বিগতদিনে কামারহাটি পৌরসভা নির্বাচনে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে একাধিক ওয়ার্ডে প্রার্থী দেওয়া হোত। এবার মাত্র একটি ওয়ার্ডে প্রার্থী ছিলেন। পার্টির প্রার্থী মাত্র ৪৬ ভোট পেয়েছেন। পার্টির প্রার্থী দেওয়া প্রায় সব পৌরসভায় ফলাফলে কম-বেশি একই ছবি। পশ্চিমবাংলায় পার্টির এই করুণ অবস্থা কেন? একটু পিছন থেকে শুরু করা যাক, যাতে সমাধানের কোনও রাস্তা বেরোয়।
কামারহাটি পৌরসভায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে ১৯৯০-১৯৯৫-তে প্রাপ্ত গড় ভোট ছিল ১২-১৩ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট ৬০০ ও সর্বনিম্ন ২০০’র আশেপাশে থাকতো। এরপর অল্প অল্প করে ভোট কমতে থাকে। বিধানসভায় বিধায়ক এবং প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যায় বামফ্রন্ট সরকারের প্রধান বিরোধী দল ছিল কংগ্রেস। কিন্তু কংগ্রেসের অতীতের দুষ্কর্মের জন্য মানুষ ওদের বিশ্বাস করতো না। আর রাস্তায় নেমে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটের কিছুটা অংশ আমাদের পার্টির পক্ষে যেত। যুব-ছাত্ররা এই প্রশ্নে বড় ভূমিকা পালন করতেন। পার্টি নেতৃত্ব এবিএসএ ছাত্র সংগঠনকে কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার জন্যে উৎসাহিত করতেন। সিপিএম’এর হামলা, অত্যাচার, র্যাগিং মোকাবিলা করে ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজ, বিকেসি, ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইউনিট গড়ে ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। এরাই আবার এলাকায় ও পাড়ায় ফিরে এসে বুক ফুলিয়ে রাজনীতি ও সংগঠন করতেন। ভ্রাম্যমান রাজনীতির বদলে তারা স্থায়ী রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতেন। আবার পার্টির দেওয়া সামগ্রিক রাজনৈতিক কাজে অংশ নিতেন। এই বুনিয়াদি দিকগুলোর সঙ্গে ছিল অতীত দিনের লড়াইয়ের প্রভাব। যা ভোট পাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যকলাপের হাত ধরেই তখনকার দিনে কামারহাটিতে অনেকগুলো পার্টি কার্যালয় গড়ে উঠেছিল। সেই সময়ও অনেক বিতর্ক হয়েছে ‘বাম ফ্রন্ট মডেলে কতটা বাম অন্তর্বস্তু’ আছে তা নিয়ে।
১৯৯৮-তে তৃণমূল কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ। প্রতিষ্ঠান বিরোধী এবং কংগ্রেস বিরোধী যুব সমাজের ঢেউ মমতা ব্যানার্জিকে কেন্দ্র করে আছড়ে পড়ল। ২০০-র বেশি কিছু ভোট পাওয়া গেল, ২০১০ সালে সব ওয়ার্ডে ভোট ২০০’র নীচে নেমে গেল। এই সময় দুটি ঘটনা লক্ষ্যণীয়। বামফ্রন্ট সরকারের দাপট কমছে। মমতা ব্যানার্জির উত্থান হচ্ছে। রাজ্যে শাসক পরিবর্তনের আবেদনে হাজারে হাজারে যুবকরা টিএমসি’তে সামিল হতে থাকলেন।
এই সময় আমাদের অবস্থা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিকভাবে বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতা করতে হয়েছে, কিন্তু নীতিগত কারণে টিএমসি’র মতো বামফ্রন্ট সরকার উচ্ছেদের ডাক বা ‘বাম হটাও’ শ্লোগান দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় নেতা ও কর্মীদের গড় বয়স বাড়ছে। বয়স বাড়ে সমসাময়িক পাড়ার যুবক ও সমবয়সী বন্ধুদের। কলোনীগুলোর সংস্কার হয়ে কাঁচা বাড়িঘর ক্রমশ বহুতল হয়েছে, পুরনো বাসিন্দারা অনেকেই জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন এবং নতুন নতুন আবাসিকরা এসেছেন। ফলে অতীতের রাজনৈতিক প্রভাব ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। এক কথায় নতুন বাসিন্দা নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের আবেদন কোনও কাজে লাগছে না। প্রজন্মের পার্থক্য ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। এমনকি যে সব কমরেডরা সামাজিক সংগঠন করতেন, সেই সংগঠনে তারা বয়সের কারণে সম্পাদক থেকে সভাপতি/সহ সভাপতি হতে থাকলেন। এই বন্ধ্যাত্ব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আঞ্চলিক কমিটি স্থানীয় স্তরে পৌর সমস্যা সংক্রান্ত দাবি এবং রাজ্য সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে সচেষ্ট হয়। যেমন জলকর ও অতিরিক্ত পৌরকর বিরোধী আন্দোলন, বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি এবং সাগর দত্ত হাসপাতাল বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ইত্যাদি। তবে বিরোধী দল হিসাবে তৃণমূল এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে আমাদের গড়ে ওঠা আন্দোলনের সব ফসল ওদের ঘরে গিয়ে উঠলো। ২০০৫ সালে পৌরসভা নির্বাচনে ২৩ ও ২৭নং ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়েছিল, ভোটের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৬০ এবং ১৮০।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিল। কয়েকজন চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেল বা রাজনীতি তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। বেশিরভাগ সংগঠকদের বয়স বাড়তে থাকলো। নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। দু’একজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যুবক আসছেন। কিন্তু এরা নির্দিষ্ট পাড়া বা ওয়ার্ডের নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা। ব্যতিক্রম ২৭নং ওয়ার্ড কয়েকজন পার্টি কর্মী এই ওয়ার্ডে আছেন, সবাই সমানভাবে সক্রিয় নন। সাধারণ বন্ধু এবং আত্মীয় পরিজনের ভোটেও ভাঁটা শুরু হল। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, নাগরিক সংগঠন ইত্যাদি গড়ে তোলার উদ্যোগ চললো।
টিএমসি ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী পক্ষের আঙিনা আরও ছোট হয়ে গেল। ২০২১ নির্বাচনে ভুল ‘বিজেমূল’ তত্ত্বের জেরে সিপিএম বিধানসভায় শূন্য হয়ে গেল। বিধানসভা নির্বাচনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রচারকে কেন্দ্রীভূত করা হল। এই প্রেক্ষিতে সমাজে উদারনৈতিক একটা ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূল ‘লেফট অফ সেন্টার’ এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে হারের পর তৃণমূল অতীতের ‘ভুল সংশোধন’ করেছে। কিন্তু পুরসভা নির্বাচনে বোঝা গেল কিছু খয়রাতি সংস্কার চালু করলেও তৃণমূল আছে ‘তৃণমূলেই’। অন্যদিকে বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার পর সিপিএম ইদানিং রাস্তায় নেমে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াই শুরু করেছে, রাজ্যে ক্রমশ প্রধান বিরোধী পক্ষের দল হিসাবে উঠে আসছে। বিজেপি’র ভোটে ভাঁটার টান। টিএমসি’র চাপ থাকা সত্ত্বেও পুরসভায় সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট অনেকটা বেড়েছে। কামারহাটি পৌরসভায় সিপিএম পেয়েছে ৩৩,৮৭৩ (১,৬৯৮ সিপিআই) ভোট। বিধানসভা থেকে ৫,৫৬৩ ভোট বেশি। বিপরীতে বিজেপি পৌরসভায় ভোট পেয়েছে মাত্র ৮,০৪৪ যা বিধানসভা থেকে ৩০,৩৫৩ ভোট কম। কংগ্রেস (জোট হয়নি) পেয়েছে ১,৫৯৭ মাত্র। আমাদের প্রার্থী সংখ্যা ও ভোট উভয়ই কমেছে।
বাংলায় শহরের রাজনীতিতে পার্টিকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে হবে। অতিমারী, ঝড় ও বন্যায় ত্রাণ দেওয়া বা লাইব্রেরির মতো সংস্কারের কাজ চলবে, কিন্তু এই কাজগুলো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু প্রভাব ফেলতে পারে না, ‘রেড ভলান্টিয়া,’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শহরে পার্টিকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে গেলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসাবে সামনে আসাটাই আশু চ্যালেঞ্জ।
এই প্রশ্নে অতীতের কর্ম পদ্ধতি ও কৌশল কিছু দিক নির্দেশ করতে পারে। যেমন ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্র ও বামফ্রন্ট সরকারের অপশাসন, দমন পীড়ন ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান বিরোধী দল হিসাবে পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। গ্রাম বাংলায় খাসজমি দখল কিংবা বর্গাজমির ইঞ্জাংশন মুক্ত করার বা মজুরি বৃদ্ধির দাবির পাশাপাশি শহরে বর্ধিত বাসভাড়া হোক অথবা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা দরকার। ফ্যাসিবাদী মোদী সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যের অপরাধী রাজনীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে পার্টির সমস্ত ইউনিট ও গণসংগঠন যেভাবে দ্রুততার সাথে রাস্তায় নামে তা প্রশংসনীয়। রাজ্যেও টিএমসি সরকারের তোলাবাজি, দমন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দ্রুততার সাথে রাস্তায় নেমে পার্টির প্রতিষ্ঠান বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের গরিমাকে সামনে আনতে হবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পার্টির শারীরিক ভাষারও পরিবর্তন ঘটবে। ছাত্ররা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি ক্যাম্পাসে যাক, ট্রেড ইউনিয়ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিতরে সক্রিয় হোক, যুব সংগঠন চাকরির দাবিতে রাজপথে ধর্ণায় থাকুক, মহিলা সংগঠন নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় সময়মত হস্তক্ষেপ করুক, কৃষক ও কৃষিমজুর সংগঠন মাঠে নামুক নিজেদের দাবি নিয়ে। বিহার নির্বাচনে ফলাফলের দৌলতে পার্টির প্রোফাইল নিঃসন্দেহে বেড়েছে, কিন্তু তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়া দরকার। দেশ ও বাংলার গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে পার্টি সবার সামনে থাকুক।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত