আনিস খানের হত্যার তদন্ত: অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ সিট
Failed to identify the culprits

অপরাধের যে কোনো ঘটনায় তদন্তের লক্ষ্য থাকা উচিত মূলত দুটো — অপরাধে জড়িতদের এবং অপরাধের উদ্দেশ্যকে খুঁজে বার করা। এটা সফল হলে ন্যায়বিচার লাভ সম্ভব হয়, অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এবং বিভিন্ন আন্দোলনের সক্রিয় মুখ ২৮ বছর বয়স্ক আনিস খানের ১৮ ফেব্রুয়ারি রহস্যজনক হত্যার তদন্তে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট-এর তদন্তের লক্ষ্যও আপাতভাবে নিশ্চয় এটাই ছিল। আনিস খানের মৃত্যুর পরপরই অপরাধীদের খুঁজে বার করা এবং তাদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তদন্তের প্রশ্নে সিট গঠন করেন এবং সিট ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। আনিসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনগুলো চলছিল সেগুলো ‘গণতান্ত্রিক নয়’ বলে সেগুলোকে তিনি হেয় করেন। এবং আনিসের বাবা ও পরিবারের সদস্যদের রাজ্য পুলিশের হাতে তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করে সিবিআই তদন্তের দাবি জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, সিট-এর তদন্ত হবে নিরপেক্ষ এবং কোনোকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে না। তিনি অতএব সিটের তদন্তে আস্থা রাখার আহ্বান জানান। তাঁর সুনির্দিষ্ট মন্তব্য ছিল, “প্রকৃত ঘটনা কী তা আমরা জানি না, কিন্তু খুব শীঘ্রই আমরা সত্যিটা খুঁজে বার করব। কোনো শিথিলতা গ্ৰাহ্য করা হবে না। সরকার খুবই কঠোর।” সিট গঠন হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি, এবং একেবারে ১৫ দিনে না হলেও ১৯ দিনের মাথায় সিটের রিপোর্ট মুখবন্ধ খামে আদালতে জমা পড়েছে। শুরুতেই তদন্তের লক্ষ্যের যে কথা উল্লিখিত হয়েছে, সিট তাদের তদন্তে সেই লক্ষ্য পূরণে কতটা সফল হয়েছে? আনিসের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী, সিট কি তাদের চিহ্নিত করতে পেরেছে? সিট কি সত্যিই কাউকে আড়াল করার চেষ্টা করেনি?

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে আনিসের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটা এরকম। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পর পুলিশ পরিচয়ে চারজন (একজনের গায়ে পুলিশের উর্দি ছিল আর তিনজনের পরনে ছিল জলপাই রঙের পোশাক) আনিসদের বাড়িতে ঢোকে। একজন বন্দুকের ডগায় আনিসের বাবা সালেম খান ও অন্যান্যদের একতলায় আটকে রাখে, বাকি তিনজন উঠে যায় তিনতলায়। এরপর কিছু একটা ধপ করে পড়ার শব্দ হয়, এবং উপরে উঠে যাওয়া তিনজন নিচে নেমে এসে বন্দুকধারীকে বলেন, “স্যার, কাজ হয়ে গেছে।” ঐ চারজন ‘কাজ’ সারার পর চলে গেলে বাড়ির লোকজন আনিসের রক্তাক্ত দেহকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন, এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পুলিশ এটাকে ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে চালানোর চেষ্টা করলেও আনিসের পরিবারের লোকজনদের কাছে এটা প্রশ্নহীন হত্যা, তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে দেওয়াতেই যে আনিসের মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ তাদের নেই।

ঘটনাবলীর বিকাশ থেকে জানা গেছে, ঘটনা ঘটার পর আনিসের বাড়ি থেকে থানায় ফোন করা হলেও থানা থেকে কোনো পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। আনিসের মৃত্যুর পরদিন স্থানীয় থানা ও জেলার পুলিশ অফিসাররা বলেন, গতরাতে পুলিশ আনিসদের বাড়িতে যায়নি। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে আনিসদের বাড়িতে পুলিশের যাওয়ার এই অস্বীকৃতি যে নিছক মিথ্যাচার ছিল, ঘটনাবলীর পরবর্তী বিকাশে তার প্রমাণ মেলে। আনিস কাণ্ডে যুক্ত থাকার জন্য সিট দুজনকে গ্ৰেপ্তার করে — এদের একজন হোমগার্ড কাশীনাথ বেরা ও অন্যজন সিভিক ভলান্টিয়ার প্রীতম ভট্টাচার্য। এরা দু’জন সাংবাদিকদের সামনেই বলেন — আমতা থানার ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীর নির্দেশেই তাঁরা সেদিন আনিসদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁদের ওপর ওপরতলার চাপ আছে বলেও তাঁরা জানান। সিট আরো দুজনকে সাসপেন্ড করেছে কর্তব্যে অবহেলার জন্যে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর নির্মল দাস ও কনস্টেবল জিতেন্দ্র হেমব্রেমকে। এরা সে রাতে পেট্রল ডিউটিতে ছিলেন। সিটও অতএব স্বীকার করেছে যে, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ আনিসদের বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু তারা কারা?

আনিসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে অবজ্ঞা করতে মমতা ব্যানার্জি আনিসের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতার উল্লেখের কৌশল নেন, “টিভিতে মুখ দেখানোর জন্য যাঁরা যাচ্ছেন (আনিসদের বাড়িতে) তাঁরা জানেন না যে আনিস আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত এবং নির্বাচনে আমাকে সাহায্যও করেছিল”। কিন্তু তাঁর এই মন্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য সামনে আসেনি, বাস্তব বরং এর বিপরীতটা হওয়ারই সাক্ষ্য দেয়। আনিস ছিল সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের এক সক্রিয় মুখ। সে স্থানীয় হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। এবারের, অর্থাৎ, ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনের আগে সে আইএসএফ’এ যোগ দিয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনে তার এলাকা থেকে টিএমসি তুলনায় কম ভোট পাওয়ায় স্থানীয় তৃণমূল নেতারা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল বলেও সংবাদ সূত্রে জানা গেছে। আনিসের সক্রিয় কার্যকলাপে স্থানীয় কায়েমি স্বার্থের একটা অংশ খুব স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট ছিল। আনিসের বাবা সালেম খান যে স্থানীয় কয়েকজন পঞ্চায়েত নেতার গ্ৰেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন, সেই দাবি একেবারে কারণবিহীন বলা যাবে না। আর, অনিষ্টের আশঙ্কা বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, আনিস অধিকাংশ রাতে বাড়িতে থাকত না। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারির রাতে সে যে বাড়িতেই ছিল, সেই খবর পুলিশের স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রেই পাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

মমতা ব্যানার্জি দ্রুতই সত্যিটাকে খুঁজে বার করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই সত্যির নাগাল সিট পায়নি। সাধারণ জনগণের কাছে আনিসদের বাড়িতে যাওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়াটা তেমন কঠিন মনে না হলেও বাঘা-বাঘা অফিসাররা (সিটের মধ্যে পুলিশের ডিজিপি এবং সিআইডি’র অফিসাররা রয়েছেন) কেন প্রকৃত অপরাধীদের সন্ধান পেলেন না, আনিসকে তিনতলা থেকে নিচে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কিনা তার ঠাওর করতে কেন পারলেন না, আনিসের মৃত্যুর পিছনে রাজনীতির যোগ থাকার সন্ধানকে কেন তাঁরা এড়িয়ে গেলেন, তা বুঝতে পারাটা আমাদের পক্ষে দুষ্করই হচ্ছে। যে প্রশ্নটা সঙ্গতভাবেই জোরালো হয়ে সামনে আসছে তা হল, ঘটনা ঘটার পরই আমতা থানার ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীকে কেন তড়িঘড়ি ছুটিতে পাঠানো হল? কেন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না? রাজ্য জানিয়েছে, ফৌজদারি আইনের ১৬১ ধারা অনুসারে তাঁর বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। আদালতের বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, ঐ আইনের ধারা ১৬৪ অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাঁর গোপন জবানবন্দি নেওয়া হল না কেন? ওসিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আনিসদের বাড়িতে কাদের পাঠানো হয়েছিল তার সন্ধানের সম্ভাবনা কি খুব দুরূহ ছিল? আরও জানা গেছে, সিট ১০ মার্চ আদালতে রাইফেল জমা দেয়, সম্ভবত সেই রাইফেল যা তাক করে আনিসের বাবা ও অন্যদের বাড়ির নিচে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই রাইফেল কার হাতে ছিল সেটা জানতে না পারাটা হেঁয়ালি বলেই মনে হচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আনিস খানের মৃত্যুর পিছনে সত্যিটা বেরোলে হাওড়া জেলার পুলিশের কিছু কর্তা থেকে স্থানীয় রাজনীতির কিছু কেষ্টবিষ্টুর কয়েদে স্থান হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সিটের তদন্তের ফলাফলে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়েই দেখা দিচ্ছে। সিটের তদন্ত যেন গভীরে প্রবেশ না করে ওপর-ওপর আঁচর কেটেই ক্ষান্তি দিচ্ছে, একেবারে নিচুতলার দু’একজন কর্মীকে গ্ৰেপ্তার ও সাসপেন্ড করে তাদের কাজের বাহাদুরি জাহির করছে। গোটা ঘটনা থেকে এই সংকেতটা জোরালো হচ্ছে যে, রাজনৈতিক নির্দেশেই পুলিশ একটা প্রাণঘাতী কাজে লিপ্ত হল, রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে ব্যবহৃত হল। আনিসের বাবা জানতেন, জেলার পুলিশ আর শাসক টিএমসি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ, আর তাই রাজ্য পুলিশের তদন্তে সত্যের উন্মোচন অধরা থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই তাঁকে তাদের তদন্তে অনাস্থা প্রকাশের দিকে নিয়ে যায়। সিটের তদন্তের পরিণামে যেন সালেম খানের আশঙ্কা অভ্রান্ত হওয়ারই আভাস।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-11