প্রতিবেদন
ভারতে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্য
economic inequality in India

অক্সফ্যাম জানুয়ারি ২০২২’র অসাম্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করেছে। বিশ্বজোড়া অসাম্য, ধনী দেশের সঙ্গে দরিদ্র দেশের, ধনী দেশের উচ্চবিত্তের সঙ্গে সেখানকার নিম্নবিত্তের, দরিদ্র দেশের ধনীদের সঙ্গে সেখানকার গরিবদের হরেক কিসিমের বৈষম্যই এই পৃথিবীর দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। ওই প্রতিবেদনের গোড়াতেই জানানো হয়েছে, কেবল বৈষম্যের দরুণ প্রতি ৪ সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হয়, অর্থাৎ, প্রতি বছরে প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ মারা যায়।

বিশ্বের ধনীতম ১০ জনের সম্পদ দ্বিগুণ হয়েছে অন্যদিকে ৯৯ শতাংশের, অর্থাৎ ৭৮০ কোটি মানুষের আয় কমেছে, গত মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২১, এই ২০ মাসের কোভিডকালে। ২৫২ জন ধনীর যত সম্পদ আছে, তার পরিমাণ আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ক্যরিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ১০০ কোটি পুরুষ ও নারীর সম্মিলিত সম্পদের থেকে বেশি। ১৯৯৫ সাল থেকে গত ২৭ বছরে উপরদিকের ১ শতাংশ অতিধনীরা নিচের ৫০ শতাংশ বিশ্ববাসীর তুলনায় ২০ গুণ বেশি সম্পদ কুক্ষিগত করেছে। যদি মার্কিন দেশের কালো মানুষদের গড় আয়ু সাদা আমেরিকাদের সমান হত তাহলে ৩৪ লক্ষ অতিরিক্ত কালো মানুষ সেদেশে এখন বেঁচে থাকত; কোভিডের আগে সেই ভয়ানক সংখ্যাটা ছিল ২১ লক্ষ। কোভিড তাকে দেড়গুণ করে তুলেছে। বিশ্বের ধনীতম ২০ জন শতকোটিপতি দরিদ্রতম ১০০ কোটি মানুষের তুলনায় ৮,০০০ গুণ কার্বন গ্যাস নিঃসরণ করে চলেছে। অতিমারীর শুরু থেকে প্রতি ২৬ ঘন্টায় বিশ্বে একজন করে নতুন অর্বুদপতি তৈরি হয়েছে, অপরদিকে ১৬ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে।

সামগ্রিকে এই বিশ্ব এখন ধনীদের দ্বারা গরিবদের শোষণের নরক হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষও তাই। গ্লোবাল ইনইকোয়ালিটি ল্যাবের প্রতিবেদন তেমনটাই বলছে। এদেশের আয় ও সম্পদের তালিকা অনুযায়ী নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ অধিবাসীর মাথাপিছু আয়ের তুলনায় উপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশের মাথাপিছু আয় ২২ গুণ, এবং অতিধনী ১ শতাংশের মাথাপিছু আয় ৭৭ গুণ। সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরো ভয়ানক। অতিধনী ১ শতাংশের মাথাপিছু সম্পদ এবং ধনী ১ শতাংশের মাথাপিছু সম্পদ নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশের মাথাপিছু সম্পদের যথাক্রমে ২৮০ গুণ ও ৫৫ গুণ। লক্ষ্যণীয় যে, ভারতে অসাম্য বরাবরই বেশি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে উপরের ১০ শতাংশ মোট জাতীয় আয়ের ৫০ শতাংশের ভাগিদার ছিল। স্বাধীনতার পরে পরিকল্পিত অর্থনীতির সুবাদে এই অনুপাত ৩১ শতাংশে নেমে এসেছিল। ৮০’র দশকের মধ্যভাগ থেকে ক্রমাগত অর্থনৈতিক উদারীকরণ বৈষম্যকে বাড়িয়ে চলেছে ও সেই অনুপাত বাড়তে বাড়তে ৫৭ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। কেবল তাই নয়, অতিধনী ১ শতাংশের আয়ের অনুপাত দাঁড়িয়েছে মোট আয়ের ২২ শতাংশ।

কেবল আয় বা সম্পদের বৈষম্যই নয় লিঙ্গ বৈষম্যও এদেশে প্রকট ও প্রবল। ভারতে আয়ের ক্ষেত্রে মহিলা শ্রম থেকে প্রাপ্ত আয়ের অনুপাত মাত্র ১৮ শতাংশ। যা এশিয়ার (চিন বাদে) অনুপাতর (২১ শতাংশ) থেকে কম ও পৃথিবীতে সর্বনিম্নগুলির মধ্যে একটি, কেবল মধ্য এশিয়ার (১৫ শতাংশ) থেকে উন্নত। মনে রাখা দরকার মধ্য এশিয়ায় নারী স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য ভাবে নিম্নস্তরের। পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রেও ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। ভারতের নিচের স্তরের ৫০ শতাংশ মাথাপিছু ১ টন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী, উপরের ১ শতাংশ তার ৩২ গুণ অর্থাৎ মাথাপিছু ৩২ টন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। ফলে ধনীদের হাতে কেবল আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে গরিবরা শোষিত হচ্ছে তাই নয়, পরিবেশকে বাস-অযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রেও সেই শোষণ ব্যাপ্ত হয়েছে।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-5