ফেব্রুয়ারি-মার্চে যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল তারমধ্যে উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাব ছিল মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ কৃষি আইন বাতিলের পর এই নির্বাচন। হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সমর্থনের কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছিল যে আন্দোলন নরেন্দ্র মোদীকে আইনগুলি বাতিল করতে বাধ্য করে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে — পাঞ্জাবে, কৃষক আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন মাত্র জানিয়েছিল যে দলটা সেই ‘আপ’কে এই আন্দোলন বিপুল জয়ের পথে চালিত করেছে এবং বিজেপি উত্তরপ্রদেশে আন্দোলনের প্রভাবকে খানিকটা নিয়ন্ত্রিত করে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতিকে পরিমিত মাত্রায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর তিনটি বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুরের নির্বাচনী ফলে তাদের নিজস্ব পরিস্থিতি কার্যকর হয়েছে। সব মিলিয়ে এই পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন ২০২৪’র মহা সমরের দৌড়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে উঠেছিল।
উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া ও মণিপুরে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখে বিজেপি এই রাউন্ড বেশ স্বচ্ছন্দে জেতার দাবি করতেই পারে। কিন্তু একটু নিবিড় চোখে খুঁটিয়ে দেখলেই মোদী সরকার এবং বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে ধূমায়িত গণঅসন্তোষ এবং একটি কার্যকরী বিরোধী শক্তি ও রাজনৈতিক বিকল্পের খোঁজ নজরে আসবে। উত্তরাখণ্ডে গণমেজাজের আঁচে সতর্ক বিজেপি নিজে থেকেই দু’বার মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে, কিন্তু তারপরেও পদাসীন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে হেরেছেন, যদিও বিজেপি কংগ্রেসের দুর্বলতার সৌজন্যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পেরেছে। গোয়াও একটি অ-বিজেপি সরকারের প্রত্যাশা জাগিয়েছিল, কিন্তু বিরোধী শক্তির বিভাজন আবারও একটি বিজেপি-মেয়াদের পথ প্রশস্ত করেছে। তবে এই রাউন্ডে বিজেপি’র বিপুল জয় সত্ত্বেও, বিরোধীশক্তির জন্য কিছু অর্জন আছে, এবং অবশ্যই আছে প্রচুর শিক্ষা, আর আছে বিশেষ করে জনতার পথের লড়াইয়ের শক্তি।
উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের ফলাফলকে আতস কাঁচের নিচে রাখার আগে আমাদের অবশ্যই ব্যাপক বিধিভঙ্গ, অনিয়মগুলি নজরে আনতে হবে যেগুলি এই রাজ্যের নির্বাচনকে চিহ্নিত করে রেখেছে। এটি স্পষ্টভাবেই ছিল ভারতের সবচেয়ে অসম নির্বাচনগুলির মধ্যে একটি। বিজেপি’র ঘৃণাবর্ষী ভাষণ ও রাজ্য প্রশাসনের ব্যাপক অপব্যবহার এবং নির্বাচন কমিশনের নীরব দর্শক হয়ে থাকার মধ্য দিয়ে বিজেপি এই নির্বাচনে নির্বাচনী বিধিগুলিকে সম্পূর্ণ পরিহাসে পরিণত করেছে। এরপর আছে স্ট্রংরুম বিধিভঙ্গের উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সংবাদ যা ইভিএম’এ কারচুপি এবং অদলবদলের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে, এনিয়ে বাড়ছে অভিযোগ যেগুলো এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বাঁচাতে, নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টকে অবশ্যই বিচার করতে হবে। তবে বিজেপি’র কথা এবং ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল অবস্থার কথা জানা থাকলে এইসব বেনিয়ম ও বিশৃঙ্খলাগুলো অপ্রত্যাশিত নয়। তাই এর উত্তর নিহিত আছে এইসব নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়গুলিকে অতিক্রম করা বা সেগুলোকে অসম্ভব না হলেও, ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে রাস্তায় মানুষের আন্দোলনকেও শক্তিশালী করে তোলার মধ্যে।
উত্তরপ্রদেশের বেশ কয়েকটি আসনে খুব কম ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীরা একত্রিশটি আসনে ৫,০০০ এরও কম ভোটের ব্যবধানে জিতেছে, তারমধ্যে সাতটিতে আবার ৫০০’রও কম ভোটে। আমাদের এটাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে বিজেপি ২১টি আসনে খুব কম মার্জিনে সমাজবাদী পার্টির কাছে হেরেছে। কম মার্জিনের প্রশ্নে, এই আসনগুলির অনেক গুলিতেই এআইএমআইএম এবং বিএসপি’র পাওয়া ভোট চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এআইএমআইএম ২০১৭ সালে ৩৮টি আসনে লড়েছিল; এবার তারা ৯৫ জন প্রার্থী দিয়েছিল আর অন্তত সাতটি আসনে এআইএমআইএম প্রার্থীর পাওয়া ভোট এসপি-আরএলডি জোটের জেতার সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছে। বিএসপি’র ভোট শেয়ার অন্তত দশ শতাংশ কমেছে আর সমস্ত সংকেত থেকে এটা স্পষ্ট যে বিএসপি’র এই ক্ষতির সিংহভাগটাই সরাসরি ঢুকেছে বিজেপি’র লাভের ঝুলিতে। বিএসপি’র প্রচার ছিল মূলত সমাজবাদী পার্টির বিরুদ্ধে আর এতাবৎকালে নিকৃষ্টতম এই ফলের পরও, মায়াবতী তার পার্টির এই পরিত্যক্ত দশার জন্য মুসলিমদের জোরালোভাবে দোষারোপ করছেন। অথচ এই মুহূর্তে, পাঁচবছর নিষ্ঠুর যোগী-রাজ এবং দলিতদের উপর ক্রমবর্ধমান উৎপীড়নের পরও বিজেপি’কে উৎখাত করার প্রশ্নে তার পার্টির ব্যর্থতা নিয়ে তার আত্মসমীক্ষা করার দরকার ছিল!
এসপি-আরএলডি জোটের নির্বাচনী ফলে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ, বিশেষ করে লখিমপুর গণহত্যায় কৃষক-রোষ এবং বেকারি-বিরোধী যুব-বিক্ষোভ অবশ্যই যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কৃষক আন্দোলনে মুজাফ্ফরনগর-শামলি অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ধার ভোঁতা হয়ে গেছে। বিষয়টি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সেখান ২০১৩’র মুসলিম বিরোধী হিংসা-তাণ্ডবের বেশ কয়েক জন ‘মাথা’ ভোটে পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু অতিমারী আর লকডাউনের জোড়া ফলায় বিদ্ধ মানুষ যখন কষ্টে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছিল, তখন বিরোধীদের তাদের পাশে খুব একটা দাঁড়াতে দেখা যায়নি। বিজেপি’র ‘উপকারভোগী রাজনীতি’ এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পের ‘উপকারভোগী’দের বিজেপি’র অনুগত ভোটদাতায় পরিণত করার ব্যবস্থা বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই ‘মুচলেকাবদ্ধ ভোটার’ ব্যবস্থা গ্রামীণ যুব ও মহিলাদের সামাজিক রূপান্তরণের রাজনীতির স্তম্ভ হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে প্রচণ্ড জোরালো পাল্টা-সমাবেশ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছে। দেশে বাম আন্দোলনের জন্য এই নির্বাচনের এটাই হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
নির্বাচনে সবচেয়ে চমকপ্রদ ফল এসেছে পাঞ্জাব থেকে। ২০১২-তে ‘আপ’এর আত্মপ্রকাশের পর থেকে, পাঞ্জাব আগাগোড়াই এই নতুন দলটির জন্য এক সহায়ক ক্ষেত্র ছিল। ২০১৪তে লোকসভা নির্বাচনে এই দলটি পাঞ্জাব থেকে ৪টি আসনে জিততে সক্ষম হয়, যদিও পাঁচবছর পরে তা কমে দাঁড়ায় একটিতে। ২০১৭-তে ‘আপ’ কংগ্রেস ও আকালি দলের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৭-তে জয়ী কুড়িজন প্রার্থীর মধ্যে দশজনই ‘আপ’ ছেড়ে যায় আর দলটিকেও রাজ্যের সক্রিয় বিরোধী দলের ভূমিকায় ক্বচিৎ দেখা গেছে। কিন্তু দিল্লীতে আপ’এর বিদ্যুৎ ও জলের বিল কমিয়ে দেওয়া, সরকারি স্কুলের মানোন্নয়ন আর ভাগোয়ান্ত্ মান’কে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসাবে প্রচার মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষা জাগায়। আর পাঞ্জাবে কংগ্রেস-আকালি আধিপত্যকে বিদায় দিয়ে ‘আপ’কে বিপুল জনাদেশে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, কৃষকনেতাদের এক অংশ এই নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করলেও, জনসমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়।
পাঞ্জাব জনাদেশ ‘আপ’ এবং ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য নিয়ে এসেছে এক বৃহত্তর শ্রেণিবিন্যাস। দিল্লীতে আপ মূলত, মধ্য-ডান নরম হিন্দুত্বের কাঠামোর মধ্যে পৌর শাসনের রাজনীতির স্পষ্ট অনুশীলন করে চলেছে। এই রাজনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দিল্লী আলোড়িত করা ছাত্র নাগরিক এবং কৃষকদের অত্যন্ত বলিষ্ঠ আন্দোলন থেকে অনেক দূরে থেকেছে। এমনকি বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক হিংসার আক্রমণাত্মক প্রচার এবং রাষ্ট্রীয় পীড়ন — যার বলি হয়েছেন, জীবিকা হারিয়েছেন বহু মানুষ, সাজানো মামলায় কারারুদ্ধ হয়েছেন বহু আন্দোলনকর্মী ও নিরীহ নাগরিক — তার বিরুদ্ধে শান্তি ও ন্যায়ের দাবিতে কণ্ঠ পর্যন্ত তুলতে অস্বীকার করেছে। পাঞ্জাব হবে একটি ভিন্ন বাস্তবতার প্রেক্ষিত যেখানে আপ’কে এবার পরীক্ষা দিতে হবে। এটি শুধু একটি পূর্ণ রাজ্যই নয়, এর রাজনৈতিক মেজাজও আলাদা। কারণ পাঞ্জাব ক্রমবিকাশমান ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধের একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে — সে কর্পোরেট-বিরোধী কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হোক বা ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে বা যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংবিধানের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে গণবিরোধিতার মধ্য দিয়েই হোক।
পাঞ্জাবে আপ তার মেয়াদ শুরু করতে চাইছে ভগৎ সিং এবং আম্বেদকরের উত্তরাধিকারকে বেশ জোরালো আবাহন জানিয়ে। তার মন্ত্রীসভার শপথ নেওয়ার কথা ভগৎ সিং’এর জন্মস্থান খাটকর কালানে। স্পষ্টতই পাঞ্জাবের আপ সরকারের অভিজ্ঞতার একটা বড়-সড় প্রভাব থাকবে আপের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে উপর। আপ’এর উত্থানের পাশাপাশি পাঞ্জাবে বিজেপি’রও উদ্বেগজনক বৃদ্ধি ঘটেছে। প্রভাবশালী আকালি দলের ছায়ায় থেকে গৌণ ভূমিকা পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে বিজেপি পাঞ্জাবে নিজের উপস্থিতিকে আরও শক্তিশালী করে নিজের অ্যাজেন্ডা নিয়ে এগোনোর জন্য নতুন পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। পাঞ্জাবের বামশক্তি ভগৎ সিং এবং আম্বেদকরের প্রগতিশীল উত্তরাধিকারের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তাদের পাঞ্জাবের মানুষের রাজনীতি ও শাসনের প্রগতিশীল উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাকে রক্ষা করার জন্য পরিস্থিতির যথাযথ মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। আর ভারত জুড়ে বিরোধী শক্তিগুলিকে, এই সব বিধানসভা নির্বাচনের শিক্ষার আলোকে ২০২৪’র প্রস্তুতিকে ত্বরান্বিত করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৫ মার্চ ২০২২)