সারদা প্রসাদ কিস্কু (১৯২৯-১৯৯৬)
Sarada Prasad

সাঁওতালি সাহিত্যে সারদা প্রসাদ কিস্কু ছিলেন এক অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানার অন্তর্গত (বর্তমানে মানবাজার ব্লক-২’র অন্তর্গত) দাঁড়িকাডোবা গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন চরণ কিস্কু এবং মাতা ছিলেন ধনমনি কিস্কু। তাঁর জীবন অবসান হয় ১৮ মার্চ ১৯৯৬ সালে।

তিনি ১৯৩৮ সালে জরবারি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বড়গড়িয়া উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৪০ সালে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ মিডল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন আইএসসি’তে পড়ার জন্য। কিন্তু দারিদ্রের জন্য তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তখনকার সময়ে শিক্ষাজগতে জীবিকা অর্জনের জন্য হিন্দি প্রশিক্ষণের আবশ্যকতা থাকায় তিনি ১৯৫০ সালে বান্দোয়ান হিন্দি শিক্ষণ কেন্দ্র থেকে হিন্দি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তিনি জামতোড়িয়া সেনিয়ার বেসিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি ১৯৬২ সালে বিধানসভা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন যার জন্য চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর পরাজয় হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি আবার শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন এবং তাঁর শিক্ষকতাকে এক উচ্চতম আদর্শে উন্নীত করেছিলেন, যার জন্য ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি তাঁকে ‘আদর্শ শিক্ষক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তিনিই হলেন প্রথম সাঁওতাল শিক্ষক যিনি আদর্শ শিক্ষক রূপে রাষ্ট্রপতি দ্বারা পুরষ্কৃত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কবিরত্ন’ পুরষ্কারে পুরষ্কৃত হয়েছিলন ১৯৮৩ সালে। তিনি ১৯৮৯ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

হাই স্কুলে পড়ার সময় সারদা প্রসাদ কিস্কুর হাতে নরসিংহ হেম্ব্রমের লেখা ‘নাহাঃ সেরেঞ পুঁথি’ (আধুনিক গানের বই) তাঁকে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে তোলে এবং এর থেকেই তিনি কবিতা লেখা লিখি শুরু করেন। পরে তিনি সাধু রামচাঁদ মুরমুর লেখা গানের বই ‘সারিধরম সেরেঞ পুঁথি’ (সারিধরম গানের পুস্তক) দ্বারা গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। তিনি নিজের লেখাতে লিখেছেন যে, সাধু রামচাঁদ মুরমু হলেন তাঁর গুরু যিনি গানের মাধ্যমে সকল সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের জাগরণের বার্তা দিচ্ছিলেন গানের মাধ্যমে। সাধু রামচাঁদ মুরমু ছিলেন কবি, শিল্পী, সমাজ সংস্কারক, কাব্যিক, সাহিত্যিক ও মহান দার্শনিক। তিনি সারিধরম সেরেঞ পুঁথি দ্বারা সমস্ত সাঁওতালদেরকে নিজেদের প্রাচীন ধর্ম সারিধরম (সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম) দ্বারা অনুপ্রাণিত করছিলেন। তিনি সারিধরম’এর প্রবক্তা নন, পূর্বপুরুষগণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে সারিধরম সেই সারিধরম প্রচার ও প্রসার কার্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। গুরুর লেখনীতে তথা পদ্যে ও কবিতায় যেরূপ ছন্দমিল ছিল তার দ্বারা নতুনভাবে সারদা প্রসাদ কিস্কুকে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এছাড়া, ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি সাধু রামচাঁদের পথ তথা সাঁওতালদের প্রাচীন পথ সারিধরম’এর অনুগামী ছিলেন। গুরু-শিষ্য উভয়েই উজ্জ্বল কবি হিসেবে সাঁওতালি সাহিত্যে স্থান দখল করেছেন। তবে, সাধু রামচাঁদ মহাকবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। যাই হোক, সাধু রামচাঁদের মতই কবি সারদা প্রসাদ কিস্কুও ছিলেন কবি, শিল্পী, সমাজ সংস্কারক, কাব্যিক, কথা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত যথা — ‘হড় সম্বাদ’, ‘সুসৗর ডাহার’, ‘তেতরে’, ‘জিরি হিরি’, ‘এভেন’, ‘হৗরয়ৗড় সাকাম’, ‘পছিমবাংলা’, ‘খেরওয়াল জারপা’ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ‘খেরওয়াল আড়াং’ (১৯৫৮) ‘সুসৗর ডাহার’ (১৯৭২) মাসিক পত্রিকা দুটির সম্পাদক ছিলেন। তিনি দুটি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। একটি হল ‘টটকো মলং’ (উঁচু কপালধারী) এবং ‘পাতাং সুরৗই’ (পাতার পোকা)। তেতরে পত্রিকায় তিনি পাতাং সুরৗই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।

কবি সারদা প্রসাদ কিস্কু রচিত পুঁথিগুলি হল — ভূরকৗ ইপিল (শুক তারা) ১৯৫৩, কুহুবৗউ (কোকিল/লুকোচুরি) ১৯৬০, গাম গঁদার (মধুর বাণী) ১৯৬৭, লাহাঃ হররে (এগিয়ে চলার পথে) ১৯৮৫, সলম লটম (তালগোল) ১৯৮৮, জুডৗসি অনল মালা (মনোরম প্রবন্ধ সংকলন) ১৯৯৪, বিদৗঃ বেড়া (বিদায় বেলা) ১৯৯৭।

- সুব্রত টুডু

খণ্ড-29
সংখ্যা-12