আলপথ থেকে রাজপথে : ছাত্র-যুব প্রতিরোধে
From sidewalks to highways

১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। কনকনে শীত উপেক্ষা করে উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপ নগরে একদল ছাত্র থানায় গিয়েছিল খাবার আর কেরোসিনের দাবি জানাতে। গুলি চালিয়েছিল পুলিশ, লুটিয়ে পড়েছিল নুরুল ইসলামের দেহ।

নিথর হয়ে আনিসের দেহটাও পড়েছিল উঠোনে। পুলিশের পোশাকে চারজন বাড়িতে এসে ছাদ থেকে ফেলে খুন করেছে হাওড়ার আমতার আনিস খানকে। আনিস সমস্ত অন্যায়ের দাবিতে মিছিলে হাঁটতো। এলাকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলতো। কোভিডের সময় এলাকায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি প্রশাসনিক মদতে জমি মাফিয়াদের হাতে চলে যাওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আর শাসক, সে সহ্য করতে পারে না বিরুদ্ধতার তেজকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা তার কাছে গর্হিত অপরাধ। তাই খুন হয়ে যেতে হল আনিসকে। কারা খুন করলো? পুলিশের পোশাকে এসে খুন করে গেল আততায়ীরা। রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠল, রাস্তায় প্রতিদিন যৌবনের স্পর্ধার মিছিল, আবার পুলিশের হামলা, গ্রেপ্তার। গোটা রাজ্যেই যেন প্রিজন ভ্যান গিলতে আসছে। যেন পুলিশ স্টেট হয়ে উঠছে। কামালগাছিতে একটি কর্মসূচি থেকে গ্রেপ্তার করা হলো আইসার ছাত্রছাত্রী ও প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেত্রী-কর্মী ও অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সাথীদের। মিথ্যা মামলায় জেলে ঢোকানো হলো। দেউচা-পাঁচামীতে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হল। একের পর এক নমুনা।

দেশজোড়া বিজেপি’র বিপর্যয়কে রুখতেই এইরাজ্যের মানুষ গণরায় দিয়েছিল ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ক্ষমতায় ফিরে এসে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেকে ভাবতে শুরু করেছে একমেবোদ্বিতীয়ম্। তার স্বৈরাচারী দাঁত-নখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গণআন্দোলনের ওপর। তৃণমূল নেত্রী হুঙ্কার ছাড়ছেন, তাকে আন্দোলন শেখানো যাবে না। তিনি আন্দোলন করেই ক্ষমতায় এসেছেন, তাই তিনি নাকি জানেন রাস্তা অবরোধ করাটা ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’! এসব রোষ দেখিয়ে তিনি অস্বীকার করছেন ইতিহাসের দেওয়াল লিখন পড়তে।

আন্দোলনের চাপে রাজ্য সরকার ‘সিট’ গঠন করলেও, তার মাথায় বসানো হয়েছে, রিজওয়ানুর কান্ডে চূড়ান্ত ন্যক্কারজনক ভূমিকা রাখা পুলিশ অফিসারকে। পনেরো দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এখনো কোনো দোষী গ্রেপ্তার হয়নি! সিট ইতিমধ্যে অন্যখাতে তদন্তকে ঘোরাতে বলতে শুরু করেছে, আনিস নাকি ছাদের পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেছে। বস্তুত তাদের বাড়ির গায়ে ওপর থেকে নামানো কোনও পাইপ লাইন নেই। এহেন মিথ্যাচারের মাধ্যমে পুলিশ-প্রশাসনকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।

কিন্তু ছাত্র-যুবদের নাছোড় লড়াই একটা কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে, আনিস আর কেবল ব্যক্তি নয়; আনিস এখন লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে গেছে। তৃণমূল সরকারের গণআন্দোলন ও বিরোধীদের প্রতি দমননীতির সামনে এখন বড়ো প্রতিবন্ধক আনিসের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে লড়াই। বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং সেই তদন্ত প্রক্রিয়াকে সাধারণ্যের গোচরে এনে তবেই নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে। এই দাবি এখন জোরালো হচ্ছে। যদি প্রশাসনের হাত না থাকে, তাহলে পুলিশের পোশাক আততায়ীদের কাছে এলো কীভাবে? পুলিশের বড়ো কর্তারা এবং শাসক দলের নেতৃত্বের যে আঁতাত লাগাতার স্পষ্ট হচ্ছে, তারই পরিণতি আনিসের হত্যা!

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এখন গোটা দেশজুড়ে নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা চালালেও এই রাজ্যে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের স্বরূপটা প্রকট হচ্ছে। আর রাজ্যের গণতন্ত্র রক্ষার সামনের সারির নেতৃত্বে অবশ্যই এখন এই রাজ্যের ছাত্র-যুবরা। আর তাই বারবার ছাত্র-যুবদের ওপরেই নেমে আসছে তৃণমূলের এবং প্রশাসনের যৌথ আক্রমণ। নরেন্দ্রপুরে আইসা কর্মীদের গ্রেপ্তারিই হোক অথবা আনিসের হত্যার বিরোধীতা করতে গিয়ে বাম যুব নেতৃত্বের গ্রেপ্তারি, রাজ্য সরকার প্রমাণ করে দিচ্ছে রাজ্যে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে এই বাংলায় বারবার মানুষ শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। একসময় যারা “আমরা ২৩৫, ওরা ৩০” হুঙ্কার দিয়েছে, তাদের পরিণতিটা ভুলে যাচ্ছেন ২১৬’র দর্পে দামামা বাজানো তৃণমূল! এই চরম দমনের মুখেও ছাত্র-যুবরা তাদের ছকভাঙা লড়াই জারি রেখেছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশী দমন নিপীড়ন সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোর কলেজ স্ট্রিটে বিশাল সমাবেশ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে আনিসের হত্যার ইনসাফ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা ছাড়া হবেনা। পুলিশ এখন যে কোনো মিছিল এবং সমাবেশেই জলকামান, টিয়ার গ্যাস শেল সমেত রণসাজে সেজে থাকে। তবুও চোখে চোখে রেখে ব্যারিকেড গড়ার কাজ চলছে, এই রাজ্যের ছাত্র-যুবদের একরোখা লড়াই চলছে।

- নীলাশিস বসু

খণ্ড-29
সংখ্যা-10