২০২২ ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের দখলদারি নিতে, আত্মসাৎ করতে মরিয়া মোদী সরকার সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিবস, ২৩ জানুয়ারিকে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের আনুষ্ঠানিক সরকারি সূচনা হিসাবে আখ্যায়িত করেছে এবং ইন্ডিয়া গেটে ভারতের এই দেশবরেণ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিশাল এক মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। বসু-কন্যার প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা জানি, বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উদযাপনের পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে যে কমিটি তৈরি হয়েছিল তা একবারও বসেনি। আর আসল মূর্তি তৈরি না হওয়ায় একটি হলোগ্রাম মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পেশ করা সুভাষ চন্দ্র বসুর ট্যাবলো প্রস্তাব খারিজের পর। ইতিহাসখ্যাত কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের দখলদারি নেওয়ার সংঘাত অতীতে কখনও এতটা কদর্য চেহারা নেয়নি।
এই ‘ছিনতাই-যুদ্ধের’ থেকেও যা আরও অনেক বেশি উদ্বেগজনক, তা হল অবিরাম ইতিহাসের বিকৃতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাশ্রয়ী পরিবর্তন ঘটানো, ইতিহাস নিয়ে নির্লজ্জ নাশকতামূলক তৎপরতা চালানো এবং সাংবিধানিক কাঠামো ও আমাদের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সেই আবেগদীপ্ত চেতনাকে নস্যাৎ করে চলা। মোদী সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-মুক্তির প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করেছে। ক্রমবর্ধমানভাবে এবং নজিরবিহীন অশালীন স্পর্ধায় সরকার প্রলম্বিত স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কাল্পনিক আখ্যান তৈরি করে চলেছে, যে ‘সংগ্রাম’ কয়েক শতাব্দীব্যাপী প্রসারিত — যাকে বলা হচ্ছে ‘হিন্দু ভারতের’ উপর ‘মুসলিম আক্রমণ’। মধ্যযুগীয় ভারতে কোনও হিন্দু ও মুসলিম শাসকের মধ্যে সংঘাতের উদাহরণ, অথবা হিন্দু তীর্থকেন্দ্রগুলির উন্নয়ন — এসব কিছুই প্রলম্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের আখ্যায়িকায় গেঁথে দেওয়া হচ্ছে।
ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) প্রকাশিত ‘নিউ ইন্ডিয়া সমাচার’এ সম্প্রতি এক চমকপ্রদ দাবি রাখা হয়েছে যা স্তম্ভিত করে দেয়। দাবি করা হয়েছে — ভক্তি আন্দোলন নাকি ১৮৫৭’র গণবিদ্রোহের অগ্রদূত! এবং রমণ মহর্ষি (১৮৫৭-১৯৫০) ও স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)-কে ভক্তি আন্দোলনের ‘আইকন’ হিসেবে চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬-১৫৩৪)-র সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে! পরবর্তীতে, পিআইবি এই সংযুক্তিকে ‘অসতর্কতাজনিত ভুল’ বললেও ভক্তি আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘ভিত্তি’ বলা অব্যাহত থেকেছে। ভক্তি আন্দোলন মূলত জাতিভেদ প্রথার উৎপীড়ন ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন হিসেবেই উঠে এসেছিল এবং ঐক্য, সর্বধর্ম সমন্বয় ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল। ভক্তি আন্দোলন এবং ১৮৫৭’র মধ্যে যদি কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা সাদৃশ্য থাকে, সেটা হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ভারতীয় জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানে মারাত্মক ভয় পেয়েছিল এবং ১৮৫৭’র পরপরই সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ছড়িয়ে দেওয়া, তীব্র করে তোলার জন্য সম্ভবপর সমস্ত রকম চেষ্টা চালিয়েছে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭’র দেশভাগ।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মিথ্যা, বিকৃত আখ্যানের দুরভিসন্ধিমূলক নির্মাণের পাশাপাশি সংবিধানের নিগূঢ় চেতনা ও কাঠামোর উপর বিরামহীন আক্রমণ চলছে। সরকার সাংবিধানিক উদ্দেশ্য ও অঙ্গীকারকে নস্যাৎ করার জন্য নিরলস অতিসক্রিয়তা চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে প্রজাতন্ত্রকে ধর্মনিরপক্ষেতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিপরীত অভিমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে ক্রমাগত নাগরিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী বারংবার একটা বিষয়ে সংশোধন চাইছেন, যাকে তিনি বলছেন ‘অধিকারের উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব’। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন, একটা জাতি হিসেবে আমরা নাকি আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করে অনেক সময় নষ্ট করে চলেছি! তিনি চান অধিকারকে দায়িত্বের অধীন করতে, দায়িত্বকে মৌলিক এবং অধিকারকে ক্রমশ বাছাই এবং শর্তাধীন করার মাধ্যমে। নাগরিকদের তাদের দায়িত্বের বোঝায় ভারাক্রান্ত করাটা আরেকটি চালাকি; এইভাবে রাষ্ট্র ও সরকার নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।
জাতিয়তাবাদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝুটা আখ্যান আর সংবিধান সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান বিধ্বংসী তৎপরতা — ৭৫’এর ভারত এইভাবে এক দ্বি’মুখী আভ্যন্তরীণ অবরোধের সম্মুখীন; তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি এবং বাইরের হুমকি ও বর্তমান পৃথিবীর নানা চ্যালেঞ্জ। বাহাত্তর বছর আগে ভারতের সংবিধান যখন প্রথম বলবৎ হয়েছিল, আমরা ভারতের জনগণ ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে গড়ে তোলার এবং ভারতের সকল নাগরিকের জন্য সার্বিক ন্যায়, মুক্তি এবং সমতা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার নিয়েছিলাম। আজ সেই গণঅঙ্গীকার সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে আছে এবং আধুনিক ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতার উপর। এই যুদ্ধে হার মানা নয়! আমাদের জিততেই হবে!
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়)