গৌরী লঙ্কেশ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে গত ২৯ জানুয়ারি তিনি বয়সে হতেন ষাট। ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবাদী সাংবাদিক, সম্পাদক, অনুবাদক এবং সমাজকর্মীকে রাত্রি আটটা নাগাদ নিজের বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই কালো রাতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কর্নাটক এবং দেশের সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা বিরোধী অন্যতম কণ্ঠস্বর। গৌরী তাঁর সাপ্তাহিক ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে’তে শেষ যে সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন সেটির শিরোনাম ছিল, ‘ইন দ্য এজ অফ ফলস নিউজ’। তিনি লিখেছিলেন দেশে মোদী-ভক্তরা গোয়েবলসের অনুসরণে ভূয়ো খবর ও মিথ্যাচারের কারখানা খুলে বসেছে। তিনি এধরণের অনেক মিথ্যা খবরের সন্ধান দিয়েছিলেন এবং বিশেষ করে গণেশ চতুর্থীর সময়ে একটি গুজবের উল্লেখ করেছিলেন যার থেকে অনায়াসে সাম্প্রদায়িক হানাহানি হতে পারত। সৌভাগ্যবশত কর্ণাটক পুলিশ প্রেস কনফারেন্স করে সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। এই গুজবের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি ‘পোস্টকার্ড.নিউজ’ নামে একটি ওয়েবসাইটের সন্ধান পান যেটি উগ্র হিন্দুত্ব বাহিনী দ্বারা পরিচালিত।
আমরা জানি গৈরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান দৌরাত্মের বিরুদ্ধে গৌরী ছিলেন এক অদম্য, অকুতোভয় সৈনিক। এরজন্য তাঁকে প্রতিনিয়ত ট্রোল করা হয়েছে, উড়ো চিঠি এসেছে, ফোনে খুন করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি এসবে কোনও গুরুত্ব দেননি, তাঁর ঘনিষ্ঠদের মতে, তিনি ভাবতেই পারেননি তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। অবশেষে সেটাই হল। সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দু ধর্মান্ধরা তাঁর হত্যায় উল্লসিত হয়। এঁদের মধ্যে আছেন এক যুবনেতা যাঁর টুইটার একাউন্ট খোদ প্রধানমন্ত্রী অনুসরণ করেন।
গৌরীর ষাটতম জন্মদিনে ‘সিটিজেন্স ফর পিস এন্ড জাস্টিস’ একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে যেখানে গৌরীর মতন প্রতিবাদী নারীদের আজকের যুগে যে কী সর্বাত্মক এবং ভয়ানক হিংসার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা হয়। গত সাড়ে তিনবছরে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় ট্রোল বাহিনীর উপস্থিতি বহুগুণ বেড়ে গেছে। খুন, ধর্ষণের হুমকি দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে গেছে, এমনকি গণহত্যার ডাকও দেওয়া হচ্ছে। সরকার বা শাসক দলের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে সাইবার ও বাস্তব জীবনের হামলাকারীরা লাগামছাড়া ভাবে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
সফুরা জরগরকে আমাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে। শাহীনবাগের অন্যতম সংগঠক ছিলেন, দিল্লী ‘দাঙ্গা’র পরে অন্তঃসত্বা অবস্থায় যাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঐ অবস্থায় তিনি তিন তিনবার জামিনের আবেদন করলেও নাকচ হয়ে যায়। সরকারি উকিল যুক্তি দেয় এর আগে বহু মহিলা কয়েদী জেলে সন্তান প্রসব করেছেন, তাঁর ক্ষেত্রে কেন ব্যাতিক্রম হবে? তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কুৎসার বন্যা বয়ে যায়। অবশেষে জামিন পাওয়ার পর সফুরা স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে ফিরে যান। তখন সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু হয়েছে, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, ফেসবুক, টুইটারে তাঁর বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেপ্তার নিয়ে তুমুল হৈচৈ। দেখা গেল অনেকে রিয়াকে উপদেশ দিচ্ছেন তুমিও সফুরার মতো অন্তঃসত্বা হয়ে যাও, তোমার জামিন হয়ে যাবে! সফুরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! তিনি তো কোনও কিছুতে নেই, পারিবারিক জীবনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তিনি বুঝে গেলেন তাঁর নিস্তার নেই। যে ভয়ঙ্কর ইস্লামোফোবিক, নারী-বিদ্বেষী বাতাবরণ সারা দেশ জুড়ে ডালপালা বিস্তার করেছে তা তাঁকে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবেনা। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, চুপ করে থেকে লাভ নেই, সরব হতে হবে। এরপরে সফুরা বলেন যে, আজ যখন মুসলিম মহিলাদের একই রকমভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, নেট মাধ্যমে তাঁদের শরীর নিলাম করা হচ্ছে, তখন অনেকে আমাদের উপদেশ দিচ্ছেন যে এগুলো শুধু নেটজগতেই ঘটছে, বাস্তবে এসব কিছু হবেনা। কিন্তু গৌরীর বেলায় তো তিনি সেটাই ভেবেছিলেন, কিন্তু খুন হয়ে গেলেন। আজ ‘সাল্লি ডিলস’এ যে নারীকে নিলাম করা হয়েছে তাঁকে যে কেউ রাস্তায় চিনে ফেলে আক্রমণ করবে না এর কি নিশ্চয়তা আছে?
দেশজুড়ে যে মুসলিম ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটা নিয়ে খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেন সফুরা। দেখুন প্রথমে মুসলিম পুরুষদের শয়তানি (ডেমোনাইজ) রূপ দেওয়া হল। তাঁরা বহু বিবাহ করেন, তুতো বোনদের বিয়ে করেন, গাদাগাদা বাচ্চার জন্ম দেন, নারীদের মধ্যযুগীয় হিজাব, বোরখা পরিয়ে রেখে নির্যাতন করেন, তাঁরা অপরাধপ্রবণ ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর দেশজুড়ে নানা ছুতোয় তাঁদের পিটিয়ে মারা শুরু হল। তাঁদের অপদস্ত করার জন্য প্রকাশ্যে মোল্লা, কাটুয়া, পাকিস্তানি ইত্যাদি বলা শুরু হল। মুসলিম নারীরা তখন ঘরে বসে না থেকে ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শুরু করলেন। শাসক দল তিন তালাক বিরোধী বিল পাস করে তাঁদের খুশী করার, তাঁদের ত্রাতা সাজার চেষ্টা করল। কিন্তু নাগরিকত্ব আইন আসার পর যখন মুসলিম মহিলারা দলে দলে রাস্তায় নেমে এলেন, বিভিন্ন শহরে শাহীনবাগ গড়ে উঠল, তখন এই প্রতিবাদী জনতাকে আটকানোর জন্য তারা নিত্য নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করল। প্রকাশ্যে নারীদের কুৎসা করা শুরু হল, তাঁদের যৌন অঙ্গভঙ্গির ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হল; সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে এব্যাপারে মিডিয়া পুরো নীরব রইল, যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব! এরফলে এতো সাংঘাতিক সব ঘটনাকে আজ মনে হচ্ছে স্বাভাবিক; বাস্তব হচ্ছে একটা বারুদের স্তুপ তৈরি হয়ে গেছে, যেটা থেকে যখন তখন বিস্ফোরণ হতে পারে, চূড়ান্ত নৈরাজ্য শুরু হতে পারে দেশজুড়ে।
ইসমত আরা এই অস্বাভাবিক পরিবেশে একজন মুসলিম সাংবাদিকের কাজ করার নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরেন। গৌরী যখন মারা যান তখন তিনি একজন শিক্ষানবীশ ছিলেন এবং তাঁকে হত্যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ কভার করতে বলা হয়। এ’নিয়ে তাঁর মধ্যে নানা দ্বিধা দানা বাঁধে, তিনি ভাবেন আমি এটা করে নিজেকে বিপদে ফেলছি না তো। এখন ফোনে কারো থেকে কিছু জানতে চাইলে আমি চেষ্টা করি নিজের নাম না দেওয়ার, ইসমত বলেন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই কলকাতায় যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয়, এখানে সাল্লি ডিলসের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে একমাস সময় লেগে গেছে। নুর মহভিশ, আইনের ছাত্রী বলেন তাঁকে অভিযোগ দায়ের করার জন্য বারবার থানায় যেতে হয়েছে, বারবার অফিসারদের কেসটা মনে করিয়ে দিতে হয়েছে।
তিস্তা শেতলওয়াদ বলেন, আজ বিষয়টা খালি অসহিষ্ণুতা নয়, ঘৃণা একটা রাষ্ট্রীয় প্রকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পকে রূপায়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু গৌরী-পরবর্তী প্রজন্মের সংগ্রামী নারীরা তাঁর লড়াই ও আদর্শে উজ্জীবিত। তাঁদেরকে চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে না।
- সোমনাথ গুহ