কোভিড অতিমারীর যন্ত্রণা ও কৃচ্ছতার সময়কে অমৃত-কাল নামে চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বাজেট জনতার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল
নয়াদিল্লি, ১ ফেব্রুয়ারি
মোদী সরকারের বারম্বার উচ্চারিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০২২ সাল কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হওয়ার বছর। সে বিষয়ে ২০২২-২৩-এর বাজেটের নিস্তব্ধতা অতি প্রকট। বাজেটে কৃষি-বিনিয়োগে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়েছে ও কৃষকদের মূল চাহিদা সমস্ত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা সম্পর্কে কোনো নির্দেশ নেই।
বাজেটের অব্যবহিত আগে প্রকাশিত অক্সফ্যামের বৈষম্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিতে ভারতে অর্থনৈতিক অসাম্যের চূড়ান্ত বৃদ্ধি প্রতিফলিত হয়েছিল, যেখানে দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় ২০২১ সালে কমেছে, কিন্তু সমকালে ভারতে শত-কোটিপতির সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে ১৪২ হয়েছে। কর্পোরেট কর কমিয়ে ও দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধির জন্য কোন সুরাহা না করে বাজেট ওই বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তোলার রাস্তা বেছে নিয়েছে।
ক্রমহ্রাসমান অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মাঝে ভারত বিপুল বেকারির জ্বালায় ধুঁকছে (সিএমআইই তথ্য অনুসারে ডিসেম্বর ২০২১-এ ৫.২ কোটি ভারতীয় কর্মপ্রার্থী বেকার রয়েছে)। কর্মসংস্থান ও সাধারণ জনতার আয়ের নিশ্চয়তা সম্পর্কে বাজেট লজ্জাজনকভাবে নিশ্চুপ।
একটি সংসদীয় কমিটির সুপারিশকৃত এমএনআরইজিএ-র শহুরে সংস্করণের বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি তো দূরের কথা, অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় এমএনআরইজিএ-র মতো জীবন-দায়ী প্রকল্পের উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন।
বর্তমান সময়কে ‘অমৃত কাল’ বলে ঘোষণা করে পোষা প্রচারমাধ্যমের দ্বারা বাজারজাত করার মতো আকর্ষক হেডলাইন খুঁজে বের করার ঝোঁক অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বজায় রেখেছেন। যখন কোটি কোটি সহনাগরিক টিঁকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত তখন রহস্যময়ভাবে দাবি করছেন যে এই বাজেট কেবল ১ বছরের জন্য নয়, দেশের শততম বছরের স্বপ্নকে বহন করছে, এবং ফলে আগামী ২৫ বছরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত সরকারের একটি বার্তা রয়েছে এই বাজেটে।
বাজেট বক্তৃতায় অনুপস্থিত ছিল ২০২২ সালের জন্য মোদী সরকারের পূর্বতন বৃহৎ ঘোষণাগুলির নির্দিষ্ট মূল্যায়ন, যথা কৃষি আয় দ্বিগুণ করা, সকলের জন্য বাসস্থান, সকলের জন্য বিদ্যুৎ। ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি প্রদানকারি মোদী-২ সরকার কর্তৃক পেশযোগ্য বাজেটের এটি হচ্ছে প্রাক-চূড়ান্ত বাজেট; কিন্তু সে বিষয়ে বাজেট কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। গ্রামীণ দরিদ্র, কৃষি শ্রমিক, কৃষক, ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধাপ্রদান বিষয়ে সরকারের অতিরঞ্জিত দাবিগুলিকে মেটানোর জন্য অতিরিক্ত বর্ধিত বরাদ্দের কোনো চিহ্ন বাজেটে দেখা যায়নি।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা দাবি করেছে যে, ২০২১-২২ সালে প্রকৃত বৃদ্ধি হবে ৯.২ শতাংশ, যা ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রাক-কোভিড স্তরে নিয়ে যাবে, এবং কর সংগ্রহ ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তব হল যে কর রাজস্বের এই মনমাফিক বৃদ্ধিও লকডাউনের কৃচ্ছতা এবং অতিমারীর সময়ে পেট্রল ডিজেল সমেত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপরে আরোপিত করের রেকর্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে জনতার সঞ্চয় চুষে নিয়ে ও তাদের ছোট্ট পকেট কেটেই ঘটেছে, যা ২০২১-২২ সালের সংশোধিত অনুমিত উৎপাদন শুল্কের রেকর্ড সংগ্রহের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে যা লাফিয়ে ৩,৯৪,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যথাযথভাবে দেখতে গেলে, গত অতিমারীর বছর ২০২০-২১-এও উপরোক্ত সংগ্রহ ছিল ৩,৯১,৭৪৯ কোটি টাকা, কিন্তু অতিমারীর আগের বছরে তা ছিল মাত্র ২,৩৯ লক্ষ কোটি টাকা। রাজস্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃদ্ধিটি ঘটেছে আরবিআই-এর উদ্বৃত্ত থেকে অর্থ সংস্থান করে যা ২০২১-২২ সালের সংশোধিত অনুমানে ১,৪৭,৩৫৩ কোটি টাকা, এবং ২০২২-২৩-এর বাজেটে যার পরিমাণ ১,১৩, ৯৪৮ কোটি টাকা, যা পরিবারের সোনা দুঃসময়ে বেচার সামিল। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার বছরে ২০১৪-১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝারি সময়ের গণঋণ ছিল ৫৮.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা যা এখন ১১৭.০৪ লক্ষ কোটি টাকা। এর কারণ হল বিজেপির তহবিল সরবরাহকারী কর্পোরেট ও উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে কর আদায়ের ক্ষেত্রে অনীহা। এটি সরকারি তহবিলের উপর চাপ বাড়ায় ও মানবোন্নয়নের দিক থেকে গণ ও সামাজিক কল্যাণের নিমিত্ত ব্যয়কে খর্বিত করে।
পেট্রল ডিজেলের উপর কর বাড়িয়ে, আরবিআই-এর উদ্বৃত্ত তুলে নিয়ে, এবং ক্রমাগত রাষ্ট্রায়ত্ব উদ্যোগকে বিক্রি করে সরকার যখন জনগণের সঞ্চয়কে রিক্ত করছে, আগামী বছরের বাজেট কেবল ভর্তুকি ছাঁটাই করেছে ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামোন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির বরাদ্দ স্থির রেখেছে। সরকার খাদ্যের উপরে ভর্তুকির পরিমাণ ২০২১-২২-এর সংশোধিত বাজেটের ২,৮৬,৪৬৯ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২,০৬, ৮৩১ কোটি টাকা করেছে। অনুরূপ ভাবে, সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ সংশোধিত বরাদ্দের ১,৪০,১২২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১,০৫,২২২ কোটি টাকায় নামাতে চাইছে।
কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছে ১,৫১,৫২১ কোটি টাকা (২০২১-২২-এ সংশোধিত বরাদ্দ ১,৪৭,৭৬৪ কোটি), কোভিড আক্রান্ত স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ ৮৬,৬০৬ কোটি (সংশোধিত বরাদ্দ ৮৫,৯১৫ কোটি) টাকা এবং গ্রামোন্নয়নে ২,০৬,২৯৩ কোটি (সংশোধিত বরাদ্দ ২,০৬,৯৪৮ কোটি) টাকা। মুদ্রাস্ফীতিকে ধরলে বাস্তবে বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। শিক্ষায় বরাদ্দ ১৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১,০৪,২৭৮ কোটি টাকা করা হলেও গত দুবছরে অতিমারীর ফলে আক্রান্ত শিশু শিক্ষার সহায়তার জন্য বিপুল প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার কথা খেয়াল রাখলে এই সীমিত বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়।
অতিমারীর ফলে দুর্দশাগ্রস্ত মধ্যবিত্তরাও বাজেটে আয়করের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধার প্রত্যাশা করছিল কিন্তু সরকার করহারে পরিবর্তন ঘটায়নি। পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহকে প্রত্যক্ষ করের স্তরে পৌঁছে দিয়ে জনসাধারণকে রাজস্বের বোঝা বহন করতে বাধ্য করে কর্পোরেট ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বনিম্ন কর হারের সুবিধে বজায় রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিকে বিক্রির তথাকথিত ‘কৌশলগত বিলগ্নিকরণ’ নীতির ঘোষণা দেশের অর্থনীতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এয়ার ইন্ডিয়া, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক, পবন হংস এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রির ঘোষণার মধ্য দিয়ে বেসরকারিকরণের ধারা বজায় রাখা হয়েছে। বিপুল বিরোধিতা সত্বেও, সরকার এই বাজেটে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্ক ও সাধারণ বীমা কোম্পানির বেসরকারিকরণ পরিকল্পনা কার্যকরী করার কথা ঘোষণা করেছে। প্রকারান্তরে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করার ধাপ হিসেবে এলআইসি-র আইপিও ছাড়ার পরিকল্পনাকে কর্মচারি সংগঠনগুলি ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করা সত্বেও সেটি আবার ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি কোনো ধরনের পরিকল্পনা ব্যতিরেকে অর্থমন্ত্রীর ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করার ঘোষণা প্রকৃত প্রতিশ্রুতির বদলে মিথ্যা বলেই মনে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্তরে, অশোধিত তেলের দাম বেড়ে চলেছে (ফলে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির নগদ যোগানকে খর্বিত করার ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে যা বৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য মোদী সরকারের ভরসাস্থল বিদেশি প্রত্যক্ষ ও বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকে প্রভাবিত করতে পারে)। ভারতের মুদ্রাস্ফীতি দু-অঙ্কের স্তরে পৌঁছে গেছে যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সেই ধূমধাম করে ঘোষিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজে থাকা ঋণের যোগানের মাধ্যমে সামগ্রিক চাহিদার ঘাটতি মেটানোর কৃত্রিম সরকারি কৌশল শেষ সীমায় পৌঁছেছে। তা সত্বেও মোদী সরকার জনসাধারণকে তাৎক্ষণিক সুরাহা প্রদান বা যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি বিনিয়োগের দ্বারা অর্থনীতিতে রাজকোষ-উদ্দীপনা যোগান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ঋণের রাস্তাটিও সঙ্কটে পড়ায় ভারতীয় অর্থনীতি কীভাবে ২০২২-২৩ সালে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় অনুমিত ৮-৮.৫ শতাংশ বৃদ্ধির হারে পৌঁছবে সেটাও দুর্বোধ্য। এই প্রসঙ্গে এটি বলা অনুচিত হবে না যে ২০১৯-২০ সালে প্রাক-কোভিড বর্ষে বৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশের কম।
সব মিলিয়ে তাই বাজেট ২০২২ যুবক, কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কিন্তু ভারতের শত-কোটিপতিদের সহায়তা করেছে।
- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি