৩০ জানুয়ারি গান্ধীর ৭৪তম শহীদত্ব বরণের বর্ষপূর্তিতে বিহারের আরওয়ালে ইতিহাস যেন জীবন ফিরে পেল। বিহারের এই ছোট জেলা আরওয়ালের সাথে গান্ধীর শহীদত্বের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
১৯৩৩ সালে আরওয়ালে একটি ছোট গ্রন্থাগার গঠিত হয়। এই গ্রন্থাগারটি খুব শীঘ্রই স্থানীয় যুবদের মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ১৯৪২সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে এই পাঠাগারের মাঠে ১১জন শহীদ হন, যাদের অনেকে এই পাঠাগারে প্রত্যহই যাতায়াত করতেন। গ্রন্থাগারটি পরিচিত ছিল ‘ফ্রেন্ডস ন্যাশনাল লাইব্রেরী’ নামে কিন্তু গান্ধী হত্যার পরে এটির নতুন নামকরণ হয় ‘গান্ধী পুস্তকালয়’ নামে।
১৯ এপ্রিল ১৯৮৬, গান্ধী পুস্তকালয়ের মাঠে নিরস্ত্র ভূমিহীন কৃষি মজদুররা একটি সভায় সমাবেশিত হয়েছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ সেই সভায় পুলিশ গুলি চালিয়ে ২৩ জনকে হত্যা করে। শহীদ হন — চন্দ্রশেখর রাম, আশরাফ মিঁয়া, রাজেন্দ্র সাউ, অনিল রাম, জয়েন্দ্র রবিদাস, করিমন রবিদাস, প্রেমন রবিদাস, শ্রীবংশ পন্ডিত, বাঙালি রবিদাস, পখোরা রবিদাস, চন্দ্রমা পাসওয়ান, রামদেব যাদব, বিজেন্দ্র সাউ, পাপ্পু রবিদাস, বালকেসিয়া দেবী, গঙ্গা মাঁঝি, মনমতী দেবী, একজন বালিকা যিনি সঞ্জীবন মোচীর কন্যা এবং তিনজন অপরিচিত ব্যক্তি। সারা দেশের মানুষ গর্জ্জে উঠলেন স্বাধীন ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগের এই পুনরাবৃত্তিতে।
২০২০’র বিধানসভা নির্বাচনে আরওয়ালের বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত হন সিপিআই(এমএল)-এর মহানন্দ। সোন নদীর ওপারে ভোজপুর জেলার তরারি থেকে পুনর্নির্বাচিত হন সুদামা প্রসাদ। সিপিআই(এমএল)-এর মোট ১২ জন বিধায়কের মধ্যে এই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকা পাটনার পালিগঞ্জ এবং জাহানাবাদের ঘোষী থেকে নির্বাচিত হন এআইএসএ নেতা সন্দীপ সৌরভ ও রামবলি সিং যাদব। সুদামা বিহার বিধানসভার লাইব্রেরি কমিটির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁর প্রধান কাজ এখন বিহারের পরিত্যক্ত ও ভগ্নদশাপ্রাপ্ত সরকারি গ্রন্থাগারগুলির সংস্কার করা।
১৯৪২ এবং ১৯৮৬ সালের ঘটনার স্মৃতি উদযাপন সভায় শহীদদের পরিবারদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন ১৯৪২ সালের শহীদ খাখো পাসওয়ানের নবতিপর স্ত্রী ধানওয়া কুঁয়ার। সভায় বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণ এটা প্রমাণ করে যে গান্ধী পুস্তকালয়ের নবপর্যায়ের জন্য তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এই আরওয়াল। স্থানীয় মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ১৮৫৭ সালের তৎকালীন স্থানীয় বীর যোদ্ধা জীবধর সিং, আমরুদ্দীন খান এবং সেখ গুলাব। গান্ধী পুস্তকালয়ের পরে স্থানীয় খাবাইনি পঞ্চায়েত কোমর বাঁধছে আগামী ১০ মে, ১৮৫৭ সালের বীর নায়কদের স্মৃতি উদযাপনের জন্য।
গান্ধীকে হত্যা করে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তরা ভেবেছিল নয়া প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে সময়মতো অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলে দেওয়া যাবে। কিন্তু এই ঘটনা তাদের মুখোশ খুলে দেয় এবং মানুষ তাদের বিচ্ছিন্ন করেন। নয়া ভারত, নয়া সংবিধানকে নিয়ে চলতে থাকে। ৭০ বছর পর দেশ এখন আরও মারাত্মক ও সর্বাত্মক ফ্যাসিস্ত আক্রমণের মুখোমুখি। তাদের নির্বাচিত সরকার দানবীয় আইন এবং প্রযুক্তি নির্ভর গোয়েন্দাগিরি নিয়ে সংবিধানকে বানচাল করার জন্য উদয়াস্ত খাটছে। তাদের ‘ধর্ম সমাবেশে’ ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীরা সন্ন্যাসীর ভেক ধরে ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে মাঠে নেমেছে এবং ইতিহাস হচ্ছে তাদের মুখ্য ময়দান। আমরা এরথেকে শিক্ষা নিতে চাই যাতে ইতিহাসের মর্মন্তুদ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এরজন্য আমাদের ধিকৃত না হতে হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকে অনুপ্রেরণা ও সাহস সঞ্চয় করে, নতুন গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্যে আমরা এই আন্দোলনের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যের উত্তরসূরীদের পুনরায় সর্বশক্তি নিয়ে সংহত হতে হবে এই ফ্যাসিস্তদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করার জন্য। ভগৎ সিং, গান্ধী এবং আম্বেদকরদের পরবর্তী প্রজন্মকে সাভারকর, গডসে ও গোলওয়ালকরের উত্তরসূরীদের অবশ্যই গদিচ্যুত করতে হবে।