সংসদে বাজেট অধিবেশনের শেষে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে, সমস্তক্ষেত্রে সরকারি অকৃতকার্যতার সমালোচনার কোন উত্তরই দেওয়া হল না। অভূতপূর্ব বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি, এবং কোভিড মোকাবিলায় চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মত চূড়ান্ত অপরাধ যার বলি হয়েছেন অজস্র মানুষ — এসব অভিযোগেরও কোনও জবাব মেলেনি। তথাকথিত ‘অমৃত কাল’ এবং ‘ভারত@১০০’র মতো দায় এড়ানো চমকদার বাজেট-বুলির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতির দাবি জানালে, সে প্রশ্নেও তিনি নিরুত্তর থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন! উল্টে তিনি সব বিপর্যয়ের দায় বিরোধীদের কাঁধে চাপিয়ে, ডাহা মিথ্যে বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করলেন যেটা এসব ক্ষেত্রে তার বহু ব্যবহৃত অতি চেনা এক কৌশল।
২০২২-কে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির স্মারক ‘অমৃত বর্ষ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেই ২০২২’র জন্য ২০১৫-তে প্রধানমন্ত্রীর তরফে এবং বাজেটে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয়েছিল। এই প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যে ছিল কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা, সহজ ঋণের জন্য দেশ জুড়ে পোস্ট অফিসগুলিকে পেমেন্ট ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত করা, ভারতের প্রতিটি গৃহস্থের জন্য পানীয় জল, শৌচাগার, বাড়ি, ২৪/৭ বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সড়ক সংযোগ সুনিশ্চিত করা। ২০২২-এ, বাজেট এবং প্রধানমন্ত্রী — এইসব প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থতা প্রসঙ্গে একেবারে নীরব। বরং ঐ প্রতিশ্রুতিগুলিকেই ‘তাজা’ ঘোষণা হিসেবে উগড়ে দেওয়া হল, অর্থাৎ নতুন মোড়কে হাজির করা হল! একমাত্র ফারাক হল ২০১৫-তে ২০২২-কে ‘অমৃত বর্ষ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল ঐ বছরের মধ্যে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে; আর ২০২২’র বাজেটে ঘোষণা করা হল আমরা সবাই ‘অমৃত যুগে’ প্রবেশ করেছি এবং সব প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে ‘ভারত@১০০’তে অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার শতবর্ষে! সুতরাং সত্যিকারের উন্নয়ন এবং কাজের ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ন্যূনতম দায়বদ্ধতার কোন চিহ্ন নেই এই বাজেটে। শুধু লক্ষ্যস্থলের এক চটকদার নাম দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিশ্রুতিপূরণকে ২৫ বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে!
২০২২’র বাজেটে ৬০ লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোথা থেকে সেই চাকরি আসবে সে ব্যাপারে বিশদে কিছুই বলা হয়নি! সরকারি ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক শূন্যপদ পূরণের ব্যাপারে কোন উল্লেখ নেই — দেশের শিক্ষিত তরুণ বেকার সম্প্ররদায় বছরের পর বছর যে দাবি জানিয়ে আসছে, কিন্তু জুটছে শুধু পুলিশের মার। বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি, মনরেগা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও জনস্বাস্থ্যেরও বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পেগাসাস সফ্টওয়্যার, যা ভারতীয় নাগরিকদের উপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, তারজন্য সরকার কোষাগারের কত অর্থ কাজে লাগিয়েছে, সে বিষয়ে আদৌ কোনও স্বচ্ছতা নেই। কিন্তু এসব বিষয়ে যে কোন প্রশ্নেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া হল প্রশ্নকর্তাদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে দেগে দেওয়া।
প্রধানমন্ত্রী তার বিরোধী পক্ষকে ‘আরবান নকশাল’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাঙ’ বলে অভিহিত করেছেন — যে অভিধাগুলো তার প্রচার-মিডিয়ার দেওয়া যা বলতে চায় — সমস্ত সমালোচকরা দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল, সরকারের কোভিড মোকাবিলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্জলা মিথ্যা বলা। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার জন্য তিনি দিল্লীর আপ এবং মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সরকারকে দায়ী করেছেন — তাদের অপরাধ, তারা লকডাউনে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করেছিল! নির্লজ্জভাবে তিনি এটা বলছেন, এমনকি যখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তার রাজ্যের ভোটারদের কাছে মিথ্যা দাবি করছেন যে একমাত্র তিনিই নাকি আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য ঠিক লকডাউনের শুরুতেই বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন! ঠিক যেমন বিহার নির্বাচনের সময় বিজেপি ভোটদাতাদের কাছে জাঁক করে মিথ্যা বলেছিল — বিজেপি’ই নাকি “পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে এনেছিল”!
সংবাদমাধ্যমের প্রভাবশালী অংশ প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যাকথাগুলো ঢাক পিটিয়ে প্রচার করতে পারে। কিন্তু চারপাশটা একটু নজর করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, গরিব মানুষের বাড়ি নেই, পানীয় জল, শৌচাগার, রাস্তা, কাজ, ঋণ, বিদ্যুৎ কিচ্ছু নেই; কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হয়নি; সত্যি বলতে কি, বেকারত্ব, ক্ষুধা এবং কৃষকদের কষ্ট আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। প্রত্যেকের মনে আছে, অতিমারির সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা (পুলিশের) মার, অসুস্থতা এবং রাস্তাতেই মৃত্যু — এসব সহ্য করেও কীভাবে হেঁটে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রত্যেকের স্মরণে আছে, কোভিড ছড়ানোর জন্য পরিযায়ী শ্রমিকরা দায়ী নন; প্রধানমন্ত্রীর গোঁ ধরা জেদে অনুষ্ঠিত কুম্ভ মেলা এবং বাংলার নির্বাচনী জমায়েতগুলোই ভারতে কোভিড’এর ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ে এত মৃত্যুর জন্য দায়ী। আর তাদের এটাও স্মরণে আছে যে, অক্সিজেন ও হাসপাতালে শয্যার মারাত্মক সংকট যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত, সেটাই বেশির ভাগ মৃত্যুর কারণ!
মানুষ নির্বাচনে এবং রাস্তায় (আন্দোলনে) প্রধানমন্ত্রীর এই মিথ্যা কথা ও বাজেট-বিশ্বাসঘাতকতার হিসাব রাখছেন।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২)