প্রহসনময় পুনরাবৃত্তির দ্বারপ্রান্তে কি বাংলা?
on the verge of ridiculous repetition

আবার তারস্বরে শিল্পায়নের বাদ্যি বাজানো শুরু হলো। যে শিল্পায়নের ভাঙা রেকর্ড রাজ্যবাসী শুনেছিলেন বাম জমানার পড়ন্ত বেলায়, সেই সুরের সাথে তদানিন্তন বিরোধী নেত্রী ও আজকের মুখ্যমন্ত্রীর কতই না মিল!

বাংলা নাকি হবে আগামী দিনে বিনিয়োগের গন্তব্যস্থল — বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও বলেছেন, “সামাজিক সব কাজ আমরা করেছি, এবার শিল্প-কর্মসংস্থান-পরিকাঠামোই সরকারের লক্ষ্য। … স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিকাঠামোতে অনেক কাজ হয়েছে।” তিনি আর কী কী দাবি করেছেন, দেখে নেওয়া যাক।

১) গত দশবছরে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়েছে ৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু কোনও কোনও শিল্পে, তা থেকে গেল অনুচ্চারিত। কর্মসংস্থানই বা কতটা হল, এই বেয়াড়া প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই। নেই, সেই সমস্ত কর্মক্ষেত্রে যারা কাজ পেয়েছেন, তাঁদের বর্গ, কাজের চরিত্র, মজুরির পরিমাণ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

২) মাননীয়া জানিয়েছেন, উক্ত বিনিয়োগের মধ্যে ৩.৪২ কোটি টাকার ঋণ জোগানো হয়েছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে। এখানেও বলা হলো না যে সেই ঋণ পাওয়ার পর আদৌ ওই সংস্থগুলো মুখ তুলে দাঁড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারল কিনা। মাননীয়ার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, ৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্পের মন্ত্রী নারয়াণ রাণে লোকসভায় জানিয়েছেন যে, ২০২১ অর্থবর্ষে গোটা দেশে অতিমারির থাবায় বন্ধ হয় ৬৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্প, (যদিও ওই শিল্পের সাথে যুক্ত উদ্যোগপতিদের দাবি, সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি)। মুখ্যমন্ত্রী ওই সংস্থায় ঋণ জোগানের সংবাদ দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে। কিন্তু রূঢ় বাস্তব হল, মাত্র ৩৬ শতাংশ সংস্থার কপালে ঋণের শিকে ছিঁড়লেও হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি শেষ পর্যন্ত মাথা তুলতে পারে, অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ অধিকাংশ সংস্থাগুলোর ছিল না এই কারণে যে, বাজারে চাহিদার চলতে থাকা নাছোড় মন্দা তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রীবাট্টার ক্ষেত্রে বিরাট এক অনিশ্চয়তা ডেকে এনেছে। গোটা দেশ জুড়েই হাজার হাজার ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলো যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে, তা এমনকি আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা (যেমন আইএলও) দেখিয়েছে। একথা জানিয়েছেন ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান মাইক্রো অ্যান্ড স্মল মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিসের সভাপতি অনিমেষ সাক্সেনা।

৩) মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, দেশীয় শিল্পই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং শিল্প বান্ধব পরিস্থিতি তৈরিতে তিনি বদ্ধপরিকর। কিন্তু, এরই সূত্র ধরে উত্তর পাওয়া যায় না তবে রাজ্যের সাবেক শ্রমঘন দেশীয় শিল্প চটকলগুলো তাঁর উপর্যুপরি তিনবারের মুখ্যমন্ত্রীত্বে কেন এই সংকটাদীর্ণ অবস্থায় দিন গুজরান করছে? কেনই বা কাঁচা পাটের রেকর্ড ফলন হওয়া সত্ত্বেও কাঁচা পাটের অভাবে ঘোর অতিমারির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার হামলায় বন্ধ হল প্রায় ১৫টি চটকল, কর্মচ্যুত হলেন প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক? স্রেফ কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দায় ঠেলে কেনই বা পার পেতে চাইছেন এই সমস্যা থেকে?

মুখ্যমন্ত্রী বিমানবন্দর ও পরিকাঠামোর উন্নয়ন, অন্ডালে কার্গো সুবিধাদান, তাজপুরের বন্দর নিয়ে দরপত্র ডাকা (যেখানে নাকি বিনিয়োগ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা), দেউচা-পাঁচামী ও জঙ্গলমহলে নাকি বিনিয়োগ হবে যথাক্রমে ৩০ হাজার কোটি ও ৭২ হাজার কোটি টাকা, আবেদনের দু’মাসের মধ্যে জমি বরাদ্দ, স্থানীয় সব প্রশাসনে অভিন্ন ফি-নীতির গল্প শুনিয়েছেন। অশোকনগরে তেল, গ্যাস পাইপলাইন, দিঘায় কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন, চর্মশিল্প, সাইকেল তৈরির কারখানা, স্কুলের পোশাক তৈরির জন্য বিদ্যুৎচালিত তাঁত ইত্যাদি ইত্যাদি ... ফর্দের যেন আর শেষ নেই। দেউচা-পাঁচামীতে ‘স্বেচ্ছায়’ জমিদাতাদের তো ‘সব পেয়েছির দেশে’ পৌঁছে দেওয়ার বিরাট ফানুস উড়িয়েছেন। আর রূপকথা শেষ করেছেন, দুষ্টু লোকেদের সবক শেখানোর হুমকি দিয়ে। শিল্পায়নের পথ আগলে ‘অন্যায্য বিরোধিতা’ তাঁর সরকার ‘বরদাস্ত’ করবে না। অর্থাৎ, কোনটা ন্যায্য আর কোনটা অন্যায্য — এবার থেকে সরকারই তার সংজ্ঞা নিরূপণ করে দেবে। এমনকি, তিনি ঠিক করে দিয়েছেন সংগ্রামের রূপও। রাস্তা অচল নিষিদ্ধ। শিল্পায়নের এই নব্য সাধনায় তিনি ঠিক করে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যম কী ধরনের সংবাদ পরিবেশন করবে। শিল্প বৈঠকের মঞ্চ থেকেই তিনি ফরমান জারি করলেন, যে সমস্ত সংবাদমাধ্যম সরকারের ইতিবাচক বা পজিটিভ দিক তুলে ধরবে, তারা পাবেন সরকারি আর্থিক সাহায্য, বিজ্ঞাপন। আনিস খান হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ প্রতিবাদের রিপোর্ট ছাপানোর জন্য উষ্মা প্রকাশ করে রাজ্যে ‘আইন শৃঙ্খলা’ সংক্রান্ত এই ছবি তুলে ধরার জন্য তিনি রীতিমতো ধমক দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে। “এখানে ব্যবসা করবেন, আবার আইন শৃঙ্খলার সমস্যা তুলে ধরবেন, দু’টো একসঙ্গে চলবে না” — এই হল তাঁর নিদান। তিনি স্পষ্ট বুঝিয়েই দিলেন, শিল্পায়নের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে, সংবাদমাধ্যমকেও চলতে হবে পোষ মেনে। রাষ্ট্রের ইশারা অনুযায়ী।

যে কর্মসংস্থানের খুড়োর কল দেখিয়ে তিনি এই শিল্পায়নের গপ্পো ফেঁদেছেন, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না বহু প্রশ্নের উত্তর। প্রথম প্রশ্ন, রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব সমাধানের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত রাজ্য সরকারের বিভিন্ন আধা সরকারি দপ্তরে বা স্বশাসিত সংস্থায় শূন্য পদ ভরাট করা। কোভিডের দু’বছরে স্রেফ প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রায় ২.৫ লক্ষ শূন্য পদে নতুন কর্মপ্রত্যাশীদের নিয়োগ করাটা কেন কর্মসংস্থানের প্রকল্পে পড়বে না? কেন্দ্রে মোদী সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেন বিলুপ্ত করা হল ৫.৫ লক্ষ সরকারি পদ? ১ লক্ষ ৩৯ হাজার খালি পড়ে থাকা ‘গ্রুপ ডি’ পদে কেন লোক নিয়োগ করা হচ্ছে না, যা নিয়ে প্রায় রোজ আন্দোলন হচ্ছে?

বাস্তব এটাই, মমতা সরকার শ্রমের বেপরোয়া ইনফর্মালকরণ অভিযানে নেমেছেন আর তারই নির্মম পরিণতি হচ্ছে সরকারি দপ্তরে মাত্র ৫,০০০ টাকার বিনিময়ে স্নাতকদের নিয়োগের সরকারি ঘোষণা, কলকাতা ও বেঙ্গল পুলিশে যথাক্রমে ৪৫ হাজার ও ৭৫ হাজার শূন্য পদ থাকা সত্ত্বেও চলছে সিভিক পুলিশের ঢালাও নিয়োগ। বিশেষ করে কোভিডের পর ভারতবর্ষের শ্রম বাজারে এসেছে পশ্চাদমুখী এক আতঙ্কজনক পরিবর্তন — অকল্পনীয় হারে বেড়ে গেছে ইনফর্মাল শ্রমিকদের সংখ্যা — কোভিডের আগের তুলনায় কম মজুরিতে যারা কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়াই নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

অসংগঠিত শ্রমিক বা ইনফর্মাল সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যেও রয়েছে স্তর ভেদ — জাতপাত ও ধর্মের ভিত্তিতে। সবচেয়ে ধনী রাজ্য থেকে শুরু করে গরিব রাজ্য নির্বিশেষে তপশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির থেকে আগত শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত! “হু কেয়ারস্ ফর লেবার” (কৃষ্ণা রাম, শিবানি যাদব, ইপিডব্লিউ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পত্রিকায় প্রকাশিত) এক গবেষণালব্ধ ও মনোজ্ঞ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, সমস্ত রাজ্যগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে মোট ৬০-৮০ শতাংশই হলেন তপশিলি জাতি এবং ওবিসি অন্তর্ভুক্ত যারা ন্যূনতম মজুরি পান না। এরমধ্যে পশ্চিমবাংলা সহ দিল্লী-গুজরাট-পঞ্জাব-তামিলনাড়ু-মধ্যপ্রদেশ-উত্তরপ্রদেশে ৭০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক পাননা বিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরি। উক্ত প্রবন্ধ এটাও দেখিয়েছে, সমস্ত সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে দলিত/আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে আগত শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত — মাথাপিছু দৈনিক যে ন্যূনতম মজুরি অদক্ষ শ্রমিকদের প্রাপ্য, এরা তার থেকেও পান অনেক কম। আর, ২ কোটি ২ লক্ষ শহুরে ইনফর্মাল শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি থেকেও পাচ্ছেন অনেক কম টাকা! তপশিলি জাতি, উপজাতি ও ওবিসি থেকে আগত শ্রমিকরা অন্য শ্রেণী-সম্প্রদায় থেকে আসা শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম মজুরি পাচ্ছেন।

বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেউচা-পাঁচামীতে প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পে অত্যন্ত কম মজুরিতে নিয়োগ করা হবে আদিবাসী মজুরদের — মমতার স্বপ্নের প্রকল্পে — আর, যাকে শিল্পায়নের প্রলেপ দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। কর্পোরেট স্বার্থের নতুন সেবক হয়ে এপ্রিলের প্রস্তাবিত শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে তাই মমতা নতুন কলেবরে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে আবির্ভূত হতে চলেছেন।

বিগত কেন্দ্রীয় বাজেট ভাষণের সময় দেশের অর্থমন্ত্রী তাঁর গোটা বক্তৃতায় ‘কাজ’ ও ‘কর্মসংস্থানের’ মনিমুক্ত ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু, একবারের জন্যও সম্পদসৃষ্টিকারী শ্রমিক বা মজুরদের নামোল্লেখ করেননি। এটা কেন্দ্রীয় সরকারের মূল মতাদর্শগত অবস্থানকেই প্রতিবিম্বিত করে। তার আগে মোদীও তাঁর বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করেন, দেশের পরিকাঠামো থেকে শুরু করে শিল্প বিকাশের জন্য তাঁর সরকার কী বিপুল বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এরফলে শিল্প বিকাশ ঘটবে, যার হাত ধরে আসবে কর্মসংস্থানের বিপুল জোয়ার!

ধন্য আশা কুহকিনী!!

আরও বেশি বিনিয়োগ, আরও বেশি শিল্প, তারসাথে পাল্লা দিয়ে নতুন কর্মসংস্থানের এই আষাঢ়ে গল্প ভারতবাসী শুনে আসছে দশকের পর দশক ধরে। উপর তলায় সম্পদ সৃষ্টি ও শিল্প হলে তা নিচুতলায় চুঁইয়ে পড়ার এই তত্ত্ব যে বহুকাল আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে, তা আমাদের নীতিকারেরা আজও স্বীকার করেন না। শুধু অবাক লাগে, বিজেপি বিরোধিতায় যিনি নিজেকে গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য মনে করেন, সেই মমতা আজ মোদীর সেই আর্থিক ন্যারেটিভকে আকঁড়ে এই রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের মরীচিকা দেখাচ্ছেন, নতুন নতুন পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও প্রকল্পই যেন আবার মরা গাঙে তুলবে প্রবল জোয়ারের প্লাবন!

মমতা সরকার এখন পা বাড়িয়েছেন শিল্প স্থাপনের পথে। ঠিক যে পথে পা বাড়িয়ে ৩৪ বছরের বাম সরকার কর্পোরেটমুখী স্বার্থকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারে।

আজ কি ইতিহাসের সেই প্রহসনময় পুনরাবৃত্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলা?

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-9