২১ মার্চ চাকদহ শহরের সম্প্রীতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পঞ্চদশ নদীয়া জেলা সম্মেলন। শুরুতে রথতলা মোড়ে কমরেড বিধান মজুমদারের শহীদ বেদীতে মাল্যদান, পতাকা উত্তোলন সহকারে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের পর প্রতিনিধিরা মিছিল করে সম্মেলনস্থলে আসেন। ’৭০ দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যুক্ত চাকদহের যুবক বিধান মজুমদারের এই শহীদ বেদী নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এই মহৎ কাজে এলাকার মানুষের ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। স্মরণ অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও এলাকার বেশ কয়েকজন মানুষও অংশগ্রহণ করেন। বেদীর পাশে এক স্মরণিকা বোর্ডে লেখা হয়েছিল “কমরেড বিধানের নির্মম হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ঘাতকেরা ছিল লাল জামা গায়। পরে রাজ্যজুড়ে তাদেরও নিধন করে আধা ফ্যাসিবাদী শাসকেরা”। এই কর্মসূচি এলাকার মানুষের মধ্যে ভালো ছাপ ফেলে।
সুবিমল সেনগুপ্ত নগর, বানের সেখ সভাগৃহ ও বিধান মজুমদার মঞ্চ নামাঙ্কিত হলে সম্মেলনের শুরুতে শোক প্রস্তাব এবং বাবুনি মজুমদারের গানের পর প্রতিবেদন পেশ করা হয়। এরপর রাজ্য পর্যবেক্ষক সজল অধিকারী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য সম্ভাবনার জায়গাগুলো খুলছে। কিন্তু গণকাজ বা গণরাজনৈতিক কাজের অনুশীলন গড়ে তুলতে না পারলে আমরা সেটা ধরতে পারব না, তাই একে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীয়া জেলায় ভৌগলিকভাবে দুই অংশের একদিকে বিজেপি’র আধিপত্য অপর দিকে তৃণমূলের প্রভাব বিগত বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছিল। বিজেপি মতুয়া ও উদ্বাস্তু মানুষদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটা পাল্টাচ্ছে। বামপন্থীরা একটি পুরসভায় তাদের ক্ষমতা ধরে রেখেছে। সেখানে তৃণমূলের সন্ত্রাস মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ লক্ষ্য করা গেছে, যা ইতিবাচক।
প্রতিবেদনে তৃণমূল সরকারের সংস্কারমূলক প্রকল্পগুলি সম্পর্কে বলা হয় এগুলিকে সম্পূর্ণ নাকচ করা বা ‘ভিক্ষা’ ইত্যাদি বলার পরিবর্তে সেগুলিকে মানুষের অধিকার হিসাবে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পগুলির সীমাবদ্ধতা, পরিমাণে স্বল্পতা এবং ব্যাপক সংখ্যক মানুষের বঞ্চিত থেকে যাওয়ার দিকগুলিকে সামনে নিয়ে এসে জনগণের মধ্যে প্রতিবাদের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। উপর থেকে তৃণমূলের জয়জয়কার মনে হলেও একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে বহু মানুষ ঘুরছে, দলবাজির ফলে বহুসংখ্যক মানুষ বঞ্চিত। জনগণের মধ্যে যে প্রশ্নগুলি উঠে আসছে তা হল ইতিপূর্বেই চালু থাকা বিভিন্ন প্রকল্পগুলিকে বন্ধ করা হলো কেন? যাদের পাওয়ার কথা নয় সেই কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা সুযোগ সুবিধাগুলি আত্মসাৎ করছে কেন? দুর্নীতি রোধ করতে গণতদারকি বা হিসাবের বিভিন্ন তথ্য জনগণকে জানানো হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নগুলি তুলে ধরে আমরা প্রকল্পগুলির স্বরূপ জনপ্রিয়ভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারি। এগুলির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরও গভীর অনুসন্ধানের করার কথা প্রতিনিধিরা বলেন। কেউ বলেন, কেবল কাগজে কলমে লিখলেই চলবে না। লেখাটা সহজ, আসল কাজ হল হাতে কলমে আন্দোলন গড়ে তুলে বিরোধী পক্ষের ভূমিকা নেওয়া। কেউ বলেন, মানুষ আমাদের চাইছে কিন্ত আমাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও কাজের একতা গড়ে তুলতে হবে। ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতি, ভাগচাষি-লিজচাষিদের অধিকার আদায় প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রসঙ্গ, তৃণমূলের শাসনে সন্ত্রাস ও সংস্কার উভয়কে একসাথে মোকাবিলা করে গণউদ্যোগ বিকাশ ঘটানো, নেতৃত্বের অগ্রণী ভূমিকা, জনগণের বিভিন্ন রকম সমস্যায় তাদের পাশে নেতৃত্বের দাঁড়ানো প্রভৃতি প্রশ্নগুলিতে বিভিন্ন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। নেতৃত্বের কাজের ধারা নিয়ে, কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে তীব্র সমালোচনা-আত্মসমালোচনা সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
বিগত দিনে আন্দোলনের কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। যথা ধুবুলিয়ার নওপাড়া অঞ্চলে ১০০ দিনের কাজ, ধান কেনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৃণমূল পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে শতাধিক জমায়েত করে আক্রমণাত্মক প্রচার গড়ে তোলা, বেথুয়াডহরীতে লকআপ হত্যার বিরুদ্ধে তৎপরতা ও সাহসের সাথে রুখে দাঁড়ানো। শালিগ্রামে জনপ্রিয় ইস্যুতে নানাধরনের গণউদ্যোগে তৃণমূলকে চাপে ফেলে দেওয়া, একটি বুথে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে শাসকদের চ্যালেঞ্জ জানানো ইত্যাদি ইত্যাদি এই অনুশীলনগুলিকে শ্রদ্ধা করতে হবে, শিক্ষা নিতে হবে। ভুক্তভোগী মানুষ বিভিন্ন প্রশ্নে প্রতিবাদ করছেন, সেখানে আমরা উপস্থিত থাকতে পারছি কিনা সেটা দেখতে হবে।
সাংগঠনিক প্রশ্নে নিচুতলায় পার্টি ব্রাঞ্চ গঠনের উদ্যোগ, সদস্য সংখ্যার অনুপাতে একটি গ্রামে দুটি ব্রাঞ্চ করা এই ধরনের বিষয়গুলি রিপোর্ট রেখে বলা হয়, সদস্যদের ব্রাঞ্চভুক্ত করার কাজ কিছুটা এগোলেও এখনও অনেকটাই বাকি। সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের স্ক্রুটিনি করার কাজ হাতে নিতে হবে। নিচুতলা থেকে পার্টির ভিত্তি শক্তিশালী করে তুলতে হবে। জমায়েত ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্বকে দুই তিনজন সক্রিয় কর্মীদের নিয়ে চলার অভ্যাস পরিহার করা, কমিটি কাঠামোগুলির বারংবার বৈঠক করে সমস্ত সদস্যদের সাথে একাত্মতা বাড়িয়ে তোলার কাজের রীতি আয়ত্ব করতে হবে।
সম্মেলনের সভাপতি মন্ডলীতে ছিলেন ধনঞ্জয় গাঙ্গুলি, আলতাফ হোসেন, সালেমা বিবি, পরিক্ষিৎ পাল, অমল তরফদার। বক্তব্য রাখেন পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু, রণজয় সেনগুপ্ত। শুরুতে শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রাজ্য কমিটি সদস্য দিবাকর ভট্টাচার্য। পরিশেষে ২৫ জনের জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়। জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন জয়তু দেশমুখ। ৪টি আশু কর্মসূচি গৃহীত হয় তার অন্যতম হল — ২৮-২৯ মার্চ দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট সফল করে তোলা। ধর্মঘটের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার জন্য তৃণমূল সরকার যদি আক্রমণ নামিয়ে আনে তার বিরোধিতা করে ধর্মঘটের দিন সিপিআই(এমএল) তার শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের সাথে মিলে পথে নামবে।
তৃণমূল সরকারের বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের পোশাক নিয়ে ফতোয়া জারি করা, সমাজের সর্বস্তরে ক্ষমতার আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে প্রচার গড়ে তুলবে।