৩০ জানুয়ারি মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীর শহীদ দিবস। নাথুরাম গডসে ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী যে নিরস্ত্র গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিল। আজ, আমরা দেখছি, তথাকথিত ‘ধর্ম সংসদে’ বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর এবং বিজেপি নেতা সাক্ষী মহারাজ ও অন্যান্য ঘৃণা-বর্ষণকারীরা সন্ত্রাসী গডসেকে সম্মান জানাচ্ছেন। আমরা সবিস্ময়ে এটাও দেখছি, আরএসএস-মতাদর্শের তাত্ত্বিকরা বলছেন — গান্ধী হত্যার জন্য দায়ী নেহরু, সাভারকর ও গডসে নয়! প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গান্ধীজীর প্রতি মৌখিক সৌজন্য দেখিয়েছেন — কিন্তু তারা গডসে এবং তার আজকের অনুগামীদের সম্পর্কে নীরব কেন? কেন তারা সাভারকরকে সমর্থন করেন, যে গান্ধী হত্যার সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রের মূলচক্রী ছিল?
গান্ধীর শহীদ দিবসে, আরএসএস তাত্ত্বিক রাকেশ সিং ট্যুইট করে সাফাই গেয়েছেন — নেহরু, গান্ধীর নিরাপত্তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেছেন, যেজন্য হত্যার এক ব্যর্থ চেষ্টার ১৫ দিন পরেও গান্ধীর নিরাপত্তায় ঢিলেমি ছিল। শ্রীযুক্ত রাকেশকে স্মরণ করানো দরকার যে সেই সময়ে গান্ধীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সর্দার প্যাটেল যাঁর জন্য আরএসএস নেহেরু-বিরোধী এক ‘নায়কের’ মর্যাদা দাবি করে। আমাদের অবশ্যই শ্রীযুক্ত রাকেশকে এটাও মনে করিয়ে দিতে হবে যে গান্ধীজীর জীবনের মূল্য নিয়ে প্যাটেল নিজে নিঃসংশয় ছিলেন! আরএসএস প্রধান গোলওয়ালকরকে লেখা এক চিঠিতে প্যাটেল আরএসএস’কে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে লেখেন, “তাদের (আরএসএস নেতাদের) সমস্ত ভাষণই ছিল সাম্প্রদায়িক বিষে ভরা — এই বিষের চূড়ান্ত পরিণতিতে, দেশকে গান্ধীজীর মহামূল্য জীবন বলিদানের কষ্ট সইতে হয়েছে — গান্ধীজীর মৃত্যুর পর আরএসএস’এর লোকেরা আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে এবং মিষ্টি বিতরণ করেছে।” প্যাটেল গান্ধীজীর হত্যা নিয়ে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকেও লিখেছিলেন, “আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা সম্পর্কে — আমাদের পাওয়া রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে যে, এই দুটি সংগঠনের, বিশেষ করে পূর্বোক্তটির কার্যকলাপে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যা এই ভয়ানক ট্র্যাজেডি ঘটতে দিয়েছিল।”
১৯৪৭’র ৮ ডিসেম্বর, ২,৫০০ আরএসএস সদস্যের এক জমায়েতে ভাষণ দিতে গিয়ে গোলওয়ালকর গান্ধীজীকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন, “মহাত্মা গান্ধী আর হিন্দুদের বিভ্রান্ত করতে পারবেন না। আমাদের জানা আছে কী করে এই ধরণের লোকেদের সঙ্গে সঙ্গে চুপ করিয়ে দিতে হয়, কিন্তু হিন্দুদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন না হওয়াটাই আমাদের ঐতিহ্য। যদি আমাদের বাধ্য করা হয়, আমাদের সে পথেই যেতে হবে।”
নাথুরাম গডসে নিজে প্রাক বিচারপর্বে এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছিল যে সে আরএসএস’এর এক সক্রিয় কর্মী হিসাবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিল এবং তারপর সে আরএসএস’এর সদস্যপদ না ছেড়েই হিন্দু মহাসভার হয়ে কাজ শুরু করে। নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে ১৯৬৪-তে জেল থেকে ছাড়া পাবার পর স্পষ্ট ভাবে জানায়, নাথুরাম আরএসএস’এর আজীবন সদস্য ছিল।
গডসের মেন্টর (প্রশিক্ষক উপদেষ্টা) সাভারকর গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রের মূল চক্রী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিল, কিন্তু কোনভাবে ছাড়া পেয়ে যায় যেহেতু গডসে এবং অন্যান্যরা তাকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলেছিল। আদালতে সাভারকর দাবি করেছিল যে ১৯৪৮’র ১৭ জানুয়ারি সে নাথুরাম গডসে ও মদনলাল আপ্তের সঙ্গে দেখা করেনি। কিন্তু নতুন প্রমাণ প্রকাশ্যে আসার পর, ১৯৬৪ সালে গঠিত বিচারপতি কাপুর কমিশন সাভারকরের এই দাবিকে ‘মিথ্যা’ বলে প্রমাণ করেছিল। বস্তুত, কাপুর কমিশন এই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে “সাভারকর ও তার গোষ্ঠীদ্বারা হত্যার একটি ষড়যন্ত্র” হয়েছিল এবং সেটা তৈরি হয়েছিল সাভারকর সদনে বসেই। সাভারকরের দেহরক্ষী এবং কাপুর কমিশনের সচিবের সাক্ষ্য প্রমাণ করেছে যে গান্ধীজীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মূলচক্রী ছিল সাভারকর, সে গডসেকে বন্দুক সরবরাহ করেছিল ও “যশস্বী ভব (সফল হও)!” বলে আশীর্বাদ করেছিল।
গডসে ও সাভারকরের উত্তরসূরীরা একসঙ্গে ‘অভিনব ভারত’ নামে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন চালাতো। পুলিশ আধিকারিক হেমন্ত কারকারে, যিনি পরবর্তীতে শহীদ হন, বোমা বিস্ফোরণে সংগঠনটির ভূমিকার সূত্রে তার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে প্রকাশ্যে আনেন। বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর বারবার গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে উল্লেখ করেছে এবং হেমন্ত কারকারে সম্পর্কে কুমন্তব্য করেছে — কিন্তু তারজন্য মোদী অথবা শাহ’র তরফ থেকে কোনো শাস্তিবিধান করা হয়নি। গান্ধীর জন্য প্রশস্তি আসলে যে নেহাতই বিজেপি’র ভণ্ডামি, তা ধরা পড়ে গেছে আজকের গডসে, প্রজ্ঞা ঠাকুর, সাক্ষী মহারাজ, যতি নরসিংহানন্দ এবং অন্যান্য ঘৃণা-বর্ষণকারীদের প্রতি তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন থেকে। গডসে এবং সাভারকর ভারতের সংবিধান এবং তার সাম্য ও গণতন্ত্রের স্বপ্নকে ঘৃণা করতো, ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন করতো এবং সন্ত্রাসবাদকে পোষণ ও অনুশীলন করতো। এই ধ্বংসাত্মক ভারত-বিরোধী দুরাকাঙ্ক্ষার প্রতি বিজেপি’র গোপন সমর্থন আর ‘গোপন’ থাকতে পারে না!
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)