বিশ্বের দারিদ্র সূচক নিয়ে ১৯৪২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখযোগ্য কাজ করে আসছে অক্সফ্যাম। সম্প্রতি তাদের একটি নতুন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে কোভিড পরিস্থিতি ও তার মোকাবিলায় বিভিন্ন নব্য উদারনৈতিক সরকারের নীতিমালা কীভাবে সমাজের বুকে বিদ্যমান অসাম্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। চার্লস ডিকেন্স-এর ‘হার্ড টাইমস’ উপন্যাসের শুরুর একটি বাক্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই রিপোর্ট লিখেছে এই কোভিড সময়কালও এক শ্রেণির মানুষের জন্য হয়ে উঠেছে ‘বেস্ট অব টাইমস’ এবং এক শ্রেণির মানুষের জন্য ‘ওয়ার্স্ট অব টাইমস’। কোভিড সময়কালে আরো অন্তত ১৬ কোটি লোক নতুন করে দারিদ্র কবলিত হয়েছেন। অন্যদিকে এই সময়কালেই আবার প্রতি ছাব্বিশ ঘন্টায় একজন করে মানুষ নতুন করে বিলিয়নেয়ার হয়েছেন।
সরকারী সাহায্য ও ভ্যাক্সিনের বন্টনের ক্ষেত্রেও অনেক অসাম্য থেকেছে নানা দেশে। কোভিডের প্রথম স্রোতে আমেরিকায় সেখানকার কালো মানুষেরা ও আদিম অধিবাসীরা সাদা মানুষদের তুলনায় বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছিলেন। কোভিডকালে ব্রিটেনের বাংলাদেশী বংশদ্ভূতদের মৃত্যুর হার ছিল সেখানকার সাদা মানুষদের পাঁচগুণ।
বিশ্বজুড়েই লকডাউন নীতিমালা যে শ্রমজীবী মানুষদের অন্যদের তুলনায় বেশি সমস্যায় ফেলেছে তার অনেক পরিসংখ্যান অক্সফ্যামের এই রিপোর্টে উঠে এসেছে। বিভিন্ন দেশেই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই কোভিড দিনকালে আগের চেয়েও বেশি করে স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের গড় আয়ুও আগের চেয়ে কমেছে।
অক্সফ্যামের এই রিপোর্ট ইএমএফ (ইন্টারন্যাশানাল মানিটারি ফান্ড)-এর চাপানো কৃচ্ছসাধন নীতিমালা ৭৩টি দেশকে কীভাবে সঙ্কটে ফেলেছে — তারও নানান ছবি তুলে ধরেছে। ঋণ সঙ্কটে পড়ে কৃচ্ছসাধন নীতিমালার ফলে এই দেশগুলির অধিকাংশই সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার বরাদ্দে ব্যাপক কাটছাঁট করতে গত কয়েক বছরে বাধ্য হয়েছিল। সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্কোচন এই সমস্ত দেশে কোভিড মৃ্ত্যুহারকে ভয়াবহ করে তুলেছে। বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিসেবাখাতে ব্যয়বৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ আর কোভিড মৃত্যুহারকে বাড়িয়েছে ৪.৯ শতাংশ।
বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান কোভিড পর্বে যত কমেছে, ততই বেড়েছে মহিলা, শিশু ও বিভিন্ন দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর নানাপ্রকারের বঞ্চনা ও হিংসার ঘটনাবলী। এই রিপোর্ট জানিয়েছে কোভিডকালে মহিলাদের ওপর হিংসার ঘটনা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মহিলাদের খুন করার ঘটনা এই পর্বে অনেকটাই বেড়েছে। ব্রিটেনে মহিলাদের ওপর এই সময়ে খুনের ঘটনার হার আগের চেয়ে তিনগুণ হয়েছে। রূপান্তরকর্মীদের খুনের ঘটনা বেড়েছে ৬ শতাংশ। ইজরায়েলে মহিলাদের খুনের ঘটনা বেড়েছে ৯ শতাংশ।
ভ্যাক্সিন বন্টনের ক্ষেত্রেও বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে অসাম্যের ছবি। ভ্যাক্সিনের ৮০ শতাংশই পেয়েছে জি-২০ ভূক্ত দেশগুলি। নিম্ন আয়ের দেশগুলি সব মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ১ শতাংশ ভ্যাকসিন। এর কারণ হিসেবে অক্সফ্যাম রিপোর্ট দায়ী করেছে ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলির নীতিমালা ও মুনাফার প্রতি একচক্ষু নীতিকে। এই রিপোর্ট এও দেখিয়েছে বিভিন্ন ফার্মা কোম্পানি এই সময়কে কাজে লাগিয়ে কীভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। মর্ডানা বা ফাইজারের মতো কোম্পানি তাদের ভ্যাক্সিনের দাম উৎপাদন ব্যয়ের ২৪ গুণ ধার্য করে রেখেছে। অতিকায় ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলি কীভাবে তাদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য দরিদ্র দেশ ও মানুষদের বঞ্চিত করেছে, এই রিপোর্ট তার করুণ অমানবিক চিত্রকে স্পষ্ট করেছে। অথচ বায়ো অ্যান্ড টেক-এর মতো কোম্পানি জার্মানির জনগণের টাকায় পুষ্ট হয়ে তাদের ভ্যাক্সিন বানিয়েছিল, কিন্তু দরিদ্র দেশগুলির এক শতাংশ মানুষও তাদের ভ্যাকসিনের সুবিধে নিতে পারেনি অত্যাধিক দাম ধার্য করার জন্য।
অতিমারি মোকাবিলার জরুরী প্রয়োজনের দিনেও ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলি তাদের মুনাফাসর্বস্ব নীতি থেকে সরে এসে ভ্যাক্সিন বানানোর কৃৎকৌশল অন্যদের সরবরাহ করতে সম্মত হয়নি। এই রিপোর্ট বলেছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অন্তত একশোটি কোম্পানি আরএনএ ভ্যাক্সিন বানাতে পারার জায়গায় ছিল, কিন্তু এর প্রয়োজনীয় কৃৎকৌশল তাদের সরবরাহ না করায় তারা তা বানাতে সক্ষম হয়নি। কোটি কোটি মানুষ এরফলে উন্নত পরিসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এরই বিপরীতে এই রিপোর্ট কিউবার উজ্জ্বল ভূমিকাকেও চিহ্নিত করেছে। দেখিয়েছে কিউবা শুধুই যে নিজের দেশের লোককে ভালোভাবে ভ্যাক্সিন দিতে পেরেছে তা নয়, তারা ভিয়েতনাম, ভেনিজুয়েলা, ইরানেও ব্যাপকভাবে ভ্যাক্সিন সরবরাহ করেছে।
ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে এই রিপোর্ট যে চিত্র তুলে ধরেছে এইবার সেইদিকে নির্দিষ্টভাবে তাকানো যাক। মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২১ — এই সময়কালের মধ্যে ভারতের ৮৪ শতাংশ জনগণের আয় কমেছে বলে অক্সফ্যাম রিপোর্ট জানিয়েছে। অন্যদিকে এই সময়কালেই ভারতের অতি ধনীরা আরো ধনী হয়েছেন। বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা এই সময়কালে ১০২ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪২। জনগণের ওপর যেমন একদিকে অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা বেড়েছে, তেমনি অন্যদিকে কমেছে কর্পোরেট ট্যাক্স-এর অংশভাগ।
মধ্য আয়ের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারত সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কতটা কম ব্যয় করে তা এই রিপোর্ট তুলে ধরেছে। ব্রাজিল জিডিপি’র ৯.৫১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৮.২৫ শতাংশ, চিন ৫.৩৫ শতাংশ, রাশিয়া ৫.৩২ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে। তুলনায় ভারতের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় মাত্র ৩.৫৪ শতাংশ। ভারতে স্বাস্থ্যখাতে কম ব্যয়ের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী দরিদ্র ও প্রান্তিক বর্গের মানুষজন। এই রিপোর্ট জানিয়েছে ভারতের একজন দলিত মহিলার গড় আয়ু একজন উচ্চবর্ণ মহিলার চেয়ে ১৫ বছর কম। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তুলনায় আদিবাসী জনগণের গড় আয়ু ৪ বছর কম।
একই চিত্র শিক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দতেও। ব্রাজিল জিডিপি’র ৬.১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৬.৮ শতাংশ, রাশিয়া ৪.৭ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করলেও ভারতে এই ব্যয় দীর্ঘদিন ধরেই ঘোরাফেরা করছে ৩ শতাংশের মধ্যেই। একে ৬ শতাংশে উন্নীত করার দীর্ঘকালীন দাবি পূরণে সরকার কোনও আগ্রহই দেখাচ্ছে না।
শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিসেবা পাবার ক্ষেত্রে ভারতের ধনী ও দরিদ্র অংশর মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য এটা সকলেরই জানা। অক্সফ্যাম রিপোর্ট সুনির্দিষ্ট তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছে যে ভারতের ৯৮ জন বিলিয়নেয়ার-এর ওপর শতকরা ১ শতাংশ অতিরিক্ত কর আরোপ করলেই ভারতের স্কুলশিক্ষা, সাক্ষরতা কর্মসূচি ও আয়ুষ্মান ভারতের মতো স্বাস্থ্য কর্মসূচির সাত বছরের যাবতীয় ব্যয় উঠে আসবে।
ভারত ও বাংলার প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে অক্সফ্যামের এই গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয়ইনি। তার কারণও অস্পষ্ট নয়। নয়া উদারনৈতিক শাসনের সঙ্গে কর্পোরেট মিডিয়ার ঘনিষ্ট গাঁটছড়া এইসমস্ত বিষয়কে আড়াল করতেই চায়। সংগ্রামী শক্তি ও জনগণের নিজস্ব প্রচারাভিযানকেই দায়িত্ব নিয়ে সামনে আনতে হবে সরকারী ও কর্পোরেট নীতিমালার সঙ্গে অসাম্য ও তার ক্রমবৃদ্ধির ঘনিষ্ট সম্পর্ককে।
- সৌভিক ঘোষাল