গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের দ্বাদশতম সম্মেলন অত্যন্ত সফলতার সাথে সমাপ্ত হয়েছে। এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায় মৌলালি যুবকেন্দ্রের শঙ্খ ঘোষ নগরে, যূথিকা রায়-অমিতাভ সরকার সভাগৃহে। মঞ্চের নামকরণ হয় পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি ও বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী প্রবীর বল ও সবার ভালোবাসার ও দায়িত্বশীল সংগঠক গায়ক অমিতাভ দে (ফুচকন) উভয়ের নামে। ‘কাণ্ডির’এর শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে “শত শহিদের রক্তে রাঙা পতাকা আজ আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি” শুনতে শুনতে সভাস্থল সংহত হয়ে উঠতে থাকে। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট নাট্যকার অভিনেতা ও সুপণ্ডিত শ্রী তীর্থকংর চন্দ মহাশয়। শহীদবেদীতে মাল্যদান ও তাঁদের স্মৃতিতে নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। শ্রী চন্দ তার উদ্বোধনী ভাষণে বর্তমান সরকারি সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি হিসাবে তুলে ধরেন। ভাষাজনিত বিচ্ছিন্নতার কথায় বরাক উপত্যকার ১১ জন শহীদ মহিলাকে স্মরণ করেন। শিল্প, থিয়েটার ইত্যাদির ভাষা নিয়ে আলোচনার সাথে সাথে স্কুলে কার্ড নামক এক সন্ত্রাসময় খেলার উল্লেখ উঠে আসে। এই ভয়ংকর বিচ্ছিন্নতাবোধকে সংস্কৃতি দিয়ে কীভাবে দূর করা যায় সে বিষয়ে তিনি এক গভীর ও মনোগ্রাহী আলোচনার সূত্রপাত করেন। সুমেলী চক্রবর্তীর “জননী গো কাঁদো, আরও কাঁদো তুমি শত শহীদের মা” সুললিত গানে “আমরা তো আছি বেঁচে”র ভরসা ছড়িয়ে পড়ে।
বিদায়ী সম্পাদক নীতীশ রায় খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনের উপরে প্রতিনিধিরা বেশকিছু গঠনমূলক পরামর্শ দেন। তীর্থংকর চন্দর কথার রেশ ধরে পশ্চিম বর্ধমানের কৃশানু ভট্টাচার্য বলেন, ছবি বা লেখা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যা মানুষ বুঝতে পারে। যেমন, শিল্পী রবি বর্মা ঠাকুর দেবতাদের ছবি এঁকে নিচুজাতের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কারণ মন্দিরে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ঈঙ্গিত সংস্থার দীপক চক্রবর্তী মুখের কুভাষা কীভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে ভাবতে বলেন। তিনি আরও বলেন যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে বিগতদিনের বামপন্থীদের গৌরবোজ্জ্বল প্রয়োগ শিল্পকলাগুলিকে স্মরণ করতে হবে। বারাসাত অন্যমনের তপন কাহালি বলেন, “লকডাউনে আমরা অনেক মানুষকে হারিয়েছি। সংস্কৃতিকে যেন না হারাই। গণসঙ্গীতের পাশাপাশি বাউল, লোকশিল্প, ছৌনাচ এগুলোকেও নিতে হবে, নিতে হবে গ্রাম পরিক্রমার উদ্যোগও।” বজবজের ‘চলার পথে’র সাবীর শেখ (রাজা) গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত ‘মিটিংগুলিতে পঞ্চাশ শতাংশ উপস্থিত হলে মিটিং মান্যতা পাবে’র বদলে উপস্থিতি এক-তৃতীয়াংশ করার পরামর্শ দেন। এছাড়াও, মধ্যমগ্রাম শাখার অজয় সাহা, কবি গোপাল স্যাটিয়ার সহ আরও কয়েকজন মতামত রাখেন।
অতিথিদের মধ্যে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণে বিজেপি কোনোভাবেই যাতে বাংলাকে তাদের ল্যাবরেটরিতে পরিণত করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার আবেদন জানান। সেক্ষেত্রে সৃজন, প্রতিরোধ ও সংহতির সংস্কৃতিকে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করার বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তাও ব্যখ্যা করেন। সামনে পার্টির একাদশ পার্টি কংগ্রেস ও রাজ্য সম্মেলন আছে। সেই লক্ষ্যে গান ছবি পোস্টার তৈরি করার আবেদনও জানান।
লেখক, গবেষক ও নবান্ন পত্রিকার বন্ধু নিত্যানন্দ ঘোষ অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, নবজাগরণের মনীষীদের পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। যেমন রাজা রামমোহন বৃটেনে বসেই ভারতের কৃষকদের কর মকুবের দাবি তুলেছিলেন। নারীদের সুরক্ষার বিষয় নিয়েও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
দীর্ঘ আলোচনার মাঝে মাঝে সদস্য সদস্যারা তাদের গান কবিতা সম্মিলিত আবৃত্তি দিয়ে সভাকে সর্বসময় প্রাণোচ্ছল করে রাখেন। সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে মীরা চতুর্বেদী ও কলকাতার সায়ন-অয়ন্তিকার লালন গীতিতে মুগ্ধ গোটা সভা। বরিষ্ঠ গীতিকার সুরকার ও গায়ক প্রণব মুখোপাধ্যায় (রাঙা মামা) তাঁর নিজের গানে “বাংলা ভাষায় কথা বলি মোরা/ বাংলাতেই গান/ বাংলা মোদের মাতৃভাষা/ অমৃত সমান” আজও সাবলীল। আর ছোট্ট মেয়ে মেহুলীর কণ্ঠে “সবকটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো বিজয়ের গান” চোখে জল এনে দেয়। একই রকম উদাত্ত কন্ঠে বিশ্বরূপ আর রাজা সভাকে চনমনে করে দেন। বালীর ঈঙ্গিতের সাথীরাও সুন্দর গাইলেন। কবিতা পাঠ করলেন কৌনিক সেন। মধ্যমগ্রাম শাখার সমবেত আবৃত্তি পরিবেশনায় পরিবেশ মথিত হয়ে গেল। সভায় তরুণ যুবদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মোট উপস্থিতি ১০১ জন। উত্তরবঙ্গ, দুই ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলি, পশ্চিম বর্ধমান ও কলকাতা থেকে ১৬টি সংগঠনের ৬০ জন, ব্যক্তিগতভাবে ৩০ জন ও ১১ জন অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
একগুচ্ছ কর্মসূচি ও সবার সমর্থন নিয়ে খসড়া প্রতিবেদন গৃহীত হয়। ৫৮ জনের রাজ্য কাউন্সিল ও ১৯ জনের (৮ জন তরুণ-যুব বয়সের) কার্যকরী সমিতি তৈরি হয়। দেবাশীষ চক্রবর্তী পুনরায় সভাপতি পদে মনোনীত হন। সম্পাদক মনোনীত হন ‘অগ্নিবীণা’র সংগঠক ও বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী শ্রী সরিৎ চক্রবর্তী (বাবলি)। বিদায়ী সম্পাদক শ্রী নীতীশ রায় তার বিদায়ী ভাষণে বয়ষ্ক সাথীদের অবদান স্বীকার করে তরুণদের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান। নতুন সম্পাদক শ্রী সরিৎ চক্রবর্তী আবেগঘন গানে ও কথায় পেছনের সাথীদের সামনে টেনে আনার ও যারা বিভিন্নভাবে মূল সংগঠন থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাদের সংগঠনে নিয়ে আসার কথা বলেন। সভার শেষে আনিস খানের নৃশংস হত্যার নিন্দা করে হত্যার বিচারের দাবি তোলা হয়। সবশেষে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক গানের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।