ভোরের আবছা কুয়াশায় গন্ধটি ঝাপটা মারিয়াছিল। চূত মুকুলের গন্ধ! কাকতালীয়ভাবে দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতেও কী এমনই আম্র মুকুলের মাদকতাময় গন্ধ আর ভোরের কুয়াশা গায়ে মাখিয়া জড়ো হইয়াছিলেন প্রতিবাদীরা ঢাকার রাজপথে!
আ মরি বাংলা ভাষা!
'ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী-মাঠ-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার
কেঁদেছিল পায় —'
এমন নিগূঢ় রোমান্টিকতার কোমল বেদনামাখা রূপকল্প বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষায় সম্ভব! এ ভাষা বিদ্রোহ প্রতিবাদ প্রতিরোধেরও ভাষা! এই ভাষাই কিশোর হৃদয়ে দেশপ্রেমের বীজ বোনে! এক গ্রীষ্মের দুপুরে কিশোর দাদাটি ছোট বোনের হাতের লেখার খাতায় লিখিয়াছিল, “ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান?”। অশ্রুতপূর্ব পংক্তি দুইটি মনে গাঁথিয়া গিয়াছিল। কিন্তু দাদা কেন ঐ কথা লিখিয়াছিল? তাহার উত্তর কয়েক বছর বাদে মিলিয়াছিল। সত্তরের দশকে বাংলার যৌবন শ্রমিক-কৃষকের রক্ত ঘামের ঋণ, কাকদ্বীপের অহল্যা মা, নকশালবাড়ির শহীদ সপ্ত কন্যাসহ বিভিন্ন আন্দোলনের অজস্র শহীদের রক্তঋণ শোধ করিতে জীবন আহুতি দিয়াছিল। এই বাংলার মাটি কম আন্দোলন দেখে নাই! আন্দোলনকারীদের রক্তে বার বার সিঞ্চিত হইয়াছে এই মাটি!
গণতন্ত্রের পীঠস্থান সেই ঐতিহ্যের মাটিতে আজ কীসের চাষ হইতেছে? হিংসার, অসহিষ্ণুতার, সন্ত্রাসের? গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে পুলিশের পোশাকে আসা চার ব্যক্তির উপস্থিতিতে বাড়িতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের নৃশংশ হত্যার ঘটনা শিহরিত করে।
‘দালালের কাছে আত্মসমর্পণ’ অপেক্ষা ‘মৃত্যুকে আলিঙ্গন’ করা শ্রেয় মনে করিয়াছিল প্রতিবাদী তরুণটি! সেই আঠাশ বর্ষীয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজ ‘প্রতিবাদী বাংলার’ মুখ! আনিস খান! প্রতিটি অন্যায়কেই যে প্রতিবাদযোগ্য মনে করিত। দলমত বিচার সেখানে অন্তরায় হয় নাই। সেই আনিসের হত্যার বিচারের দাবিতে গোটা ছাত্র সমাজ উত্তাল হইয়াছে। দলমত ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে। আনিসের অপরাধ-সে সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার, পরিসর, চর্চা চাহিয়াছিল! জীবন দিয়া সে তাহার অঙ্গীকার রাখিয়া গেল! মাথা সে নত করে নাই!
তাহারও আগে এক মানবাধিকার ও সমাজকর্মী সংগঠকের প্রতি পুলিশি হেনস্থার প্রতিবাদে বিক্ষোভরত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পড়ুয়াসহ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করিয়া অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। ছাত্রীদের যৌন হেনস্থাসহ অশ্রাব্য অকথ্য গালি দেওয়া হয়।
এই নির্যাতন, আনিস-হত্যা ও তাহার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ পড়ুয়াদের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি পুলিশের ব্যবহার একটি প্রশ্নকে অনিবার্য করিয়াছে। মাননীয়ার পুলিশের সহিত দিল্লীর বা উত্তর প্রদেশের পুলিশের আদৌ কি কোনও ফারাক আছে?
আমাদের প্রশাসনিক প্রধান কলা শিল্প সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী! সম্প্রতি তিনি এক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসিয়াছিলেন। স্বভাববিরুদ্ধ সহিষ্ণুতায় বিশিষ্ট জনের বক্তব্য শুনিলেন, শিশুর উদ্যমে প্রবল বিক্রমে ডঙ্কা বাজাইলেন, বালিকার সারল্যে অক্লান্ত হাতে অন্তত ডজনখানেক বইয়ের আবরণ উন্মোচন করিলেন! (মঞ্চে তখন বই লইয়া যেরূপ কাড়াকাড়ি পড়িয়া গেল, দেখিয়া যে কোনও কলমজীবী ঈর্ষাতুর হইতেই পারেন!) অতঃপর তিনি বাংলা ভাষার বৈভব ও গৌরব লইয়া যাহা বলিলেন, তাহা কি অন্তর হইতে বলিলেন? তবে তাহার পুলিশ বাহিনী এত কুৎসিত, এত অশ্লীল ভাষা কেন প্রয়োগ করে শিক্ষার্থী ও গণ আন্দোলনের কর্মীদের প্রতি? তাহাদের অস্ত্র এত জিঘাংসু কেন? রাজনীতির অঙ্গনটি প্রতিমুহূর্তে এত অশালীন কুমন্তব্যে কলুষিত হইতেছে কেন? একজন ‘ভাষাপ্রেমী’ প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তাহার দায়িত্ব নাই কলুষমুক্ত করিবার? নাঃ, আজ আর তাহার আয়ত্তে নাই। সমগ্র রাজ্যটিকে বিরোধীশূন্য করিতে গিয়া সে কৌশল এখন বুমেরাং হইয়া উঠিয়াছে। দলের মধ্যে অজস্র ‘নির্দল’ উপদল! বাহুবলে পেশীবলে ভর করিয়া তাহারা পুরভোটে লড়িয়াছে এবং অনেকেই জিতিয়াছে। এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা এখন দলের মাথাব্যথা!
শহর গ্রামে পরিস্থিতি ক্রমশ অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছে। ‘সহজপাঠ’ হাতে লইয়া বিস্ময়বিহ্বল শিশু দেখিতেছে, পাড়ার কোনও দাদা বা কাকার সহিত দাদা বা বাবা সুন্দ-উপসুন্দের মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ। বহিরাগত কেহ মায়ের কেশাকর্ষণ করিতেছে, বস্ত্রাঞ্চল টানিতেছে! সবই ‘রাজনীতির’ কারণে! শাসকদলের বর্ষীয়ান নেতা অত্যন্ত সঠিকভাবে বলিয়াছেন, সীমিত পরিসরের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই! ‘ক্ষমতা লিপ্সা’! কারণ রাজনীতি এখন ‘ব্যবসা’, পুরসংস্থাগুলি ‘কামধেনু’! যত পার লুটিয়া লও!
কিন্তু মাননীয়া, ঐ ক্রন্দনরত শিশুটির কী হইবে, হয়তো যে অনাথ হইয়াছে, আপনার ‘বিরোধীশূন্য’ রাজনীতির কল্যাণে? কিংবা দলীয় ‘নির্দলের’ মরিয়া দ্বন্দ্বে?
পাঠক ভাবিতেই পারেন-এ কেমন হইল? শুরু তো হইয়াছিল বাংলা ভাষা নিয়া! সবিনয়ে বলি — রাজনীতি ভাষাবিচ্ছিন্ন নহে। ভাষাই তো রাজনৈতিক চেতনার, আন্দোলনের, কর্মকাণ্ডের বাহন! সেই ভাষা যদি বিপন্ন হয়, রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত