প্রায় ২ সপ্তাহ আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বাজেট পেশ করেছেন অর্থ দফতরের স্বাধীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীমতি চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। গতবছর বাজেট পেশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তাঁর কাঁধে অনেক বোঝা থাকায় তিনি এবার বাজেট পেশের দায়িত্ব চন্দ্রিমা দেবীকে ন্যস্ত করেছেন বোধহয়। যেহেতু, গতবছরের বাজেট বক্তৃতা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই করেছিলেন তাই নিজের পক্ষে নিজের গুণকীর্তন করা যায়নি। এবারের বাজেট বক্তৃতার তাই যথাবিহিত বারম্বার চন্দ্রিমাদেবী মাননীয়ার অনুপ্রেরণাকে স্মরণ করেছেন। ফলে বাজেটে অন্তত ১১ বার মুখ্যমন্ত্রীর কথা উল্লেখিত হয়েছে। এই ব্যক্তিপুজো এরাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যতদিন যাচ্ছে ততই বেড়ে চলেছে। মনে পড়ে যাচ্ছে গ্যালিলেও নাটকের সেই কথা, যে জাতির সবসময় বীরের দরকার পড়ে সে জাতি বড়ই দুর্ভাগা। জানিনা আমরা ভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গবাসীরা কবে এই বীর পূজা থেকে নিজেদের নিষ্কৃতি দিতে পারব।
গত বছরের বাজেট ও সংশোধিত বাজেট দেখলেই বোঝা যাবে রাজ্য বাজেট প্রায় অবান্তর। প্রায় সমস্ত খরচের ক্ষেত্রেই ২০২১-২২’র বাজেট বরাদ্দের তুলনায় প্রকৃত (বা সংশোধিত) খরচ কম হয়েছে। এমনটা ২০২০-২১’র বাজেটের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। সেক্ষেত্রে লকডাউনের প্রভাবের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু ২০২১-২২ সালে যখন স্বাস্থ্য শিক্ষা সামাজিক সুরক্ষার প্রবল প্রয়োজন ছিল তখন কেন এই সমস্ত খাতে খরচ করা গেল না, কেন অর্থ সংস্থান হল না? এসব প্রশ্ন এই বাজেট পেশের সময়ে পাওয়া ২০২১-২২ এর সংশোধিত বাজেট তুলে ধরেছে।
তালিকা - বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দ (কোটি টাকায়)
উপরের তালিকা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রায় প্রতিটি খাতে ২০২১-২২ সালে বাজেট বরাদ্দের তুলনায় সংশোধিত অনুমান অনেকটাই কম। আরো প্রকট যে, মূলধনী খাতে ব্যয় ১৩,৪১৯ কোটি টাকা কম যা বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ৪১ শতাংশ কম। মূলধনী খাতে ব্যয় কম হওয়ার অর্থ রাজ্যের পরিকাঠামো তৈরিতে কাজ কম হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে শিক্ষা-ক্রীড়া-শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মূলধনী ব্যয় বাজেট বরাদ্দ ১,০১২ কোটি টাকার তুলনায় ৬৬৫ কোটি টাকা কমে ৩৪৭ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ তিনভাগের একভাগ। চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যে তা ১,৫৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দের থেকে ৪৫৫ কোটি টাকা কম হয়েছে। তফশিলি জাতি-উপজাতি-পশ্চাদপদ জাতি কল্যাণের ক্ষেত্রেও মূলধনী ব্যয় ১,৬১০ কোটির বরাদ্দের থেকে ১,২৭০ কোটি টাকা কমে ৩৪০ কোটি হয়েছে। অর্থাৎ ৫ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। নগরোন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাজেট বরাদ্দের তুলনায় সংশোধিত খরচ ৫৩ শতাংশ কম। ফলে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই মূলধনী বিনিয়োগ সরকারের তরফে অত্যন্ত হতাশাজনক।
লক্ষ্যণীয়, রাজস্বখাতে খরচের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের তুলনায় সংশোধিত ব্যয়ের অনুমান কম হলেও পুলিশ ও জেলখানার খাতে বাজেটের তুলনায় সংশোধিত খরচ বেশি। পুলিশের ক্ষেত্রে তা প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। সরকারের অগ্রাধিকার বোঝাই যায়। জমার দিক থেকে রাজ্য সরকারের ভবিষ্যনিধি থেকে প্রাপ্ত অর্থকে দেখলে সরকারি নিয়োগ ও সরকারি কর্মীদের বেতনের অবস্থা আঁচ পাওয়া যায়। বাজেট অনুমান ৫,৫৮২ কোটির থেকে ৩৬০ কোটি টাকা কম জমা পড়েছে। অর্থাৎ সরকারের হিসেবের থেকে কর্মীদের বেতনে ব্যয় বেশ কম হয়েছে। রাজ্যে নিয়োগের দুরবস্থা এথেকে প্রকট। ২০২১-২২’র বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ সালে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১৬৩ কোটি বা ৩ শতাংশের কম বৃদ্ধি। মনে রাখা দরকার সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। ফলে নতুন কর্মী নিয়োগ তো দূরস্থান, গত বাজেটের কর্মী সংখ্যার অনুমানকেও এবছর ছোঁয়া যাবে না।
২০২০-২১’র বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা যা প্রকৃত প্রস্তাবে ২৯ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছিল। ২০২১-২২ সালের বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২৬ হাজার কোটি টাকা, সংশোধিত প্রস্তাবে যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। মনে রাখা দরকার উপরের হিসেব অনুযায়ী ২০২১-২২ সালে রাজস্ব খাতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কম ব্যয় করা সত্ত্বেও রাজস্ব ঘাটতি বাজেটের তুলনায় ৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। ফলে এই ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতি কোথায পৌঁছাবে তা বলা দুস্কর, যদিও তাকে এই বাজেটে ২৮ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
তালিকা থেকে কয়েকটি বিষয় হিসেব করা যায়। রাজস্বখাতে মোট ব্যয়বৃদ্ধি গত বাজেটের তুলনায় ৬ শতাংশের মতো। যে মুদ্রাস্ফীতির হার তাতে প্রকৃত অর্থে কোন বৃদ্ধিই তো ঘটছে না, কমছেই বলা যায়। মূলধনী খাতে ব্যয় বরাদ্দ বেড়েছে ৩৭০ কোটি টাকা যা গত বাজেটের তুলনায় ১ শতাংশের একটু বেশি। ফলে মূলধনী খাতে প্রকৃত ব্যয় যে কমছে তা বলাই বাহুল্য। গত বাজেটের তুলনায় সংশোধিত হিসেবে ব্যয় কমেছিল ৪১ শতাংশ। এই বাজেটেও তা বাড়ছেনা। ফলে রাজ্যে পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে।
তালিকায় প্রদত্ত বিভিন্ন খাতেই বাজেট বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় ৬-৭ শতাংশের বেশি বাড়েনি। সমাজকল্যাণ ও পুষ্টির ক্ষেত্রে তা ৩ শতাংশের মত কমেছে। ফলে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক যে সরকার কি সমাজকল্যাণের জন্য ব্যয় কম করতে চাইছে? ওদিকে রাজস্ব সংগ্রহে সরকার বাজেটে যতই নিজস্ব তৎপরতার কথা বলুক না কেন আদতে বছর বছর ঋণের বোঝা বাড়ছে। এবছরের বাজেটেও ৭৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ঋণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। ঋণ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছচ্ছে। ফলে এরাজ্যের অধিবাসীদের মাথাপিছু ঋণ ৬০ হাজার টাকায় পৌঁছবে।
এই বাজেট বক্তৃতায় দাবি করা হয়েছে যে গতবছরে, ২০২১-২২ সালে ৩০ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে রাজ্যে, এবং আগামী ৪ বছরে আরো ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। ওই সংখ্যাটিতে পৌঁছাতেই হবে চন্দ্রিমা দেবীকে, কারণ গত বাজেটে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন আগামী ৫ বছরে দেড়কোটি কর্মসংস্থান করা হবে। তারমধ্যে ২০২১-২২’র ৩০ লক্ষ বাদ দিলে ১ কোটি ২০ লক্ষ থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় সেই সব কর্মসংস্থান হয়েছে? আগেও বলা হয়েছিল, সরকারের দশবছরে ১ কোটি ১২ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। ওই দশবছরে কিন্তু কোভিড ছিলনা। বর্তমান সময়ে কোভিডের সময়ে কীভাবে গত দশবছরের তুলনায় দ্বিগুণের থেকে বেশি হারে কাজ তৈরি হবে এরাজ্যে সে ব্যাপারে কোনো দলিল কিন্তু সরকার দেয়নি। ফলে কৃষিতে তিনগুণ আয়, শিল্পে উন্নতি জাতীয় ফাঁকা আওয়াজের মতো ওই এককোটি কুড়িলক্ষ বা দেড়কোটি সংখ্যাগুলি বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়াই কাজ এই সরকারের।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাজেটে এই সরকারের কাছ থেকে নতুন কিছুই পাওয়া যায়নি।
- অমিত দাশগুপ্ত