কর্পোরেট সংস্থার হাতে ব্যাঙ্ক অর্থের বৃহত্তম জালিয়াতি
bank money in the hands of corporate entities

কর ফাঁকি দিয়ে অপরিমেয় কালো টাকার অধিকারে ভারতীয় কর্পোরেটদের প্রভাবশালী অংশ যেমন পারদর্শী হয়েছে, সেরকমই ঋণের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক অর্থের আত্মসাতেও তারা তাদের মুন্সিয়ানার পরিচয় কম দেয়নি। ঋণ পরিশোধে কর্পোরেটদের একাংশের অনাগ্ৰহ যেমন ব্যাঙ্কের ‘এনপিএ’ বা অনুৎপাদক সম্পদকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে, ঋণ নিয়ে তার আত্মসাতে উন্মুখ কর্পোরেটদের সংখ্যাটাকেও আবার কমতে দেখা যাচ্ছে না। বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সিরা কিভাবে ব্যাঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে সে সমস্ত আখ্যান আমাদের অজানা নয়। এখন আবার সেই তালিকায় আর একটা সংযোজন ঘটল, উন্মোচিত হল সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির আখ্যান। এবারের কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে রয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেদের রাজ্য গুজরাতের জাহাজ নির্মাণ সংস্থা এবিজি শিপইয়ার্ড কোম্পানি, গুজরাতের সুরাত ও দহেজ থেকে তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালাত। নয়-নয় করে ২৮টা ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তারা নিয়েছিল ২২,৮৪২ কোটি টাকার ঋণ, তার পুরোটাই অপরিশোধিত থেকেছে। এই সমস্ত কীর্তিকলাপে যারা মাতে তাদের প্রায় সবাইকেই শাসক শিরোমণিদের ঘনিষ্ঠ বলে দেখা যায়। আলোচ্য কেলেঙ্কারির নায়ক এবিজি শিপইয়ার্ডের প্রধান ঋষি কমলেশ আগরওয়ালও মোদী ঘনিষ্ঠ বলে কানাঘুষো আওয়াজ উঠেছে।

ঋষি কমলেশ আগরওয়ালের এবিজি শিপইয়ার্ড ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ পেয়েছিল এরকম, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক ৭,০৮৯ কোটি; আইডিবিআই ব্যাঙ্ক ৩,৬৩৯ কোটি; এসবিআই ২,৯২৫ কোটি; ব্যাঙ্ক অফ বরোদা ১,৬১৪ কোটি; পিএনবি ১,২৪৪ কোটি; এবং অন্যান্য (যারমধ্যে এলআইসি’ও রয়েছে) ৬,৩৩১ কোটি। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক দরাজ হস্তে যাদের এত ঋণ দিয়ে দেয়, তাদের রাজনৈতিক সংযোগ যে যথেষ্ট শক্তিশালী তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। এবিজি শিপইয়ার্ড ঋণের জন্য আবেদন জানালে তা জাহাজ ও জাহাজের যন্ত্রাংশ নির্মাণেই ব্যয়িত হওয়ার কথা। কিন্তু সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা অন্তত ৯৮টা সহযোগী সংস্থা খুলে সেগুলোতে প্রাপ্ত ঋণের অর্থ সরিয়ে নেয়। সহযোগী কোম্পানিগুলো থেকে টাকা আবার পাচার হয় বিদেশে, সেখানে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনা হয় এবং ঋণের টাকাকে অন্যান্য আর্থিক কর্মকাণ্ডে লাগানো হয়। নির্মাণ কাজে লাগানোর জন্য যে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেই বিপুল পরিমাণ টাকা এইভাবে তছরুপ করা হল, নির্মাণ ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে লাগানো হল, তহবিলের চরম অপব্যবহার ঘটল। কোম্পানির কার্যকলাপ দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে — অনেকে আবেদন করে ঋণ না পেলেও এবিজি শিপইয়ার্ডের ক্ষেত্রে ঋণপ্রাপ্তি এত অনায়াস হলো কিভাবে? প্রদত্ত ঋণ ঠিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তার যাচাই করাটা কি ঋণদাতাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? যে ২৮টা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋষি কমলেশ আগরওয়াল ও কোম্পানির অন্যান্য পরিচালকরা নির্মাণ কাজের জন্য ঋণ নিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটাও কেন প্রদত্ত অর্থের ব্যয় যথার্থ পথে হচ্ছে কিনা এবং ব্যাঙ্কও প্রতারণার শিকার হচ্ছে কিনা তার পরখ করতে সক্রিয় হলো না? রাজনৈতিক প্রভাবই কি সেই লক্ষ্যে প্রতিবন্ধক হয়েছিল? তদন্ত শুরু হতেই বা বিলম্ব ঘটল কেন?

তদন্তের শুরুতে বিলম্ব হয়েছে কিনা তার বিচার করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এসবিআই প্রথম অভিযোগ সিবিআই’এর কাছে দায়ের করে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের গোড়ায়, আর সিবিআই তার পরিপ্রেক্ষিতে এফআইআর প্রক্রিয়া শুরু করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ায়। এবং তারপর ১২ ফেব্রুয়ারি গুজরাত, মহারাষ্ট্র সহ কয়েকটা রাজ্যের ১৩টা স্থানে সিবিআই তল্লাশি চালায় ও কিছু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে। কয়েকদিন আগের ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন জানিয়েছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সিবিআই ঋষি কমলেশ আগরওয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং অন্য অভিযুক্ত পরিচালকদের সন্ধান তারা পেয়েছে। তাহলে ঋষি কমলেশ আগরওয়ালের দেখা পেলেও সিবিআই তার গ্ৰেপ্তারিকে এড়িয়ে গেছে। এসবিআই’এর অভিযোগ দায়ের এবং সিবিআই’এর পদক্ষেপের মাঝে দু’বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়াটা তো তদন্তের আন্তরিকতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে। এসবিআই’এর প্রথম অভিযোগ দায়েরের পর সিবিআই’এর কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া এবং আরো ন’মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর এসবিআই’এর দ্বিতীয় অভিযোগ দায়ের — কালক্ষেপণের উদ্দেশ্যেই কি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল? সিবিআই’এর কাছে এসবিআই’এর দায়ের করা অভিযোগের একটা অংশও যথেষ্ট কৌতূহলের উদ্রেক করে। অভিযোগপত্রে এসবিআই উল্লেখ করেছে যে, “বিশ্ব জোড়া সংকট জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এইদিক থেকে প্রভাব ফেলে যে, পণ্যের চাহিদা এবং মূল্যে হ্রাস ঘটে এবং পরবর্তীতে পণ্য পরিবহণের চাহিদারও অবনমন ঘটে। কিছু জাহাজ এবং জলযানের বরাত বাতিল হওয়ার ফলে নির্মিত পণ্য জমে যায়। ফলস্বরূপ সক্রিয় পুঁজির ঘাটতি দেখা দেয় এবং ক্রিয়াশীল চক্রের বৃদ্ধি ঘটে, যারফলে নগদের ও আর্থিক সমস্যা তীব্রতর হয়ে ওঠে।” সম্পূর্ণরূপে প্রতারক ও জালিয়াত একটা কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়বস্তু হিসাবে জাহাজ শিল্পে সংকটের এই উল্লেখ অভিপ্রেত উদ্দেশ্যকে, কোম্পানির অনাচারের বিরুদ্ধে যথার্থ পদক্ষেপ গ্ৰহণকে কিভাবে সহায়তা করতে পারে? কোম্পানির আর্থিক প্রতিকূলতার জন্যই তাকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল — এই অজুহাতই কি এসবিআই সমস্ত ব্যাঙ্কের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে? প্রতারক কোম্পানিকে বাছবিচারহীনভাবে যথেচ্ছ ঋণদানের ভ্রষ্টাচার থেকে নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই কি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের জাহাজ শিল্পে সংকটের ব্যাখ্যার এই অবতারণা?

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ বলেছেন, ব্যাঙ্ক অর্থের প্রতারণার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্ৰহণে, অর্থাৎ, অভিযোগ দায়ের করতে ৫২ থেকে ৫৬ সপ্তাহ লেগে যায়। তিনি আরও বলেছেন, ইউপিএ জমানাতেই, ২০১৩ সালেই নাকি এবিজি শিপইয়ার্ডের নেওয়া ঋণ অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হয়েছিল। বিলম্বে ব্যবস্থা গ্ৰহণের অভিযোগকে খণ্ডনের উদ্দেশ্যে এই মন্তব্য করা হলেও এই অভিযোগকে পুরোপুরি খারিজ করা যাবে? ঋণ ইউপিএ আমলে ২০১৪’র আগে দেওয়া হলেও এবং ২০১৩ সালের নভেম্বরে এনপিএ’র পরিচায়ক হয়ে উঠলেও আর্ণেস্ট ও ইয়ং’এর ফরেনসিক অডিট রিপোর্ট জানিয়েছে, জালিয়াতি সংঘটিত হয় ২০১২ থেকে ২০১৭’র মধ্যে (অর্থাৎ, কিছুটা মোদী জানাতেই) এবং প্রদত্ত ঋণ এনপিএ বলে ঘোষিত হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ঋণ অপরিশোধিত থাকায় কোম্পানির বিরুদ্ধে লিকুইডেশন প্রক্রিয়া (কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণার মাধ্যমে তার সম্পদ বিক্রি করে যতটা সম্ভব ঋণ পরিশোধ) শুরু হয় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। এরপরও কোম্পানির ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করে সিবিআই’এর পদক্ষেপ গ্ৰহণে পাঁচবছর লেগে যাওয়ার কোনো যুক্তিগ্ৰাহ্য ব্যাখ্যা কী থাকতে পারে? ঋষি আগরওয়ালের সঙ্গে মোদীর ঘনিষ্ঠতার কথা ওঠাতেও নির্মলার আসরে নামা। কিন্তু কংগ্ৰেস এই অভিযোগ তুলেছে যে, নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০০৭ সালে এবিজি শিপইয়ার্ডকে ১,২১,০০০ বর্গমিটার জমি দিয়েছিলেন এবং সেই জমির বাজার দর বর্গমিটার প্রতি ১,৪০০ টাকা হলেও মোদী সরকার জমি দিয়েছিলেন প্রতি বর্গমিটার ৭০০ টাকা দরে, যার জন্য ক্যাগ তাদের রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় তহবিলের ক্ষতির বিনিময়ে ঋষি আগরওয়ালের কোম্পানিকে পক্ষপাতিত্ব দেখানো নিয়ে মন্তব্য করেছিল; ঋষি আগরওয়াল মোদীর ভাইব্র্যান্ট গুজরাত অনুষ্ঠানে নিয়মিত যোগ দিতেন এবং মোদী তাঁকে ২০১৩ সালে (যে বছর ঋষি আগরওয়ালদের নেওয়া ঋণ এনপিএ হয়ে গিয়েছিল বলে সীতারামণ বলেছেন) দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে যান। এই তথ্যকে অসত্য ঘোষণা করে নির্মলা সীতারামণ তাকে কি অস্বীকার করতে পারবেন? অতএব, কোম্পানির মাথার সঙ্গে মোদীর ঘনিষ্ঠতার জন্যই ব্যবস্থা গ্ৰহণে বিলম্বের অভিযোগকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না।

শাসক-ব্যবসায়ী ঘনিষ্ঠতা নরেন্দ্র মোদী জমানার আবিষ্কার করা কোনো বন্দোবস্ত নয়। মোদী জমানার আগেও তার অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এই জমানায় কর্পোরেট প্রীতির ব্যাপকতা ও প্রকটতা আগের সমস্ত জমানাকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদে সাঙাতি দোস্তির পৃষ্ঠপোষকতাও বেপরোয়া হয়ে উঠে আশঙ্কাজনক মাত্রা নিয়েছে। এনপিএ ক্রমবর্ধমান এবং ব্যাঙ্কের খাতা থেকে কর্পোরেট ঋণ মুছে ফেলার পরিমাণও বেড়ে চলেছে (মোদী জমানাতেই ব্যাঙ্কের খাতা থেকে ঋণ মুছে ফেলার পরিমাণ হল ১০ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা!)। মোদী জমানা কর্পোরেটকুলের কাছে এমন কোনো কঠোর বার্তা দিতে পারেনি যা তাদের ব্যাঙ্ক ঋণকে লুটের সামগ্ৰী বলে গণ্য করা থেকে বিরত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের সম্পদের কর্পোরেট লুন্ঠনকে এই জমানায় যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার করে তোলা হচ্ছে, তারই সাথে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াকেও গতিশীল করা হচ্ছে। গোটা প্রক্রিয়াটাকে বিপরীতমুখী করতে হলে এই জমানার অপসারণ ছাড়া জনগণের কাছে অন্য কোনো বিকল্প থাকতে পারে না।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-9