দেউচা-পাঁচামির কয়লাখনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্রমশ সংগঠিত চেহারা নিচ্ছে। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে গ্রামবাসীদের ছোট ছোট প্রতিবাদ সামনে আসছিল। জানুয়ারিতে গঠিত হয় “বীরভূম জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা”। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় প্রেস ক্লাবে ৩৬ জন গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে মহাসভা এক জোরালো সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের কথা তুলে ধরে এবং ঘোষণা করে যে ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জ ফুটবল মাঠে জনসভা সংগঠিত করবে। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে মহাসভার নেতানেত্রীরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন যে সরকারের পক্ষ থেকে চালানো প্রচার আদতে ভিত্তিহীন, গ্রামবাসীরা কোনও কিছুর বিনিময়েই এই কয়লা প্রকল্প মেনে নিচ্ছে না। ২০ ফেব্রুয়ারির সভায় সমস্ত গণসংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার আহ্বান জানান তাঁরা।
গ্রামবাসীরা যত সংগঠিত প্রতিবাদের দিকে এগোতে থাকে, সরকারি সন্ত্রাসও তত তীব্র হয়। ডিসেম্বরের শেষে প্রথম সংঘাত হয়। একদিকে গ্রামের মহিলারা, অন্যদিকে শাসকদলের কর্মী ও পুলিশের যৌথ বাহিনী। কয়লাখনি-বিরোধীদের প্রতি হুমকিমূলক শ্লোগান তুলে টিএমসির মিছিল দেওয়ানগঞ্জে ঢুকতে দেখে বিভিন্ন পাড়া থেকে কয়েকশ মহিলা ছুটে এসে মিছিলকে চ্যালেঞ্জ করে। বিশাল পুলিশ বাহিনী মহিলাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ২৫ জন বিভিন্ন মাত্রায় আহত হন। পুলিশের লাঠির ঘায়ে একজন আদিবাসী মহিলা তাঁর গর্ভস্থ সন্তানকে হারান। এই হামলার নেতৃত্বে ছিল বিজেপি থেকে সদ্য টিএমসিতে আসা নেতা সুনীল সরেন।
২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জ ফুটবল ময়দানে দেওয়ানগঞ্জ, হরিণসিঙা, কেন্দ্রাপাহাড়ি, হাবরাপাহাড়ি, মথুরাপাহাড়ি সহ প্রায় সমস্ত গ্রাম থেকে মানুষেরা জমায়েত হন। বিশেষত আদিবাসী মহিলারা সোচ্চারে জানিয়ে দেন যে তাঁরা কেউ কয়লাখনি চাইছেন না। দেওয়ানগঞ্জে ২৩ ডিসেম্বর আদিবাসী মহিলাদের ওপর পুলিশের সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে। ২০ ফেব্রুয়ারির সভা ব্যর্থ করতে সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিল টিএমসি ও পুলিশ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অপপ্রচার ও হুমকি দেয়। সভার আগের রাতে তৈরি হওয়া সভামঞ্চ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাও করে। পুলিশ সুপার ফোন করে ক্রাশার মালিককে নির্দেশ দেয় দুপুর থেকে ক্রাশার চালু রেখে সমস্ত শ্রমিকদের আটকে রাখার। কয়েকটি গ্রামের মাঝি হারামকেও ফোনে হুমকি দেয়। তবু সমস্ত প্রতিকুলতা অতিক্রম করে জমায়েত সফল হয় এবং সরকারের অন্যায় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জোরালো বার্তা দেন গ্রামবাসীরা।
সভা শেষ হওয়ার পর পুলিশ ও শাসকদল প্রতিবাদীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মহাসভার আহ্বানে কলকাতা থেকে আসা প্রতিবাদীরা যখন ফিরছিলেন তখন মহম্মদবাজারের কাছে টিএমসি সমর্থকেরা তাঁদের আটকে রেখে দীর্ঘক্ষণ লাঞ্ছিত করতে থাকে। পরবর্তীতে পুলিশ তাঁদের থানায় নিয়ে যায় ও সারা রাত আটক রাখে। অন্যদিকে টিএমসি নেতা সুনীল সরেনের নেতৃত্বে একটি বাহিনী সভা-ফেরত গ্রামবাসীদের ওপর চড়াও হয়। কিন্তু ব্যাপক আদিবাসী মহিলা এই টিএমসি নেতা ও তার দুই সাগরেদকে ঘিরে ফেলে। মহিলাদের চরম ক্রোধের মুখে পড়ে এই টিএমসি নেতা। পাঁচ গাড়ি পুলিশ গ্রামে ঢুকেও শেষ পর্যন্ত মহিলাদের ক্ষোভ আঁচ করে সভাস্থলে না গিয়ে ফিরে যায়। ধৃত টিএমসি নেতাকে জুতোপেটা করে মহিলারা। লিখিতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা পাওয়ার পর সুনীল সরেনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁরা। ভোর রাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী গ্রামে ঢোকে। মহাসভার সংগঠক কর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দেয় পুলিশ। আট জনকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। এই সমস্ত গ্রামবাসী, থানায় আটক কলকাতার প্রতিবাদীরা ও অন্যান্য “১০০-১৫০ জন”-এর নামে পুলিশ “খুনের চেষ্টা” সহ বিভিন্ন ধারায় মামলা সাজিয়েছে। দুজন গ্রামবাসী, মোহন মার্ডি ও কালিচরণ বাস্কে, পুলিশ হেফাজতে এবং প্রসেনজিৎ বসু ও আব্দুল মালিক মোল্লা সহ কলকাতার ৭ জন জেল হেফাজত আছেন। পরের রাতেও পুলিশ গ্রামে ঢুকে সন্ত্রাস চালিয়েছে।
২০ ফেব্রুয়ারির সমাবেশ গ্রামবাসীদের ভয়ভীতি ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনেকাংশে দূর করে দিয়েছে। তারপর থেকে প্রতিদিনই ক্রমবর্ধমান হারে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন এবং সব গ্রাম ঘুরে মাইলের পর মাইল মিছিল সংগঠিত হয়েছে। এলাকার সমস্ত পাথর খাদান ও ক্রাশার বন্ধ করে দিয়েছে গ্রামবাসীরা। এসব অধিকাংশই বেআইনি এবং এই ব্যবসার তোলাবাজি চক্রকে হাতিয়ার করেই টিএমসি নেতারা এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ২০-২১ ফেব্রুয়ারির সরকারি সন্ত্রাসের প্রতিবাদে রাজ্যের বিভিন্ন আদিবাসী সামাজিক সংগঠন দেওচা কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান জোরালো করতে শুরু করেছে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাজ্যস্তরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে ঐক্য প্রসারিত হচ্ছে, ২৩ ফেব্রুয়ারি মৌলালি মোড়ে প্রতিবাদসভায় যা প্রতিফলিত হয়েছে।
- মলয় তেওয়ারি