“তোমার লেবুগাছের কড়াগুলি কত বড় হইসে? ডাক্তার বলছে, ছয়মাস পর ভাত খাইতে পারুম — কী জানি।” মেয়েটা উদাস গলায় বলেছিল। বেশ কয়েক মাস আগে। কতদিন ভাত খায় না। গরম ভাত। পাতলা মুসুর ডাল। গন্ধ লেবু দিয়ে মাছের ঝোল। প্রায় দু’বছর শুধু তরল পানীয় খেয়ে বেঁচে থাকা মেয়েটার মুখে আর কোনোদিন কোনো আক্ষেপ শুনিনি।
সত্যি কখনও ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। বলা যায় না। এড়িয়ে যেতে হয়। আমার অজানা কোনও কারণে গন্ধলেবুর কড়াগুলো শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছিল। গাছটাও ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। আমি সেকথা বলতে পারিনি ওকে। ও হেনরির সেই মর্মস্পর্শী গল্পটা মনে পড়ে গিয়েছিল।
প্রায় দু’বছর বীরাঙ্গনার মতো লড়ে অবশেষে হার মানতেই হল কালান্তক রোগের কাছে। ঠোঁটের ক্যানসার। তার বন্ধুরা, পরিবার, পার্টি কমরেডরাও অক্লান্ত লড়াই চালিয়েছিলেন সমান তালে। শেষ প্রায় একবছর তার শয্যার পাশে থাকা সেবিকা দিদিও প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন ওকে একটু ভালো রাখার। তবু চলে গেল স্বজন বন্ধু সংগঠন পড়শিদের অতি প্রিয় ‘কুহেলি’। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে। রেখে গেল ঊনিশ বছরের একমাত্র সন্তানকে, যে এগারো বছরে পিতৃহীন হয়েছিল। শবানুগমনে দল-মত-বয়স-লিঙ্গ নির্বিশেষে অগুন্তি মানুষের ভীড় দেখে বোঝা গেল ঐ ‘সাধারণ মেয়ে’র কী অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মানুষকে আপন করে নেওয়ার!
কোনও কেতাবি পাঠ নিয়ে সে রাজনীতিতে আসেনি। এসেছিল জীবনের সুতীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা থেকে; কয়েকটি দরদী মানুষকে দেখে যারা ওর ভয়ঙ্কর সংকটে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, বিপর্যস্ত জীবনটা খানিক গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। তার সহজাত মানবিকতা তো ছিলই — যেটা ‘বামপন্থী’ হওয়ার জন্য আবশ্যিক।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ‘কুহেলি’ সংগঠনে একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। কমরেডদের প্রতি মমত্ব, প্রত্যেকের খোঁজ রাখা, অতুলনীয় সময়নিষ্ঠতা, প্রত্যেকটি কর্মসূচিতে তার উজ্জ্বল মুখর উপস্থিতি, সংগঠনের ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ বা কোনও কমরেডের কোনও আচরণ তার সাংগঠনিক বোধ থেকে অসঙ্গত মনে হলে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করা — যে কোনও সংগঠনের সম্পদ তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো কোনোদিন ভোলা যাবে না।
কত দিনের কত কথা। মিছিল, পথসভা, পোস্টারিং, গণ অর্থসংগ্রহ অভিযান, পার্টি বৈঠক, পার্টি মুখপত্র নিয়ে আলোচনা, মহিলা সমিতির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান — সবেতেই সে উপস্থিত সবার আগে। দেরিতে আসার জন্য অন্যদের প্রতি বরাদ্দ ছিল তার বকুনি। একদিন পথসভার পর সবাই দোকানে চা খাচ্ছি। ও কিছুতেই খাবে না। কেন? না, গরম চা খেতে পারবে না। আমরা নীরবে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম সভয়ে। ওর ব্যাগে সব সময়ই ‘শিখর’এর প্যাকেট থাকতো। দিনে চার প্যাকেট। নিজেই জানিয়েছিল। কত বলেছি, ভয় দেখিয়েছি, “ছেলেটাকে অনাথ করে চলে যাবি?” কিছুতেই তাকে ঐ বিষ খাওয়া থেকে নিরস্ত করা যায়নি। গরম চা-সিঙাড়া খেতে না পারার সংকেত স্পষ্ট হওয়ার পর জানিয়েছিল, ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে।
উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা পার্টি অফিস থেকে, কাঁচের গাড়িতে ফুলে ফুলে ঢাকা কমরেড কুহেলি বসুকে শেষযাত্রায় এগিয়ে দিলেন সিপিআই(এমএল), সিপিআই(এম)-এর স্থানীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে আইসা, এসএফআই’এর ছাত্রবন্ধুরা, আন্তর্জাতিক গাইতে গাইতে।
কিন্তু জীবনে এত বৈপরীত্য কেন? যে মানুষটা জীবনকে এত বর্ণময় প্রাণোচ্ছলতায় ভালোবাসতো, এই সেদিনও বিছানায় শুয়ে শুয়ে অসুস্থ কমরেডের বাড়ি ছেলেকে দিয়ে বাজার পাঠিয়েছে, কোনও দূরপনেয় গভীর চোরা অবসাদে সে দিনের পর দিন জেনেশুনে বিষ পান করে গেছে? প্রিয় সন্তানের কথাও ভাবেনি? আমরা শুধু বকেছি, কিন্তু সেই নৈরাশ্যের ঠিকানা কেন খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করিনি? কেন? কেন আমরা শুধু শারীরিক কুশল জানতে চাই, মনের অ-সুখের কথা মনে রাখিনা?
আজ মাছধোওয়া জল ফেলতে গিয়ে দেখি, মরা লেবুগাছের পাশ দিয়ে গজানো ছোট্ট চারাটা বেশ বড় হয়ে রোদ খুঁজছে। কিন্তু কুহেলি? আরেকটি কুহেলি কবে, কোথায়, কীভাবে পাব, যে বলবে, “সমিতির চান্দা দিতে তোমাগো মনে থাকে না ক্যান বুঝি না” বা “এত আগে ঠিক করা প্রোগ্রামে শেষমুহূর্তে আইতে পারবা না ক্যামনে কও?”
কমরেড কুহেলি! লাল সেলাম!
নতুন বসন্তের চিকণ সবুজে, লাল নিশানের ঝড় তোলা মিছিলে, বজ্রকণ্ঠের শ্লোগানে বেঁচে থাক! লড়াকু মানুষের মাঝেই পেয়ে যাব তোর ঠিকানা!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত