সম্পাদকীয়
রাজ্য সরকার স্বাস্থ্য ব্যবসায় নামবে কেন?
health business

পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এক অভিনব পদক্ষেপ করল! সম্প্রতি সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে, কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের ভিতরে তৈরি হবে এক নতুন ভবন, যার ধাঁচ আঁচ পুরোপুরি কর্পোরেট হাসপাতাল মডেলের। যেখানে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যাবে কেবল নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে। একটা আপাত পোশাকী নামও ভাবা হয়ে গেছে — ‘প্রাইভেট কেবিন বিল্ডিং’। এখন সরকারি হাসপাতালে ‘পে বেড, পে কেবিন’, এবং আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে টাকার বিনিময়ে। কিছু কিছু পরীক্ষার বন্দোবস্ত খুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি ইউনিটকে। আর উপরোক্ত নতুন প্রকল্পে চলবে সবকিছুতেই ‘ফেলো টাকা নাও নিরাময়’ নিয়ম। ডাক্তাররা সরকারি বেতনের বিনিময়ে রোগীর চিকিৎসা করার পাশাপাশি সময় করে নতুন ভবনে ‘ফী’ নিয়ে আউটডোর-ইনডোর সবই দেখতে পারবেন। বাকি সবরকমের স্টাফ নিয়োগ হবে আলাদা। বলা হচ্ছে, সরকারি বিনিয়োগে, সরকারি নিয়ন্ত্রণে, সরকারি পরিচালনায় এই ব্যবস্থাটি চালানো হবে বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের নিয়মে। এযাবত এরাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা দুই বন্দোবস্ত। একদিকে সরকারি হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রসমূহ, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও আনুষঙ্গিক কেন্দ্রসমষ্টি।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এক উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যে বা অতি স্বল্প মূল্যে জমি পেয়ে ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ ‘মাল্টি স্পেশ্যলিটি’ হাসপাতাল খুলে বসেছে। যাদের প্রতি সরকারের পূর্বশর্ত আজও কাগজে-কলমে এই বলে রয়েছে যে সেখানে গরিবদের জন্যও একাংশে অতি স্বল্প মূল্যে চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকতে হবে। অন্তত টাকার কথা তুলে রোগী ফেরানো যাবে না। কিন্তু এ শুধু কথার কথা হয়ে রয়েছে, দরজা দেখিয়ে দিতে দু’বার ভাবা হয় না।কোভিড কালেও সেটা আরও নির্মম ভাবে দেখা গেল। এমনকি ‘স্বাস্থ্য সাথী’ কার্ড বহু ক্ষেত্রে রেয়াত করা হয়নি, অথবা ‘বেড নেই’ বা ‘যন্ত্র বিকল’ বলে চালাকির আশ্রয় নিয়ে রোগী নিতে অস্বীকৃতি দেখিয়েছে। মমতা সরকার ‘লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া’র আওয়াজ দিলেও তা শূন্যগর্ভ রয়ে গেছে। এখন সরকারি হাসপাতালে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলের যে রূপটি চালু রয়েছে, আর যে নতুন রূপটি পিজি-তে চালু করতে চাওয়া হচ্ছে – দুটোর মধ্যে তফাৎ গুণগতভাবে বিস্তর আলাদা।

পিজি হাসপাতালের ভিতরে মোট এগারো কাঠার জমির ওপর মাথা তুলবে বহুতল নতুন স্বাস্থ্য বাজার। এজন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে ৪৫ কোটি টাকা। পূর্তদপ্তর প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রমোটার-ডেভেলপার টেন্ডার ডাকার। অন্য কিছু রাজ্য সরকার নাকি এহেন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে! ‘সাফল্য’ বলতে সরকারি কোষাগারে টাকার যোগান নিশ্চিত করতে লাভবান হয়েছে। তবে হতে পারে, সমাজের এক অংশ অর্থমূল্যের বিনিময়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে উন্মুখ হবে। এদের টাকার অভাব নেই, অঢেল আছে, সচরাচর ঝোঁক বেসরকারি হাসপাতালের প্রতি। অবশ্য নিম্নবিত্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষদেরও সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ না পেয়ে কখনও নিরুপায় হয়ে যেতে হয় বাজারি হাসপাতালে, বাঁচা-মরা যাইই ঘটুক, সর্বস্বান্ত হতে হয়।

কোভিড পরিস্থিতি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার গলদগুলো আজও কী ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে তা দেখিয়ে দিয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতাল চেইনের পরিকাঠামো আজও পরে রয়েছে অত্যন্ত প্রকট দুর্বলতর অবস্থায়। যে কারণে ‘রেফার’ এখনও এক নিত্য প্রবণতা। গ্রাম থেকে ব্লকে, ব্লক থেকে জেলায়, জেলা থেকে কলকাতায় — সমস্ত স্তরের সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবস্থায় ‘রেফার’ও এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তৃণমূল সরকার শুধু মাঝেমধ্যে পরিসংখ্যান শোনায় সরকার জেলায় জেলায় ‘সুপার’-‘মাল্টি’ স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল বানিয়েছে, বানাচ্ছে, আরও বানাবে। রাজ্য সরকার ‘স্বাস্থ্য সাথী’ কার্ড বিলিয়েছে ভালো। কিন্তু তা দেখিয়েই ‘দায়িত্ববান’ ঢাক পেটানোর কিছু নেই, তার উপযোগিতাই বা কি যদি না হাসপাতাল ব্যবস্থায় সংস্থান সুলভ পর্যাপ্ত না থাকে! চিকিৎসামুখী মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই, বঞ্চনা-প্রতারণার শেষ নেই।

রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই সামগ্রিক চেহারার দর্পণে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সরকারি উদ্যোগে পিজি-তে উপরোক্ত বাজারি উদ্যোগ কেন? সরকার স্বাস্থ্যব্যবসায় নামবে কেন? সেখানে যে কোটি কোটি টাকা ঢালার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা দিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার আরেকটি ভবন হবে না কেন? আর কেনই বা গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ব্লক ও জেলা হাসপাতালকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলা হবে না। যতই সাফল্যের সাতকাহন রাজ্য সরকার, স্বাস্থ্য দপ্তর, স্বাস্থ্য প্রশাসন শুনিয়ে চলুক — জনস্বাস্থ্য অবহেলিত থাকা আড়াল করতে পারছে না। আজও সরকারি হাসপাতালে যত রোগীর সংস্থান হয় তার চেয়ে কয়েকগুণ রোগী হসপাতালের ভিতরে-বাইরে খোলা আকাশের নিচে পরে থাকে ভর্তির অপেক্ষায়, প্রহর গোনে। অথচ কী ধৃষ্টতা! রাজ্য সরকার ফন্দি আঁটছে স্বাস্থ্য ব্যবসার!

খণ্ড-29
সংখ্যা-5