বাবুল সুপ্রিয় এবার তৃণমূল প্রার্থী বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে।
পশ্চিমবাংলায় ‘আয়ারাম-গয়ারাম’ রাজনীতির বাজারে এখন দাঁও মারছে তৃণমূল। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফায়দা লুটছিল বিজেপি। তখন তৃণমূলের একঝাঁক মাফিয়া-দুর্নীতিবাজ সাংসদ-বিধায়ক ভিড়েছিল বিজেপিতে। ক্ষমতার আভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ির কারণে আর বিজেপির হাতছানিতে। তথাপি বিজেপির কাছে অধরা থেকে গেল বাংলার ক্ষমতা দখল। তারপর থেকে ঘটছে বিপরীতমুখী দলবদলুর ঘটনা — বিজেপি থেকে তৃণমূলে যাওয়ার। প্রথম প্রথম ফেরানো শুরু হয় বিজেপির টিকিটে হেরো প্রাক্তন তৃণমূলীদের। তারপরে আর অচ্ছ্যুৎ থাকছে না বিজেপির কেউকেটারা। প্রসঙ্গত আপাতত সবচেয়ে দর ওঠা ‘ঘোড়া’ বাবুল সুপ্রিয়। একটু ফিরে দেখা যাক। ‘বাম-ডান’ নানারঙের একের পর এক দল ধরা-ছাড়া বাংলার এক বলিউডি অভিনেতা ২০২১-এর নির্বাচনের আগে ‘ছোবল’ মারতে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন। সেটা যেমন বাংলার শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মেনে নেয়নি, তেমনি দরকষাকষির সংঘাতে বিজেপি ছাড়া বলিউডি গায়ককে তৃণমূলে নেওয়ার বাজি বাংলার বিবেক কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারে না। তৃণমূল নিজেকে ‘নির্ভেজাল ধর্মনিরপেক্ষ’ দাবি করলেও ধরা পড়ে যাচ্ছে তার জালিয়াতি জুয়াচুরি। এই সেদিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপির কট্টর প্রতিভু হয়ে থাকা গায়ক তৃণমূলে জায়গা পেয়ে গেলেও তার চরিত্র পাল্টে যায় না। বরং এই ঘটনায় উন্মোচিত হচ্ছে তৃণমূলের চোরা আপসকামী অবস্থান। বাবুলকে মনোনীত করা আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের উদার ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ, বিশেষত সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনতা কিছুতেই মেনে নেবে না। তাদের কার্যত অপমান করা হল। কারণ, ২০১৮-র মার্চে আসানসোলে সংঘটিত দাঙ্গার রাজনীতির দগদগে স্মৃতি মোছার নয়। যে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আগ্রাসনে বর্ণনাতীত ধ্বংসকান্ডের তান্ডব চলেছিল, এক ইমামের তরুণ তাজা ছেলের জীবন কেড়ে নিলেও ঐ গভীর শোকাহত ইমাম সাম্প্রদায়িক সংঘাতের অবসানের আবেদনে অটল ছিলেন, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আগুন জ্বালানোয় বিজেপির হাত ছিল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল, ভোটের মেরুকরণের জিগির তুলতে — ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে বিজেপির উপর্যুপরি দখল রাখতে। ঐ অভিযানে সাংসদ বাবুলই ছিলেন বিজেপির মূল পান্ডা, যার ভূমিকা ছিল হিন্দুত্ববাদী মাফিয়ার মতোই। ফিরে দেখার ক্যামেরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলে কী মনে পড়ায়! বাবুল সেখানে সদলবলে গিয়েছিলেন জবরদস্তি হিন্দুত্বের রাজনৈতিক শক্তিপ্রদর্শন করতে, তার ফলে সম্মুখীন হয়েছিলেন ছাত্রদের প্রতিবাদী ঘেরাওয়ের, ফ্যাসিস্ত প্রতিক্রিয়ায় প্রগতিবাদী ছাত্রসমাজকে ‘দেখে নেওয়া’র হুমকি দিয়েছিলেন, তার পরিত্রাতা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন খোদ রাজ্যপাল ধনকড়। ঘটনাপ্রবাহ আরও গড়ায়।
বাংলার ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মূল রণধ্বনি উঠেছিল ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে রুখে দাও! সেটা সম্ভবও হয়েছে। সফল হয়েছে এমনকি টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রেও, যেখানে বিশেষত টলিউড কাঁপাতে বিজেপি প্রার্থী করেছিল বলিউড নাম ভাঙানো বাবুলকে। বিজেপির প্রার্থীকে টালিগঞ্জ কেন্দ্রের ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক চেতনা পরাজিত করে জবাব দিয়েছে। অথচ বছর না ঘুরতে তাঁকেই আবার বালীগঞ্জ কেন্দ্রে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে দিল তৃণমূল! বালীগঞ্জ কেন্দ্রের নাগরিক সমাজের ব্যাপকাংশ ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল বিজেপিকে রেয়াত করে না। সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস সংখ্যাগতভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কেন্দ্রের লাগোয়া পার্কসার্কাস অঞ্চলে লাগাতার সংঘটিত হয়েছে সিএএ-এনআরসি বিরোধী “শাহীনবাগ” ধাঁচের আন্দোলন। এই সবকিছুর বিপরীতমুখী হয়ে টালিগঞ্জে হারানো প্রার্থীকে এবার বালীগঞ্জে প্রার্থী করার ‘সঠিকতা’র প্রমাণ দিতে উঠেপড়ে লাগবে। সবই ‘মাননীয়া’র অনুপ্রেরণায়। কিন্তু ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে করা এইসমস্ত পদক্ষেপ টালীগঞ্জ-বালীগঞ্জের নাগরিক চেতনার বিরোধী — বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মনোভাবকে অপমান করার সমার্থক। এ বরদাস্ত করার নয়।