গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কাছে পুলিশের হেফাজতে অত্যাচারের প্রতিবিধান দাবি করে এক অভিযোগ পত্র পেশ করেন চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী। তিনি প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য স্তরের অন্যতম নেত্রী। অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে —
“আমি চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, ২১/১/১ ক্রিকরো, কলকাতা-১৪, আপনার কাছে বারুইপুর পুলিশ জেলার অন্তর্গত নরেন্দ্রপুর থানার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন (শারীরিক ও মৌখিক যৌন হেনস্থা, পুলিশ হেফাজতে শারীরিক অত্যাচার, পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চনা)-র অভিযোগ জানাতে এই চিঠি পাঠাচ্ছি।
৭ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কামালগাজি ব্রিজের নিচে একটি যৌথ প্রতিবাদসভায় আমি যোগ দিতে গেছিলাম। আমি সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির একজন কর্মী। নরেন্দ্রপুর থানাকে এই কর্মসূচি সম্পর্কে আগাম অবগত করা ছিল। সব মিলিয়ে আমরা ২০-২২ জন একত্রিত হয়েছিলাম। একজন পুলিশ এসে আমাদের প্রতিবাদ বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতে বলে। আমরা অসম্মত হলে তিনি বলেন যে বড়বাবু আর মেজবাবু আসছেন। একথা বলে তিনি চলে যান। আমরা টোটোতে বাঁধা মাইকে আমাদের বক্তব্য বলতে বলতে এগোতে থাকি। আমি মিছিলের সামনের দিকে ছিলাম। এক মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই দেখতে পাই একজন সাধারণ পোশাক পরিহিত ব্যক্তি একজন প্রতিবাদী রুদ্র প্রভাকর দাসের চুলের মুঠি ধরে মারতে শুরু করেছে। রুদ্র প্রভাকর দাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক। তিনি মিছিলের আগে আগে ফেসবুক লাইভ করতে করতে এগোচ্ছিলেন। রুদ্রকে মারতে দেখে আমি ছুটে যাই। লক্ষ্য করি আরও একজন ব্যক্তি আরেক ছাত্র আকাশ গুপ্তাকে মারছে। আমাকে রুদ্রর দিকে ছুটে যেতে দেখে পুলিশ আমাকে আটকায়, বলে, আপনি চলে যান। আমি প্রতিবাদ করায় বলে, “এই এটাকেও তোল”। দুইজন মহিলা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে, আমার হাতের প্ল্যাকার্ড কেড়ে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেয়।
বেশ কিছুটা হাঁটিয়ে নিয়ে আলোকমালায় সজ্জিত একটি বিয়ে বাড়িতে আমাকে এবং রুদ্র ও আকাশ সহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে ঢোকে পুলিশ। পরে বুঝতে পারি এটাই নরেন্দ্রপুর থানা। থানায় ঢুকে রুদ্র প্রভাকর দাস ও আকাশ গুপ্তাকে তাদের জীবন ও কেরিয়ার নষ্ট করে দেবার হুমকি দিচ্ছিল পুলিশ। এই সময় আমার মাসিক চলছিল বলে আমি থানার মহিলা পুলিশদের কাছ থেকে স্যানিটারি প্যাড চাই। মহিলা পুলিশরা প্যাড দিতে অস্বীকার করে। সেই অবস্থায় রাত সাড়ে ৯টার সময় ব্যাক্তিগত বন্ডে আমি সহ আটক ৬ জনকে ছাড়া হয়। আমরা যখন থানার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলাম আমাদের ছাড়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষারত বন্ধুরা স্লোগান দিয়ে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। স্লোগান দিতে দিতে থানার চত্ত্বর থেকে আমরা চলে যাচ্ছিলাম। দুঃখজনক ভাবে কোনো প্ররোচনা ছাড়াই নরেন্দ্রপুর থানার অফিসার ইনচার্জ অনির্বান বিশ্বাস নেতৃত্বে, থানার মেজবাবু সুশোভন সরকারের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী আমাদের সকলকে নিশানা করে লাঠি, ঘুঁষি, লাথি মারতে শুরু করে। ছাত্র, যুব, মহিলা ও বয়স্ক মিলিয়ে প্রায় ২০ জন মানুষের উপর নির্বিচারে পুরুষ পুলিশ এলোপাথাড়ি মারধর করতে থাকে থানার সামনে রাস্তার উপরে ফেলে। ঐ রাস্তা দিয়ে অটো ও গাড়ি চলাচল করছিল। রাস্তায় মারবার সময় পুলিশ অশ্লীল নারীবিদ্বেষী গালাগাল দিচ্ছিল। আমার স্বামী মলয় তেওয়ারী ওই জমায়েতে উপস্থিত ছিলেন। ওনাকে চুলের মুঠি ধরে চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে, ওনার মাথা বুট দিয়ে পিষে দিচ্ছিল পুলিশ। আমি তাঁকে বাঁচাতে যাই। তখন আমাকে দুইজন পুরুষ পুলিশ লাথি মারতে থাকে আর চুলের মুঠি ধরে হেঁচরাতে থাকে থানার দিকে। আমি জিজ্ঞেস করি, “আমাদের এভাবে কেন মারছেন?”। প্রত্যুত্তরে ওই পুলিশরা আমাকে যৌন-হেনস্থামূলক গালাগালি দিতে থাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করার হুমকি দেয়। এই অবস্থায় আমি দেখতে পাই, জমায়েতে উপস্থিত সৌমী জানা মলয় তেওয়ারীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলে তার পিছনে এলোপাথাড়ি লাথি মারা হচ্ছিল। এই অবস্থায় থানার সিঁড়ি দিয়ে চুলির মুঠি দিয়ে হেঁচরাতে হেঁচরাতে তোলা হয়। আমার মাসিকের রক্ত-ক্ষরণ খুব বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত ও অসুস্থ বোধ করছিলাম। পুলিশকে জানানো সত্ত্বেও থানার মধ্যে মহিলা পুলিশ আমার পেটে লাথি মারে। আমার সামনেই আমার স্বামী আর বন্ধুদের একই ঘরে লাঠি আর লাথি দিয়ে মারধর করতে শুরু করে পুলিশ। পুলিশের দুজন বারবার আমাদের “খানকি” বলে উল্লেখ করছিল। মলয় তেওয়ারি তার প্রতিবাদ করায় তাকে গুলি করে মেরে দেওয়ার হুমকি দেয় এবং সৌমী, বর্ষা ও আমাকে "দেখাচ্ছি তোদের" বলে হুমকি দিতে থাকে। এই হুমকি দেওয়ার সময় একজন পুলিশ বারবার নিজের জামা কোমর থেকে উপরে তুলছিল। স্পষ্টতই ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছিল তারা। আমাদের ফোন কেড়ে নিয়ে ফোনের পাসওয়ার্ড দেওয়ার জন্য লাথি মারে পুলিশ। আমরা চরম আতঙ্ক বোধ করে চুপ হয়ে গেছিলাম।
রাত ১২টার পরে আমাকে আর মলয় তেওয়ারীকে মেডিকেল চেক-আপের জন্য স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পৌঁছানোর পর আমাদের সরাসরি জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই অবস্থায় আমরা দুজনেই হাঁটতে পারছিলাম না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমরা জরুরী বিভাগে ঢুকি। সেখানে ডাক্তার আমাদের কোনো প্রশ্ন বা পরীক্ষা না করেই আগে থেকে তৈরি করা মেডিক্যাল ফিট সার্টিফিকেটে আমাদের নাম বসিয়ে দেয়। এই নিয়ে প্রশ্ন করলে পুলিশ ওখানেই আমাদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। চাপা হুমকি দিতে দিতে আমাদের গাড়িতে করে আবার থানায় ফেরত নিয়ে আসা হয়। ফিরে আসার পর আমাদের বলা হয় যে ব্যক্তিগত বন্ডে আমাকে আর মলয় তেওয়ারীকে জামিন দেওয়া হচ্ছে৷ আমাদের বন্ডের কাগজ পড়ার সময় না দিয়ে সই করতে বলা হয়।
আমার আর মলয় তেওয়ারীর বাজেয়াপ্ত করা ফোন ফেরত দেওয়ার সময় জোরজবরদস্তি আমাদের দিয়ে ওই দিনের সমস্ত ছবি আর ভিডিও ডিলিট করানো হয়।
আমার উপর হওয়া পূর্ববর্ণিত সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুবিচার প্রার্থনা করে আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি।”