ক্ষমতার নির্বাচন
Power selection-edi

‘খেলা হবে’ প্রচারের ষোলোকলা পূর্ণ হল। প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দখল অভিযান সারা হল। ১০৮টি পুরসভার মধ্যে ১০২টিতে ক্ষমতা কায়েম হল, ৯৪ শতাংশ হাসিল। ওয়ার্ড কব্জায় এসে গেছে ১৮৬৬টি, শতাংশের হিসেবে ৮৭। ৩৩টি পুরসভা পরিণত হল বিরোধীশূন্য। ৩৯টি পুরসভায় নেই প্রধান প্রধান বিরোধী দল। ভোট জুটেছে ৬৩ শতাংশ। তবে বেঁকে বসা 'নির্দল' প্রার্থীরা পেয়ে গেছে ১২১টি ওয়ার্ড এবং ৮টি পুরসভায় ‘দ্বিতীয়’ স্থান, যা বস্তুত দলবিহীন কোন প্রবণতা নয়, টিএমসি-রই গোষ্ঠীসংঘাতের পরিণাম। জেলাগত সবসেরা অনুগত চমক দেখিয়েছে দলনেত্রীর বিশেষ আশীর্বাদধন্য নেতা চালিত বীরভূম, পকেটে ৯৩টি ওয়ার্ডের ৯২টি। এসব হল ‘সবুজ সুনামী’ কেমন আছড়ে পড়েছে সেটা ওপর থেকে বুঝে নেওয়ার তথ্যসমগ্র। এই সুবাদে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মায় শাসকদলের সর্বময় কর্ত্রী আরও একবার জাহির করলেন, এই ফলাফল ‘মা-মাটি-মানুষের’ আশীর্বাদ ঝরে পড়ার পরিঘটনা। সাফাই গাইলেন দলের দিক থেকে ‘সামান্য কিছু অপ্রীতিকর’ ঘটনায় জড়িয়ে পড়া হয়েছে মাত্র! তাও বিরোধীদের প্ররোচনায়! ভাবের ঘরে চুরি করে গিলিয়ে দিতে চাইলেন, স্থানীয় ও বহিরাগত আটসাঁট বেঁধে ছল-বল-কৌশল প্রয়োগের ঘটনার লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু কাদা না থাকা নাগরিকের সাদা মনে এইমাত্রায় জয় হাসিল মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। কেউ পূর্বাভাস দাবি করেননি, এবারের পৌরভোটে টিএমসি-র আধিপত্যে উল্লেখযোগ্য ধস নামার সম্ভাবনা ছিল। আবার এটাও নয় যে, যে হারে শাসকদল জয়ের নজীর কায়েম করল সেটা তাদের পক্ষের-বিপক্ষের উভয় হিসেবেই ধরা ছিল। বস্তুতপক্ষে সেটা না থাকাই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষমতার মদমত্ততার শিকার করে তোলে। যে ‘সামান্য গোলযোগ’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করা হচ্ছে, তা হল মিডিয়ায় ধরা পড়া দৃশ্যমান খন্ডচিত্র মাত্র, যে অপরাধে মিডিয়ার লোকেদেরও রক্ত ঝরেছে শাসক ভৈরববাহিনীর তান্ডবে। চিন্তাশীল নাগরিকের চর্চায় উঠেছে শাসকদলের ‘সুনামী’ তৈরির আরও বড় আকারে আয়োজনের কথা। রাজ্য নির্বাচন কমিশন থেকেছে নির্বিকার, পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক নিষ্ক্রিয়, পাড়ার নাগরিকদের নজরে ধরা পড়েছে শাসকদলের ক্যাম্পে ক্যাম্পে প্রচুর অচেনা নানা বয়সী নারী-পুরুষের ভিড়। হেনস্থা ও আক্রমণ করা হয়েছে এমনকি বিরোধীদলের মহিলা প্রার্থীকে। এবং জবরদস্তি ছাপ্পা ভোট করানো হয়েছে ভুতুরে ভোটারবাহিনী দিয়ে। পরিষেবা প্রদানের বিজ্ঞাপনী প্রচার ও বক্তৃতাবাজি করেও যে অর্থবল-পেশীবলের এত দাপাদাপি, তার চাঁদমারি হল যে কোনও উপায়ে পৌরসভার ক্ষমতা দখল। পৌর ক্ষমতা মানে যত ‘উন্নয়ন’ ও ‘পরিষেবা’র প্রকল্প তত দুর্নীতি-দলতন্ত্র-গোষ্ঠীতন্ত্র। কামিয়ে নেওয়া-দেওয়ার রীতিরই রমরমা। যখন নাগরিক পুরবাসীদের পরিষেবা প্রদান উপলক্ষ আর দলকে ভোটে-কাটমানিতে ‘লিড’ দেওয়াই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন রীতিনীতি চুলোয় যায়, মরীয়া হয় আগ্রাসী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবণতা ও চরম গোষ্ঠীসংঘাত। এরই পরিচয় পাওয়া গেল টিএমসি-র এতো জয়জয়কার ও তথাকথিত বহিস্কৃতদের এতো বড় সংখ্যায় প্রার্থী হওয়া ও জিতে যাওয়ার মধ্যে।

অন্যদিকে, ৪টি পৌরসভার পরিচালন ক্ষমতা নির্ণয় ঝুলন্ত অবস্থায় থাকছে, যেখানে পাড়ায় তৃণমূল পরিচিতির ‘নির্দল’দের আসনসংখ্যাই নিস্পত্তি না হওয়ার কারণ। এর কি পরিণতি হয় সময়ে বোঝা যাবে।

ওয়ার্ড আসন ও মোট প্রাপ্ত ভোট শতাংশের নিরিখে বামেদের বিজেপির চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারা স্বাগত। বিজেপির পিছিয়ে পড়া ও বিধানসভা পরবর্তী ক্রমাবনতির পরিঘটনা লক্ষ্যণীয়। তেমনি দার্জিলিং পৌরসভায় হামরো পার্টির সাফল্য ছিনিয়ে নেওয়া কি পার্বত্য জাতিসত্ত্বার মধ্যে নেতৃত্বের পুরোনো জীর্ণ অপদার্থ ঘরানার ছকগুলো পরিত্যাগ করে নতুন নেতৃত্বের জন্য আগ্রহী হওয়ার সংকেত দিচ্ছে?

খণ্ড-29
সংখ্যা-9