‘পরিবেশ’ বলতে বোঝায় জল, মাটি ও বাতাস এবং এসবের নিজেদের মধ্যে ও এসবের সাথে মানুষের ও অন্যান্য সমস্ত জীবজগৎ ও অণুজীবজগতের সামগ্রিক পারস্পরিক সম্পর্ক ও বৈশিষ্ট্যসমূহকে। কয়লাখনি পরিবেশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। কোল ইণ্ডিয়ার পক্ষ থেকে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে কয়লাখনির পরিকল্পনা রচনার আগেই পরিবেশ সংক্রান্ত প্রভাব খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু দেউচা-পাঁচামী প্রকল্পে সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত কোনওরকম সমীক্ষাই করা হয়নি। তবু আমরা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের তোলা প্রশ্নগুলি সাধারণ বুদ্ধিতে বিবেচনা করে দেখতে পারি এবং অন্যান্য খোলামুখ খনি অঞ্চলের অভিজ্ঞতা খতিয়ে দেখতে পারি। বহু হাজার মানুষ উচ্ছিন্ন হবে এবং উচ্ছেদ হবে বহু ধরণের স্তন্যপায়ি ও অন্যান্য পশু ও পাখি। বিপুল পরিমাণ গাছ-গাছালি হারিয়ে যাবে, এবং নষ্ট হয়ে যাবে বিশাল পরিমাণ ক্ষেতের মাটি বা ‘টপ সয়েল’ যা বহু যুগ ধরে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠে। এইসব তাৎক্ষণিক ও স্থানীয় প্রভাব ছাড়াও বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র, কৃষি, জল ও আবহ মণ্ডলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। বায়ু দূষণের প্রভাব রামপুরহাট, বোলপুর, সিউড়ি সমেত অনেক দূরের শহরেও পৌঁছবে।
খনি লাগোয়া সব গ্রামগঞ্জ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে
খনি লাগোয়া বসতি থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে হবে সকলকে। ব্যাসল্ট পাথর সরাতে মুহুর্মুহু ব্লাস্টিং বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ এবং ভূকম্পন জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। চারপাশে জমে উঠবে ওভার বার্ডেনের ধূলো-বালির পাহাড়। মাটির তলা থেকে উঠে আসা মাটি-পাথরের সাথে মিশে থাকা বিভিন্ন বিষাক্ত ও ধাতব যৌগের কণা বৃষ্টিতে ধুয়ে ছড়িয়ে পড়বে বহুদূর পর্যন্ত, বিষিয়ে তুলবে ভূপৃষ্ঠ ও জলাধার। গবাদি পশু সহ সমস্ত পোষ্য ও অন্যান্য জীবকুলকে বিপন্ন করে তুলবে। খোলামুখ খনি যত গভীর হবে তত নেমে যেতে থাকবে ভূগর্ভস্থ জলস্তর, টিউবওয়লে আর খাবার জল পাবে না গ্রামবাসীরা। সামাজিক জীবনও আর আগের মতো থাকবে না। সস্তায় জমিজমা বেচে দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হবে। পাশের জেলা পশ্চিম বর্ধমানের রাণীগঞ্জ কয়লাখনি এলাকার দিকে তাকালেই এই হাহাকার স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।
ঝাড়খণ্ডের কয়লাখনি এলাকার একটি সমীক্ষার রিপোর্ট
ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলায় চাহরি কয়লাখনির আশপাশের গ্রামগুলিতে চালানো একটি সমীক্ষার সদ্য প্রকাশিত রিপোর্ট আমাদের সামনে আছে। এখানকার বাতাস, মাটি ও জলের নমুনা সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে,
এই সমীক্ষা রিপোর্টে কয়লাখনির চারপাশের গ্রামগুলির জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে,
এই ধরনের সমীক্ষা ও তা থেকে বেরিয়ে আসা সত্য নতুন কিছু নয়। এলাকা জুড়ে খোলামুখ কয়লাখনির বিষাক্ত প্রভাব চর্চিত ও পরীক্ষিত সত্য। কয়লা খনন, পরিশোধন ও দহন — এই পুরো প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপই যে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও অধিবাসীদের জন্য ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর তা সর্বজনবিহিত সত্য। দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা কয়লাখনি প্রকল্পের ধ্বংস সাধনের মাত্রা অনেক বেশি হবে, মূলত এই খোলামুখ খাদানটির অবিশ্বাস্য গভীরতা, ব্যপ্তি ও ভূতত্ত্বের কারণে।
দেউচা ব্যারেজ, তিলপাড়া ব্যারেজ ও ম্যসাঞ্জোর ব্যারেজ এবং দ্বারকা নদীর অস্তিত্ব সংকট হতে পারে
দেউচা ব্যারেজ কি টিকে থাকবে? থাকলেও তার জল কি ব্যবহারযোগ্য থাকবে? প্রস্তাবিত খনির গায়েই দ্বারকা নদীর ওপর দেউচা ব্যারেজ। দক্ষিণে ১৪ কিলোমিটার দূরে ময়ুরাক্ষী নদীর ওপর তিলপাড়া ব্যারেজ এবং পশ্চিমে ৩৭ কিলোমিটার দূরে ম্যাসাঞ্জোর। গভীর গর্তে বিস্ফোরণের ফলে জলাধারগুলির দেওয়ালের সহন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এবিষয়ে গবেষণাপত্র আছে। দেউচা প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই প্রভাব অনেকগুণ বেশি হওয়ার কথা এর অস্বাভাবিক গভীরতা ও শক্ত পুরু পাথরের স্তরের কারণে। ব্যাসল্ট পাথরের বিপুল পুরু স্তর চূর্ণ করতে উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে বছরের পর বছর। মাটির অনেক গভীরে এই বিস্ফোরণ ঘটবে। অনেকটা পরিধি পর্যন্ত তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাবে। দেউচা, তিলপাড়া ও ম্যাসাঞ্জোরে তার প্রভাব কী দাঁড়াবে?
ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভ জল উৎসে মারাত্মক প্রভাব পড়ে
মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে জলের উৎসগুলির ওপর। ভূপৃষ্ঠের জল এবং ভূগর্ভস্থ জল, উভয়ের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। খনিকার্যের বর্জ্য মিশ্রিত জল উপচে বা চুঁইয়ে আসা, ভূমি ক্ষয়ে যাওয়া, জলের তলদেশে বিভিন্ন ভারী গুঁড়ো থিতিয়ে আস্তরণ তৈরী হওয়া, খনিজাত অ্যসিড প্রবাহ, জলস্তর নেমে যাওয়া, জলচক্র ও বৃষ্টিপাতের সাম্য অস্থির হয়ে পড়া ইত্যাদি কারণগুলিকে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এসবের মধ্যে অ্যসিড প্রবাহ সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টিকারী। জলের উৎসের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক, বহু দূর ব্যাপী বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে খনিজাত অ্যসিড প্রবাহ। খনির যে কোন অংশ থেকে যে কোনোভাবে সালফেট যুক্ত পদার্থ বাতাস ও জলের সংস্পর্শে এলে সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই অ্যসিড মিশে যায় ভূপৃষ্ঠের জলে, খাল বিল নদী নালার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নামোর দিকে বহু দূর পর্যন্ত। সমস্ত জলজ প্রাণী তো বটেই, কৃষির ওপরও তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। সমস্ত খনন কাজেই এইভাবে অ্যাসিড প্রবাহ ঘটে। খোলা খাদানের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি হয়। দেউচা-পাঁচামী’র ১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১ কিলোমিটার গভীর গর্ত খুড়ে যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের পাহাড় চারপাশে জমা হবে সেখান থেকে বৃষ্টির জলধারা বেয়ে, হাওয়ায় উড়ে দ্বারকা নদী আর দেওচা ব্যারেজের ক্যানেল বরাবর অ্যাসিড প্রবাহ বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের কৃষি-জীবনকে কত বছর ধরে ক্ষতগ্রস্ত করতে পারে তা ভেবে দেখা দরকার।
বিস্তীর্ণ এলাকায় জলসংকট দেখা দেবে
ভূগর্ভস্ত জলও দূষিত হয়ে পড়ার নানারকম সম্ভাবনা থাকে যেগুলি ভূপৃষ্ঠের জলের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম। কিন্তু তাৎক্ষণিক বড় সংকট দেখা দেবে জলস্তর নেমে যাওয়ায়। খনিগর্ত ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে (ওয়াটার টেবিল) ছেদ করলে জল জমা হতে থাকে। খনিগর্তে জমা এই জল ছেঁচে বের করা হয়। শুধু ছেঁচে শেষ হয়না, শুষে বের করতে হয়। অর্থাৎ একটার পর একটা জলস্তরকে শেষ করতে করতে গভীরে যাবে এই খোলা খাদান। চারপাশের এলাকার ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যেতে থাকবে। খনিবিদেরা এই ঘটনাকে ইংরেজিতে বলেন ‘ড্র-ডাউন’। কত বড় পরিধি জুড়ে এই অধপতন হবে তা নির্ভর করে ওই অঞ্চলের উদস্থিতি ও ভূতত্ত্ব এবং খনির আকার আকৃতির ওপর। দেউচা-পাঁচামী এলাকার পাথর খাদান সংলগ্ন গ্রামগুলিতে জলস্তরের এই অধপতন এখনই দেখা যায়। পাথর খাদান হয় মূলত ভূপৃষ্ঠে উঁচু হয়ে বেরিয়ে আসা পাথুরে এলাকায় (তাই এলাকার চলতি ভাষায় এইসব খাদানকে ‘পাহাড়’ বলা হয়)। তাতেই দেখা যায় গ্রামের টিউব-ওয়েলে জল আসে না; আরও গভীর লেয়ার থেকে সাব-মার্শিবল পাম্প দিয়ে কিছুক্ষণ জল তোলার পর ঘণ্টা দুয়েক বন্ধ রাখলে তবেই আবার জল পাওয়া যায়। এক কিলোমিটার গভীর যে কয়লা খাদান করবে বলছে, তা কত দূর দূর পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে জলসংকট ঘটাবে সেসব এখনও ভেবেই দেখেনি সরকার, সমীক্ষা করে তা জনসমক্ষে আনা তো অনেক দূরের কথা।