোমেসিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ৭ মার্চ পর্যন্ত এলাকার সমস্ত খাদান ও ক্রাশার বন্ধ ছিল। এক দশক আগে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিকে মান্যতা দেওয়ার দাবিতে খাদান-ক্রাশার মালিকদের বিরুদ্ধে এক লম্বা ‘আইন মানো’ আন্দোলন করেছিলেন এলাকার মানুষ। কিছু কিছু দাবি আদায় হয়েছিল। গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মেনে সরকার বীরভূমের মোট খাদান ও ক্রাশারের ৫% ইউনিটকে বৈধতার সার্টিফিকেট দেয়, যদিও সেই তালিকা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। বর্তমানে এই স্টোন চিপসের কারবারে সুব্যবস্থিত মাফিয়া চক্র গড়ে উঠেছে যার ফুট সোলজার হিসেবে আদিবাসী যুবকদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করত নিজেদের বিকিয়ে দেওয়া কয়েকজন আদিবাসী নেতা। পাথর পরিবহনে নিযুক্ত প্রতিটা ট্রাক দৈনিক ৬ হাজার টাকা তোলা দেয় এই চক্রকে। রীতিমতো রসিদ কেটে এই টাকা তোলা হয়। বীরভূমের সমগ্র পাথর বেল্টে দৈনিক অন্তত ৫ হাজার ট্রাক এরকম পরিবহনে নিযুক্ত। গ্রামবাসীরা খাদান-ক্রাশার বন্ধ রাখার মাধ্যমে নিজেদের এলাকায় এই মাফিয়া চক্রকে ভাঙতে চেয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জে মহাসভার মাধ্যমে গ্রামবাসীদের যে উত্থান ঘটে তা সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।