এক মহিলা বারো বছর ধরে স্বামীর যৌন নির্যাতন সহ্য করেছেন। রাতের পর রাত। অসুস্থ অবস্থায়, কন্যার সামনেও, এমনকি যেদিন তার মা মারা যান সেদিনও রেহাই মেলেনি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে তিনি পারিবারিক আদালতের দ্বারস্থ হন। বিচার মেলেনি। অবশেষে তিনি বৈবাহিক ধর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন নিয়ে কেরালা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। গতবছর সেই মামলায় আদালত এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে।
কী এই বৈবাহিক ধর্ষণ? তা নিয়ে হঠাৎ এত বিতর্ক কেন? পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইন ২০০৫-এ শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও যৌন নির্যাতনের উল্লেখ আছে। তাহলে আলাদা করে বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতি দিতে হবে কেন?
বৈবাহিক ধর্ষণ হল ‘স্ত্রী’র অনিচ্ছা বা সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও শারীরিক সম্পর্কে জোরপূর্বক লিপ্ত হওয়া বা কোনও বস্তু বা জিনিস স্ত্রীর যৌনাঙ্গে ঢোকানো এবং তার সমতুল্য কোনও কাজ। পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইনে ‘সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ’ হিসেবে এর উল্লেখ আছে বটে — ‘sexual abuse’ includes any conduct of a sexual nature that abuses, humiliates, degrades or otherwise violates the dignity of woman। কিন্তু আইনে নির্দিষ্টভাবে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে স্বীকৃতি নেই আর এই আইনটি হলো ‘সিভিল ল’ বা দেওয়ানী আইন, আর ‘ধর্ষণ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হল ‘ক্রিমিনাল ল’ বা ফৌজদারি আইন’এর আওতাভুক্ত হওয়া। একটু ভেঙে বলি। দেওয়ানী মোকদ্দমায় আদালত জরিমানা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি বিবেচনা করে আর ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে উল্লেখযোগ্য শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন ধর্ষণের ফৌজদারি মামলায় কমপক্ষে ৭ বছরের জেল ও তৎসহ ক্ষতিপূরণের রায় দেওয়া হয়। আর পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইন যেহেতু দেওয়ানী মোকদ্দমা তাই এই আইনের আওতায় নির্যাতিতা বিবাহিত মহিলা নির্যাতন বন্ধের আদেশ পান, বসবাসের অধিকার পান, বাচ্চাদের কাছে রাখার অধিকার পান, ক্ষতিপূরণ পান ইত্যাদি। কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃতি না থাকায় জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের কোনও শাস্তি অভিযুক্ত ‘স্বামী’ পান না। বিবাহিত মহিলারা বাইরের পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হলে সেটা ধর্ষণ আর ঘরের ভিতরে ধর্ষিত হলে সেটা পারিবারিক ব্যাপার! স্ত্রীর দায়িত্বই তো স্বামীর সেবাযত্ন করা, স্বামী বা মালিক ইচ্ছেমত তাকে ব্যবহার করতেই পারেন!
ভারতীয় পেনাল কোডেও বিবাহিত মহিলাদের ধর্ষণ ও সম্মতির (কনসেন্ট’এর) বিষয়টিকে রীতিমত জগাখিচুড়ি পাকিয়ে দেওয়া আছে। পেনাল কোড ৩৭৫-এ রেপ বা ধর্ষণের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেকশন-৪ এবং ব্যাতিক্রম হিসেবে উল্লেখই আছে যে — আইনত স্বামী ছাড়া অন্য কেউ ধর্ষণ করলে তবেই সেটা ধর্ষণ এবং ১৫ বছরের উপরে বিবাহিত মহিলাদের সঙ্গে স্বামীর কোনও রকম যৌনসঙ্গম (ইন্টারকোর্স) ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে না। এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন জড়িয়ে। যে জায়গা থেকে পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইনটাও সিভিল আইন হিসেবে পরিগণিত — সেই বিষয়টি হল, মেয়েরা এটা শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠে — পতি পরম গুরু, স্বামীই ধর্ম। ছোটবেলায় বাবার অধীনে, তারপর স্বামী, তারপর পুত্রের অধীনে থাকাটাই নারীর জন্য শাস্ত্রসম্মত বিধান — এই ধারণা ছোট থেকে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। তারা শেখে ‘মানিয়ে নেওয়া’। মেয়েদের পড়াশোনার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তথা আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার প্রশিক্ষণটা সেখানে গৌণ, গুরুত্বহীন! ‘ভালো স্ত্রী’ হওয়াটাই বড় কথা! ফলত আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়াটাও হয়ে ওঠে না। কোনওক্রমে যোগ্যতা অর্জন করে চাকরি করলেও তার উপার্জন পুরোটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যায় পরিবার সামলাতে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মহিলারা খুব স্বাভাবিকভাবেই নির্যাতিত হলেও চান যে স্বামী নির্যাতন বন্ধ করুন কিন্তু তার সঙ্গেই থাকুন। না থাকলে খোরপোষটুকু দিন কিন্তু শাস্তি দিতে চাননা বা বলা ভালো, তাদের বেড়ে ওঠা/গড়ে ওঠা পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ তা চায় না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দাবি করা হচ্ছে, বৈবাহিক ধর্ষণ আইনের স্বীকৃতির। একটা আইন সবসময় যেকোনও রকম সামাজিক মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে। বিচার বা জাস্টিসকে প্রতিষ্ঠিত করাই তার অন্যতম উদ্দেশ্য, সামাজিক প্রেক্ষিত মাথায় রেখেও। আইন থাকলে তার পক্ষে প্রচার করা যায়, লড়াই করা যায়। আইনে স্বীকৃতই যদি না হয়, মহিলারা প্রতিবাদে এগিয়ে আসবেন কী করে?
দ্বিতীয়ত, দিল্লী হাইকোর্ট ৪ বছর আগে একটি রায়ে বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকৃতির বিপক্ষে বলেছিল — একজন বিবাহিত মহিলা তার স্বামীর যে কাজ ধর্ষণ হিসেবে দেখছেন, অন্যদের কাছে নাও হতে পারে সেটা সেরকম। বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বিবাহ প্রতিষ্ঠানটা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ তিনি বিবাহিত এবং স্বামী যাই করুন সেটাই চূড়ান্ত বৈধ। বিবাহ প্রতিষ্ঠান নামক একটা পুরুষতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাটাই সমাজের একমাত্র পবিত্র কর্তব্য!
আমরা বলতে চাই — ধর্ষণ হয়েছে কিনা তার একমাত্র মাপকাঠি হল একজন মহিলা কোনওভাবে ভায়োলেটেড হয়েছেন কিনা তার সম্মতি ছাড়া, অন্যকিছু কখনোই নয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ যা মহিলাদের আচরণবিধি, জামাকাপড়, যাপন পদ্ধতি সব নির্ধারণ করে সেগুলো কখনই ধর্ষণের মাপকাঠি হতে পারে না। বৈবাহিক ধর্ষণকে অস্বীকার করা মানে সেই পুরুষতান্ত্রিক ধারণাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যে স্বামীর অধিকার আছে স্ত্রীর শরীরের উপর, তাকে ভায়োলেট করার, এবং স্ত্রী একজন মহিলা হিসেবে বাধ্য তার স্বামীর সমস্তরকম যৌন চাহিদা সে যখন চাইবে, মেটাতে। অর্থাৎ বিবাহে ‘না’ বলার অধিকার কোনও মহিলার থাকতে পারে না, একজন স্ত্রী সবসময়ই যৌনবস্তু হিসেবেই পরিগণিত হবেন — এই বস্তাপচা পিতৃতান্ত্রিক সামন্তী ধারণাকে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসেছে। একজন নির্যাতনকারীর একমাত্র পরিচয় সে নির্যাতনকারী — সে স্বামী হোক, বাবা হোক, দাদা হোক, কাকা হোক, আত্মীয় হোক, অপরিচিত হোক। কোনও সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, ‘ধর্ষণ’ হয়েছে কি হয়নি তা নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। ‘সম্মতি’ ছিল কি ছিল না — সেটাই একমাত্র বিচার্য।
তৃতীয়ত প্রশ্ন ওঠে যে, এই স্বীকৃতি দেওয়া হলে বহু মিথ্যা কেস আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। খুবই আজব ব্যাপার, যে কোনও আইনেই এই মিথ্যা কেসের ভাণ্ডার থাকে। কিন্তু প্রশ্নটা তোলা হয় শুধু মহিলাদের অধিকার নিশ্চিতকারী আইনগুলো নিয়ে! যে দেশে প্রতিদিন ৩০৭ জন মহিলা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন, সেখানে সত্যিই এই ধরণের প্রশ্নগুলো অবান্তর শুধু নয়, উদ্দেশ্যে প্রণোদিত।
গতবছর কেরালার হাইকোর্টে তার ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছিল, বিবাহিত নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেও সম্মতিহীন যৌনসঙ্গম ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ যা পাশবিক, নৃশংস এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর আক্রমণ। আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ না হলেও, বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসাবে গ্রাহ্য হতে পারে।
এবছর ন্যাশনাল উইমেন্স কমিশনের তরফে ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট’ নিয়ে আলোচনা চলছে, প্রয়োজন বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকৃতির দাবিতে আরও সরব হওয়া।
প্রয়োজন বাকি লড়াইটার। প্রয়োজন সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন। চাই নারীর ক্ষমতায়ন, স্বায়ত্ততা ও সমানাধিকার।
- সৌমি জানা