প্রতিবেদন
মুক্তিযুদ্ধ — একুশে ফেব্রুয়ারি
War of Liberation

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভারত রাষ্ট্রের বাইরে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষার জন্য পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম-বরকতেরা। ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যকায় বহু তরুণ প্রাণ মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল। ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে আরও তিন তরুণ প্রাণ আত্মবলিদান দেয় সেখানে। দুটো ক্ষেত্রেই মাতৃভাষার নাম বাংলা। চাপিয়ে দেওয়া ভাষা যথাক্রমে উর্দু ও অসমিয়া। তারও আগে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন মানুষ। এইসব লড়াই নিছক ভাষার লড়াই নয়, বরং আধিপত্যবাদের লড়াই।

ঢাকাতে ভাষা বিক্ষোভ শুরু ১৯৪৭ সালেই। আন্দোলন দানা বাঁধে ১৯৪৮’র মার্চে। চরম প্রকাশ ঘটে ১৯৫২-তে। এদেশে স্বাধীনতার পর পরই বাংলা ভাষা অসমে আধিপত্যবাদের শিকার হয়। ১৯৪৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলই, রাজ্যপাল আকবর হায়দারি, সাংসদ নীলমণি ফুকনরা চেষ্টা করতে লাগলেন, কীভাবে বাংলা ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করা যায়। তারই জেরে ১৯৬০ সালে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বাঙালিরা আক্রান্ত হন। প্রায় এক থেকে দেড়লক্ষ বাঙালি অসম ছাড়তে বাধ্য হন। ন’জন বাঙালি নিহত হন। অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চলিহা পুনরায় প্রস্তাব আনেন অসমিয়া হবে অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা। এসবের বিরোধিতা চলতে থাকে, মূলত বাঙালিরাই করেন। ওদিকে পূর্ব বাংলা উত্তাল হয়েছে, বহু মানুষ শহিদ হয়েছেন। পরের দশকে ঈশান বাংলার শিলচরে ১১ জনকে অসম সরকারের পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। সে সব ইতিহাস।

২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা ১৯ মে, কেন এই পুরনো ইতিহাস ঘাঁটি আমরা? কেনই বা আত্মবলিদানকে স্মরণ করি? সেকি শুধু বাংলা ভাষার জন্য? পুরনো ইতিহাস মনে করতে হয়, আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদকে বোঝার জন্য। স্বাধীনতার পর অসমে যে ‘এনআরসি’ হয়েছিল তাতে দেখা যায় বহু এলাকায় তা কার্যকরি করা হয়নি যেখানে যেখানে অসমিয়াভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এমন ‘ছোট্ট’ ঘটনায় বোঝা যাবে, আধিপত্যবাদের স্বরূপ ও রাজনীতির কদর্য রূপ। আত্মবলিদান স্মরণ করা হয় এই কারণে যে তাঁরা শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছেন, নিরস্ত্র সংগ্রাম কিন্তু বীরের লড়াই। কোন ভাষার জন্য লড়েছিলেন তাঁরা, তা একটি নিছক তথ্যমাত্র। ঘটনা হল, তাঁরা লড়েছিলেন মাতৃভাষার জন্য, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।

মাতৃভাষা সহজাত। অন্য ভাষা অর্জন করতে হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষায় মানুষ মনের ভাব মাতৃভাষার মতো ব্যক্ত করতে পারে না। তাছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষরা একটিমাত্র ভাষা জানেন, তা হল তাঁর মাতৃভাষা। উর্দুকে বা অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা করলে বাঙালি রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ওই ভাষার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাষ্ট্রের আদেশনামা পড়তে পারবেন না, বুঝতে পারবেন না; সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উর্দুভাষী ও অসমিয়াদের থেকে পিছিয়ে পড়বেন তাঁরা। মাতৃভাষা কেড়ে নিলে জীবনের প্রায় সব দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। এ হল শাসিতের উপর শাসকের চরম আক্রমণ। সাদা চোখে এই আধিপত্য বোঝা সহজ নয়। যেমন সাঁওতালরা বাংলার আধিপত্য মেনে নিয়েছেন, বাধ্য হয়েছেন। ভাষাগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুরা গরিষ্ঠের শাসন মেনে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু বাঙালি সংখ্যালঘু ছিল না, উর্দুভাষী ছিল হাতেগোনা। বাঙালিদের অধিকার উর্দিপরা উর্দুভাষী শাসক মেনে নিতে চায়নি। মজার কথা, পশ্চিম পাকিস্তানেও উর্দুভাষী ছিল হাতেগোনা। বেশিরভাগই পঞ্জাবি, পাশ্তো, সিন্ধি, সরাইকি ইত্যাদিতে কথা বলতেন। এদিকে অসমেও বাঙালি ছিল সংখ্যাগুরু। দুই দেশেই শাসক চেয়েছিল বাংলার জায়গায় যথাক্রমে উর্দু ও অসমিয়া চালু করতে, শাসকের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করতে। বাঙালিদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিতে। আর তারজন্য চাই শাসিতের মাতৃভাষার উপর আঘাত হানা। ঠিক তাই করা হয়েছিল।

আমাদের জীবনের সমস্ত কিছু তিনটি জিনিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় — ভাষা, চিন্তন ও জগৎ। ভাষা ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারিনা। মাতৃভাষায় আমরা চিন্তা করি, কল্পনা করি, স্বপ্ন দেখি। ভাষা ছাড়া চিন্তন অসম্ভব। চিন্তনের একটি মূল জায়গা হল জগৎ বা ওয়ার্ল্ড। ভাষার উপর আঘাত হানতে পারলে চিন্তার জায়গাকে ক্ষতবিক্ষত করা সম্ভব হবে আর সেটা সম্ভব হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জগতকে বুঝতে পারবে না মানুষ। উৎপাদন ব্যবস্থায় সে বিনা প্রশ্নে ক্রীতদাসের মতো পরিশ্রম করবে। চিন্তার জগতে সে পঙ্গু হয়ে পড়বে। উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করবে না। শাসিত ও শোষিত হবে বিনা প্রশ্নে।

ভাষার এই সংগ্রাম শুধু বাঙালিদের একচেটিয়া, এরকম মনে হতে পারে। না। তামিল, কন্নড়, মালয়ালম, কোঙ্কনি ভাষা নিজেদের অধিকারের জন্য দশকের পর দশক আন্দোলন করেছেন। সংবিধানে স্বীকৃত ভাষার তকমা পেতে মৈথিলি, কোঙ্কনির বহু সময় লেগেছে। সাঁওতালিকে জনজাতি ভাষার মর্যাদা দিতেও দেরি করা হয়েছে অনেক। ২০০৩ সালে বোড়ো, ডোগরি, মৈথিলির সঙ্গে সাঁওতালি সংবিধানের অষ্টম তফশিলের অন্তর্ভুক্ত হয় ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।
 
২১ ফেব্রুয়ারি, সারা দুনিয়ার মাতৃভাষা দিবস। ক’মাস পর আসবে ১৯ মে। ভাষার এই যুদ্ধসমূহ হল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। শাসকের দৃশ্য-অদৃশ্য শেকল কাটার সংগ্রাম। আর তার নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। এ দেশেও বাজারের ভাষা, চাকরির ভাষা, ব্যবসার ভাষা হিসাবে একটি ভাষাকে শাসক বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে। আদিবাসিদের ভাষাও একই ‘যুক্তি’তে বিলয়ের মুখে। ভাষার এই আধিপত্যবাদ রুখতে, শেকল কেটে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে স্মরণ করি পৃথিবীর সব শহীদ ভাষারোহীকে, শ্রদ্ধায় ও চিন্তায়।

- শামিম আহমেদ

খণ্ড-29
সংখ্যা-8