গত ১৩ মার্চ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১১তম দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল জেলা সদর বারুইপুরে।
জেলার আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে পার্টি কাজের বিকাশের লক্ষ্যে এবং গতিরুদ্ধতায় পড়ে যাওয়া অঞ্চলে রাজনৈতিক গতি প্রদানের উদ্দেশ্যে বিদায়ী জেলা কমিটি বারুইপুরে জেলা সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সোনারপুর-বারুইপুরের ছোট ছোট আন্দোলনের সফলতাগুলোই বিদায়ী জেলা কমিটিকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। জেলা সম্মেলন সফল করে তুলতে বারুইপুরের গণতান্ত্রিক মানুষের অক্লান্ত সহযোগিতাও চোখে পড়েছে। ৭০ দশকের প্রবীণ ও আজকের নবীন প্রজন্মের যারা লড়াইয়ে আগুয়ান তাদের সবাই বিপুল উৎসাহে এই সম্মেলনে সামিল হয়েছেন।
সম্মেলন স্থানের নামকরণ করা হয়েছিল সম্প্রতি পুলিশের পোশাক পরিহিত গুন্ডাদের দ্বারা নিহত লড়াকু ছাত্র আনিস খান নগর, বারুইপুর।
শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান শিশির চ্যাটার্জী, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন সম্মেলনে রাজ্য কমিটির পর্যবেক্ষক বাসুদেব বসু, বিদায়ী জেলা সম্পাদক সহ এরিয়া/লোকাল কমিটি ও গণসংগঠনের সম্পাদকরা, অতিথি প্রবীর দাস, বাবুন চ্যাটার্জী, সৌমিত্র বসু প্রমুখ অনেকে।
শতাধিক প্রতিনিধি ও অতিথিদের উপস্থিতিতে নদীয়ায় তৃণমূলী গুন্ডাদের হাতে নিহত প্রান্তিক কৃষক শহীদ কমরেড বানের সেখ সভাগৃহে সম্মেলন শুরু হয়। উস্থির শহীদ কমরেড হরেন মন্ডল মঞ্চে সম্মেলন পরিচালনা ও স্টিয়ারিং করলেন ৭৫ শতাংশ তরুণ প্রতিনিধিরা। প্রতিনিধিদের মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতি ভালোই ছিল। মোট ২১ জন বক্তব্য রাখেন, যাদের মধ্যে ৪ জন মহিলা, ২ জন ছাত্রী, যুবদের থেকে বক্তব্য রাখেন ৫ জন।
সম্মেলনের শুরুতে ব্যবস্থাপক কমিটির আহ্বায়ক প্রতিনিধি বর্ষীয়ান কমরেড শিশির চ্যাটার্জী সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের সম্বোধিত করে বক্তব্য রাখেন। রাজ্য কমিটির পর্যবেক্ষক বাসুদেব বসু বলেন, ফ্যাসিবাদী বিজেপি স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে ধ্বংস করে মনুসংহিতা রচিত হিন্দুত্বের সংবিধান বাস্তবায়িত করতে চাইছে, ক্রোনি ক্যাপিটালিজিমের সেবা করতে চাইছে। তার বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। রাজ্যে তৃণমূলের দুর্নীতি, দলবাজি ও দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান রাখেন তিনি।
শ্রমজীবী যুব প্রতিনিধি তীব্র ভাষায় জেলা কমিটির দুর্বলতা যা তার মনে হয়েছে তা তুলে ধরেছেন। ক্ষেতমজুর ঘর থেকে আসা মহিলা প্রতিনিধি ২ জন, ১০০ দিনের মজুরি প্রদানে দুর্নীতি বন্ধ করা এবং বছরে ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা দৈনিক বেতনের দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন। শ্রমিক প্রতিনিধি বলেন লকডাউনের পর দর্জী শিল্পে সংকট নেমে এসেছে এই অজুহাতে বড় বড় পোষাক শিল্পের মালিকরা দর্জি শিল্পের শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে চলেছে। এদের পাশে শাসক ও বিরোধী দলগুলো কেউ নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন্য। একজন মহিলা প্রতিনিধি বলেন পূজালী বজবজের একটা বড় অংশে অন্য বামপন্থীদের কোনও কর্মসূচিই দেখতে পাচ্ছি না। শুধুমাত্র বামশক্তি হিসাবে আমাদের কার্যকলাপ যা চলছে তাকে আরো বৃদ্ধি করতে হবে। নবাগত দুজন ছাত্রী কমরেড খসড়ার ওপর বলেন নরেন্দ্রপুর থানার পুরুষতান্ত্রিক কায়দায় যেভাবে মহিলাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে তা খসড়ায় আরো ভালো করে বিবরণ দিতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিক প্রতিনিধি বলেন শহরতলী বিষ্ণুপুর সাতগাছিয়া, বজবজ, মহেশতলা জুড়ে যেভাবে কৃষিজমিকে অকৃষিতে পরিণত করে প্রোমোটিং করছে তা ক্ষতিকারক, আগের সরকারের আমলে শুরু হলেও বর্তমান শাসক তৃণমূলের জমানায় তার দাপাদাপি ভয়ংকর, পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। সরকারী নিয়োগে দুর্নীতি লাগাম ছাড়া। বিশেষ করে সোনারপুর বারুইপুরের ছাত্র যুব ও সোনারপুরের পৌরসভার প্রার্থী কমরেড বলেন আমরা নতুন কাজ করতে গিয়ে দু’একজনকে নিয়মিত দেখতাম মনে হতো পার্টিটা ছোট। আজ দেখছি আমরা অনেকে আছি। বিগত সম্মেলন থেকে এবার প্রতিনিধি সংখ্যা বেশি ও মেজাজ ছিল তুঙ্গে।
যুব কমরেড সাংস্কৃতিক কর্মী সেখ সাবিরের গণসঙ্গিত, বাচিক শিল্পী ছাত্রী কমরেড শ্রাবণী নাথের আবৃত্তি এবং বর্ষীয়ান লেখক কমরেড কৌনিক সেন (মোহন মন্ডল)-র স্বরচিত কবিতা সম্মেলনকে সমৃদ্ধ করে। আগের রাতে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সম্মেলনে উপস্থিত হতে না পারার বেদনা থেকে সম্মেলনের সফলতা কামনা করে এবং আগামী ২৩ মার্চ শহীদ-ঈ-আজম ভগৎ সিং’এর শহীদ দিবস ছাত্র-যুব-সাংস্কৃতিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা যাতে মিলিতভাবে বড় করে উদযাপন করে তার আহ্বান রেখে বার্তা পাঠান কমরেড দেবাশীষ মন্ডল। প্রতিনিধিরা বলেন জুট, কৃষি নানা বিষয় এবং সংগঠনকে ব্রাঞ্চ/লোকাল/এরিয়া কমিটিগুলো নিয়মিত ও শক্তিশালী করতে হবে না হলে বর্তমান শাসকদের নানা হামলা মোকাবিলা করা যাবেনা। আগামীদিনে আন্দোলনকে জোরালো করতে লক্ষাধিক টাকার তহবিল গড়ে তোলার আহ্বান রাখা হয়।
বিদায়ী সম্পাদক তার জবাবী ভাষণে বলেন বৃহত্তর সমাজে যখন গণতন্ত্র প্রতিমুহূর্তে ধূলায় লুন্ঠিত হচ্ছে, তখন পার্টির মধ্যে নেতৃত্বকে সমালোচনা করার পরিবেশকে উন্নত করতে হবে। তা যতই তীক্ষ্ণ, তীব্র হোক না কেন। সমালোচনা যে করে সে পার্টির বিকাশ চায়, সেই কমরেডই আত্মসমালোচনায় দৃষ্টান্ত তৈরী এবং নিজের দায়িত্ব কতটা পালন করলেন তার হিসাব আগে দেওয়ার মানসিকতা রাখেন। সমস্ত সংযোজনী-সংশোধনী সহ খসড়া সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
বিদায়ী কমিটি ১৭ জনের কমিটির প্রস্তাব রাখে এবং তা গৃহীত হয়। প্রস্তাবিত কমিটি সদস্যদের নামের তালিকা ও সম্পাদক সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হন। পুর্ননির্বাচিত সম্পাদক কিশোর সরকার তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, সামনের দিন জোর লড়াই। আসুন সমস্ত পার্টি সদস্যদের ঐক্যবদ্ধভাবে পার্টির পরিচালনায় জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ নিই। তাই আজই সম্মেলনের শেষে ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘটের আহ্বান নিয়ে রাজপথে মিছিল হোক। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়। ধর্মঘট সফল করার আহ্বান নিয়ে সম্মেলনের হল থেকে বারুইপুর স্টেশন পর্যন্ত মিছিল হয়।