খবরা-খবর
কলকাতা জেলা চতুর্দশ সম্মেলন
Calcutta District Conference

উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে সম্পন্ন হল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কলকাতা ১৪তম জেলা সম্মেলন। ভবানীপুর-কালীঘাট এলাকার জনপ্রিয় প্রয়াত কমরেড অরূপ চ্যাটার্জি (রূপা) নামাঙ্কিত সভাগৃহ (তপন থিয়েটার), কমরেড মিহির রায়চৌধুরী-বরুণ ঘোষ মঞ্চে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শহীদ স্মরণ করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন এলাকার জনপ্রিয় বর্ষীয়ান কমরেড রমানাথ দাস (ছোটনদা)। রাজ্য কমিটি সদস্য অনিমেষ চক্রবর্তী, বাসুদেব বোস, জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, নীতীশ রায়, নিত্যানন্দ ঘোষ সহ একে একে জেলা কমিটির সদস্যবৃন্দ মাল্যদান করেন।

নীতীশ রায়ের উদ্বোধনী গণসঙ্গীত ও রাজ্য কমিটির পর্যবেক্ষক অনিমেষ চক্রবর্তীর উদ্বোধনী ভাষণের পর প্রতিনিধি অধিবেশন শুরু হয়। রাজ্য পর্যবেক্ষক রাজ্য পরিস্থিতি তুলে ধরে পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বিগত বিধানসভা নির্বাচন নিছক রাজ্য স্তরে আটকে থাকেনি, তা রীতিমতো সর্বভারতীয় এক পরিঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আসাম, বিহারের পর এই রাজ্যটাকেও দখল করতে বিজেপি’র সর্বভারতীয় নেতৃত্ব মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যান্য রাজ্যও অধীর আগ্রহ নিয়ে এই রাজ্যের ফলাফলের উপর নজর রাখতে শুরু করে। আমাদের পার্টি তখন এই মারাত্মক বিপদকে রোখার উপরই প্রধান জোর দেয়, সেই অভিমুখেই পরিচালিত হয় আমাদের কর্মকৌশল। বিজেপি’র সেই আশু বিপদকে ঠেকানোর পর এবার আমাদের এই রাজ্য সরকারের ক্রমে উন্মোচিত হয়ে পড়া জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। তবে, মোদী-মমতাকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ গণ্য করে সিপিআই(এম)-র অনুসৃত কর্মকৌশলের সাথে স্পষ্ট পার্থক্য রেখা টেনেই।

বিদায়ী জেলা কমিটির সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী খসড়া প্রতিবেদন সম্মেলনে পেশ করেন। রাজ্যে বিজেপি’র রাজনৈতিক-সাংগঠনিকভাবে যে ধারাবাহিক ক্ষয় শুরু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ও বিপ্রতীপে বামেদের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে সামনে আসার অভিমুখে উঠে আসার কর্তব্য কর্ম প্রতিবেদনে রাখা হয়েছে।

বিগত কয়েকবছর কোভিড গোটা দেশ-দুনিয়া জুড়ে যে মারাত্মক আঘাত হেনেছে অর্থনীতি-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে, তাকেই খসড়ার প্রস্থান বিন্দু করে নতুন কয়েকটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করেছে আগামী কাজের লক্ষ্যে। কলকাতা পার্টির গুরুতর গণবিচ্ছিন্নতা কাটাতে প্রতিটি পার্টি কমিটি ও কাঠামোকে ওয়ার্ড ভিত্তিক কাজের ধারাকে দৈনন্দিন অনুশীলনের অঙ্গ হিসাবে নেওয়া, এক বা একাধিক ওয়ার্ডকে চিহ্নিত করে ধারাবাহিক কাজের পরিকল্পনা করার লক্ষ্যেই ব্রাঞ্চগুলোকে আগামীদিনে কাজ করতে হবে। এর পাশাপাশি, কলকাতার নাগরিক, পরিবেশগত সমস্যার উপর কলকাতা ভিত্তিক এক নাগরিক সনদ সূত্রবদ্ধ করার কাজ আগামী জেলা কমিটিকে করতে হবে।

মিড ডে মিল-সাফাই কর্মী-পরিবহন ক্ষেত্রকে সংগঠিত করার উপর জোর রেখে, ক্রমশ বেড়ে চলা ইনফর্মাল কর্মীদের ইউনিয়ন ভুক্ত করতে খসড়া জোর দিয়েছে।

কোভিডে সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন মহিলা সমাজ অস্বাভাবিক হারে যেভাবে উৎখাত হয়েছেন শ্রমবাজার থেকে, যেভাবে তাঁদের মজুরি কমিয়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, তার উপর বিশেষ কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে খসড়ায়। কলকাতার ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা কোভিড চোখে আঙুল তুলে দেখালো, তার বিপরীতে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনও সামনে এসেছে। কোভিড শিক্ষাক্ষেত্রে যে অকল্পনীয় হারে ডিজিটাল বিভাজন সৃষ্টি করল, তার বিপরীতে পদক্ষেপ ও দাবি-দাওয়া তৈরি করতে হবে।

এবারের খসড়া বিশেষ জোর দিয়েছে কলকাতার আতঙ্কজনক পরিবেশের উপর। জলবায়ু-পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে অ্যাজেন্ডা হিসাবে সামনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সম্মেলন। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির সংগঠিত করা, সামাজিক মাধ্যমের প্রচারকে তীব্রতর করার উপর গুরুত্ব প্রদান, গণসংগঠনগুলোর ন্যূনতম ১০ শতাংশ সদস্যকে পার্টি সদস্যে রূপান্তরিত করা, মহিলা ও তরুণ প্রজন্মকে পার্টিতে বেশি করে নিয়ে আসা প্রভৃতি দিকগুলোর উপর খসড়া জোর দিয়েছে।

৩০ জন প্রতিনিধি, যারমধ্যে ৬ জন মহিলা, প্রতিবেদনের উপর বক্তব্য রাখেন। খোলামেলা পরিবেশে সমালোচনা, বিবিধ পরামর্শ, নানান নতুন দিক থেকে প্রতিবেদনকে আলোকপাত করার এক চমৎকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে বজায় ছিল।

বিদায়ী কমিটির সম্পাদক বিতর্কগুলোর সারসংকলন করে সমালোচনাগুলো গ্রহণ করেন, কমিটির নানান ব্যর্থতার জন্য আত্মসমালোচনা করেন, এবং সবশেষে প্রতিবেদনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

পরিবেশ জীবন জীবিকা ও সার্বিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প বাতিল, আনিস হত্যা ও নরেন্দ্রপুরে পুলিশী নির্যাতন এবং দোষী পুলিশ অফিসারদের শাস্তির দাবিতে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবসান ও শান্তির সপক্ষে এবং আসন্ন ২৮-২৯ মার্চ সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মকভাবে সফল করা — সম্মেলনে এই চারটি উত্থাপিত প্রস্তাব ও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

সবশেষে সম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে ২১ জনের নতুন কমিটি যারমধ্যে মহিলা সদস্য সংখ্যা ৫ এবং জেলা সম্পাদক হিসাবে অতনু চক্রবর্তী পুনরায় নির্বাচিত হন।

সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মোট ৬৫ প্রতিনিধি, ২২ জন পর্যবেক্ষক ও অতিথি। মোট মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন ১৭। সম্মেলন স্থলে দু’টি স্মারকস্তম্ভ করা হয় কালীঘাট চেতলা অঞ্চলের চার শহিদ কমরেড সর্বানী বসু, রঞ্জিত সাহা, পরিতোষ মুখার্জি (ফটিক) এবং পল্টু ভট্টাচার্য’র স্মরণে।

চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, মমতা ঘোষ, দিবাকর ভট্টাচার্য, রণজয় সেনগুপ্ত, রতন রায় — এই পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সভাপতিমন্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করেন, এবং সভাপতিমন্ডলীকে সাহায্য করেন তিন সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি — তরুণ সরকার, অভিজিত সরকার এবং অনন্যা চক্রবর্তী।

আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

খণ্ড-29
সংখ্যা-11