পুতিনের ইউক্রেন-যুদ্ধ আর মোদীর নীতি-পঙ্গুত্ব
Putin’s Ukraine War

দু’সপ্তাহব্যাপী হামলার পরও পুতিনের ইউক্রেন-যুদ্ধ কমার কোনও লক্ষণ নেই। ইউক্রেনের বেশ কিছু অংশে গোলাবর্ষণ আরও তীব্র, আরও ব্যাপক হয়েছে। সাধারণ মানুষের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে বাস্তুত্যাগী শরণার্থীর স্রোত। ইউক্রেনে চলছে বিপুল ধ্বংস তাণ্ডব। ইউক্রেন সেনাসূত্রে জানা গেছে, রাশিয়ারও সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র — উভয় দিক থেকেই বড় রকম সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুদ্ধে আর্থিক এবং মানবিক ক্ষতি যেহেতু বেড়েই চলেছে, ঐ অঞ্চল জুড়ে তো বটেই, তার বাইরেও তার প্রভাব পড়ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তিনদফা কথাবার্তা চললেও এখনও পর্যন্ত কোন যুদ্ধ বিরতি ঘটেনি, স্থায়ী শান্তির জন্য কোনও কূটনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠা তো বহু দূরের কথা।

আর আমাদের ভারতে, পুতিনের ইউক্রেন-যুদ্ধ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মোদী সরকারের চরম ব্যর্থতাকে নির্লজ্জভাবে প্রকট করে তুলেছে। ‘মোদী জমানায় বিশ্বের দরবারে ভারত কী সাংঘাতিক উচ্চতায় পৌঁছেছে’ — আরও কয়েকটির মধ্যে অন্যতম এই আকাশ কুসুম দাবিটিকে কেন্দ্র করে মোদী সরকারের আত্মগরিমা প্রচার আবর্তিত হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী সবচেয়ে বেশিবার বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। আর এখন ইউক্রেন-সংকটে ভারতের বিদেশনীতিকে কার্যত পক্ষাঘাতগ্রস্ত মনে হচ্ছে; ভারত এই প্রশ্নে রাষ্ট্রসঙ্ঘে বারবার বিরত থাকার মতো ভূমিকাটুকুই নিতে পেরেছে মাত্র! আরও দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল — ইউক্রেনে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি ছেলে-মেয়ে পড়তে গেছে — ইউক্রেন সরকারের ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী মোট ৭৬,০০০ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ২০,০০০ জনই ভারতীয়। আর মোদী সরকার তাদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে ও সময়মত ওদের ফিরিয়ে আনতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

রাশিয়ার ইউক্রেন-আগ্রাসনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যে ভারতীয় দূতাবাস থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাতে যে ভারতীয়দের থাকা ‘অনাবশ্যক’ তাদের সাময়িকভাবে ইউক্রেন ছাড়তে বলা হয়েছিল। পরের দিন, এক নির্দেশিকায় বলা হয় ‘ভারতে ফিরে যেতে ইচ্ছুক’ ভারতীয়দের ‘পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কমার্শিয়াল ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া গেলে বুক করে নিতে’। দু’দিন পর, তিনটি বিশেষ এয়ার ইন্ডিয়া উড়ানের কথা ঘোষণা করা হল যেগুলোর টিকিটের দাম যথেষ্ট বেশি। সেই সময় দূতাবাস থেকে যখন সমস্ত পড়ুয়াকে ইউক্রেন ছাড়তে বলা হল, ইউক্রেনের আকাশ পথ তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ইউক্রেন থেকে সরাসরি উড়ান আর সম্ভবপর ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের তখন বলা হল সম্ভবপর যে কোনও উপায়ে প্রতিবেশী দেশগুলিতে পৌঁছাতে। তাদের বিন্দুমাত্র জানা ছিলনা, যে খাবার আর পানীয় জল ছাড়া জমে যাওয়া ঠাণ্ডায় দীর্ঘ পথ হাঁটার পর এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যের অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ওদেরও অনেককে স্টেশন থেকে এবং সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেবে বর্ণবিদ্বেষী নিরাপত্তা রক্ষীরা!

সরকার যদিও ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতীয় ছাত্রদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বা সময়মত ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মানসিক যন্ত্রণাকে নিজের কাজে লাগাতে কিন্তু কসুর করেনি! সেই আতঙ্ক আর কষ্টের আখ্যানকে এক ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ প্রচারাভিযানে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলা বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে কাজে লাগানো হয়েছে। ছাত্রদের সরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন গঙ্গা’! চারজন মন্ত্রীকে পাঠানো হয়েছে সেই কাজ ‘দেখভাল’ করার জন্যে! যখন বাস্তবে ছাত্রছাত্রীদের রেল স্টেশনে এবং এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর জন্যে পরিবহনের ব্যবস্থা করা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে তাদের নিরাপদে সরিয়ে আনাকে নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেছে যে ইউক্রেন থেকে ফেরার যাত্রীতালিকা থেকে তাদের নাম সরিয়ে সেখানে উত্তর ভারতের ছাত্রছাত্রীদের নাম ঢুকিয়েছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের আধিকারিকরা। আর একাজে তাদের সাহায্য করেছিলেন বিএপিএস স্বামীনারায়ণ সংস্থার সদস্যরা। এটি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যেটি প্রবাসী হিন্দুত্ববাদীদের বিশ্বব্যাপী সংগঠন-জালের একটি প্রভাবশালী অংশ।

যে সব ছাত্রছাত্রী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাদের বিপন্নতার কথা বর্ণনা করেছে বা সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও শেয়ার করে সাহায্যের আবেদন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘ বাহিনী নির্দ্বিধায় কুৎসা প্রচার চালিয়েছে। মানসিক আঘাতে জর্জরিত সেইসব ছাত্র ছাত্রীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা বিশেষ সুযোগপ্রাপ্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে এবং ভারতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তারা অকৃতকার্য হয়েছে। এমনকি যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে থেকে সরিয়ে আনার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার দায়ও তাদের উপরেই চাপানো হয়েছে। কর্ণাটকের এক বিজেপি নেতা খারকিভে গোলাবর্ষণে নিহত কর্ণাটকের ছাত্র নবীন শেখরাপ্পার দেহ ফিরিয়ে আনার দাবি পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছেন। তার যুক্তি-মৃতদেহ বিমানে যে জায়গা নেবে সেখানে আটটি জীবিত ছাত্রের জায়গা হতে পারে। (কী অবাস্তব এবং হৃদয়হীন দাবি! বিমানের হোল্ডে মৃতদেহ বহন করা হয়)। এটা সবাই জানে ভারতে ডাক্তারি পড়ার ব্যয় ক্রমাগত বেড়ে নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার জন্যই ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা ইউক্রেনে পড়তে যেতে বাধ্য হয়। যে সময়টা তাদের ভারত সরকারের সাহায্য দরকার ছিল, তারা পেল চূড়ান্ত উপেক্ষা আর অপমান!

ইউক্রেনের উপর পুতিনের অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়াকে মোদী সরকারের নিন্দা করতে অস্বীকার করা আসলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্নে সরকারের এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত নীতিকেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। মোদী সরকারের ইজরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে রণকৌশলগত ভাগীদারি ক্রমশ বাড়তে থাকায়, ভারত প্যালেস্তিনীয় স্বার্থকে সমর্থন জানানো বন্ধ করে দিয়েছে। আর এখন রাশিয়াকে চটানোর ভয়ে, এক সার্বভৌম দেশ হিসাবে ইউক্রেনের অস্তিত্বের সমর্থনে পাশে দাঁড়াতে সরকার অস্বীকার করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রশ্নে ভারতের বিরত থাকাকে ভারতের বিদেশ নীতির নিরপেক্ষতা বা আন্তর্জাতিক রণক্ষেত্রে ভারতের আমেরিকা থেকে দূরে থাকার লক্ষণ হিসেবে দেখা ভুল হবে। আমেরিকার বিশ্ব-আধিপত্যের ছকের প্রতি মোদীর ভারতের রণকৌশলগত অধীনতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। এই সংকট মুহূর্তে রাশিয়ার প্রতি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে অন্তর্নিহিত রয়েছে এক উগ্র দক্ষিণপন্থী ‘বলিষ্ঠ নেতা’ হিসাবে পুতিনের প্রতি সঙ্ঘবাহিনীর নীরব শ্রদ্ধাও! আর ভারত-পাক বিবাদের ক্ষেত্রে এক আদর্শ মাপকাঠি হিসাবে এই যুদ্ধ সঙ্ঘীদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, সেজন্যও তারা এই অন্যায় যুদ্ধের মহিমাকীর্তন করতে উৎসাহী!

রাশিয়ায় আরও বেশি বেশি সংখ্যায় মানুষ অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিতে পুলিশী দমনপীড়ন এবং সরকারের অতি দেশভক্তিসঞ্জাত উগ্র-জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে পথে নামছে। তারা রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থ আর যুদ্ধবাজ পুতিনের ভয়ঙ্কর নীতি (যা এই সংকটজনক পরিস্থিতিকে চরম সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেবে) আর প্রতিবেশীর উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেশবাসীর অসন্তোষ দমন করার স্বৈরাচারী ছকের মধ্যে, ফারাক করেছেন। ভারতে আমাদেরও মোদী সরকারের অদূরদর্শী দৃষ্টির বিপরীতে অন্য এক নীতি কাঠামোর মধ্যে ভারতের নিজের স্বার্থকে দেখতে হবে। যখন একটি বৃহৎ শক্তি এক প্রতিবেশীকে বোমা ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, ভারতের উচিত শেষোক্তটির সার্বভৌম অস্তিত্ব এবং তার আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সমর্থনে পাশে দাঁড়ানো। পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে তা গোটা বিশ্বে তেলের দাম বাড়িয়ে দেবে, পৃথিবী জুড়ে খাদ্যের হাহাকার ডেকে আনবে, আর অস্ত্রের দৌড় এবং পৃথিবীব্যাপী অশুভ ভাগবিন্যাস সহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর করবে। এই সংকট মুহূর্তে ভারতকে একটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত বিদেশ নীতি আঁকড়ে চলতে দেওয়া যায়না। অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা ও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের এক অতি সক্রিয় ভূমিকা এই মুহূর্তের দাবি!

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৮ মার্চ ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-11