৪ সপ্তাহ আগে, নভেম্বরের ৩০ তারিখ বিকেলে, যথাবিহিত বর্তমানকালে দেশের অর্থনৈতিক ‘প্রগতি’র একমাত্র সূচক ত্রৈমাসিক ‘জিডিপি’ তথা ‘জিভিএ’, অন্যকথায়, যথাক্রমে ‘মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন’ বা ‘মোট মূল্যযোগের হিসেব’ ঘোষিত হয়েছিল। দেশের মানুষকে সুশিক্ষিত বা সচেতন করার প্রচেষ্টা কোনো সরকার, কেন্দ্রীয় বা পশ্চিমবঙ্গ, করেছে, এমনটা তাদের ঘোর সমর্থক প্রমাণ করতে পারবেন না। কারণ তা না করলে পরিসংখ্যানের জাগলারির মধ্য দিয়ে অনায়াসে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো যায়। সেটা গত সাতবছরের কেন্দ্রীয় সরকার ও গত এগারো বছরের রাজ্য সরকারের আচরণ ও ঔদ্ধত্যে পদে পদে প্রমাণিত। তা নাহলে রাজ্য সরকার তিনবছর আগে অনায়াসে বলতে পারেনা যে আমরা কৃষকদের আয় ৩ গুণ করে দিয়েছি, বা কেন্দ্রীয় সরকার বলতে পারে না যে, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করতে চলেছি বা, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের জাতীয় আয় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার (বর্তমান মূল্যে ৩৮০ লক্ষ কোটি টাকা) করে ফেলব। ফলে প্রতিবার ওই ত্রৈমাসিক ফলাফল ঘোষণার সময়ে আমরা অর্থনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী হলাম তার গুণকীর্তন করা হয়। এবারও হয়েছে।
গতবছরে সারা বিশ্বের সর্বনিকৃষ্ট ভয়ঙ্কর লকডাউনের চারমাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই আমাদের বিচক্ষণ সর্বজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী বলতে শুরু করেন, দেশের অর্থনীতিতে নব অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে ও দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সেই যে অর্থনীতি ঘুরতে শুরু করেছে, তা ঘুরেই চলেছে। লক্ষণীয় সেই বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে তার আগের বছরের অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় জিডিপি ৭.৪ শতাংশ কমেছিল। মনে রাখা দরকার প্রধানমন্ত্রী ঘুরে দাঁড়ানোর কথাটি বলেছিলেন, ২০২০’র জুলাইয়ের গোড়ার দিকে। ২০২০’র জুলাই–সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে ২০১১-১২ সালের স্থিরমূল্যে জিডিপি ছিল ৩২.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা যা পূর্ববর্তী বছরের অনুরূপ সময়ের জিডিপি ৩৫.৬২ লক্ষ কোটি টাকার তুলনায় ২.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা কম। সেই যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর স্তোকবাক্য শুরু হয়েছে তা আর থামছেনা। এবছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপি ২০২০’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপির তুলনায় ২০.১ শতাংশ বেড়েছিল বলে কী বিপুল উচ্ছাস শুরু হয়েছিল টুইটারে ফেসবুকে ও হোয়াটসএ্যাপে। মোদী-সিতারামন-গোয়েল-মালব্য-শাহ-জাভরেকার-ঠাকুররা কেউ বলেননি যে পুরো বৃদ্ধিটাই অত্যন্ত নিম্ন ভিত্তির উপরে হিসেব করার ফল। কারণ ২০২০’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপি ২০১৯’র অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২৪.৪ শতাংশ কমেছিল। তাই ২০২১’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপির বৃদ্ধির হার ২০.১ শতাংশ হওয়া সত্বেও ওই জিডিপি’র পরিমাণ (৩২.৩৮ লক্ষ কোটি টাকা) তার দু’বছর আগের অনুরূপ সময়কালের জিডিপি (৩৫.৬৭ লক্ষ কোটি টাকা)-র নিরিখে ৩.২৯ লক্ষ কোটি টাকা কম ছিল।
ঠিক একই চালাকি আবার করা হচ্ছে। ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকের জিডিপি’র নিম্ন ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে এবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকের জিডিপি’র বৃদ্ধি ঘটেছে ৮.৪ শতাংশ। কিন্তু যদি ওই জিডিপি’র পরিমাণ (৩৫.৭৩ লক্ষ কোটি টাকা)-কে ২০১৯ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকের জিডিপি’র পরিমাণের (৩৫.৬২ লক্ষ কোটি টাকা) সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়াবে ০.১১ লক্ষ কোটি টাকা বা ০.০৩ শতাংশ মাত্র। যদি ২০১৯-২০ সালের প্রথম দুটি ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২০২১-২২ সালের প্রথম দুটি ত্রৈমাসিকের জিডিপি’কে দেখা হয়, তাহলে দু’বছর আগের ৬ মাসের জিডিপি ৭১.২৮ লক্ষ কোটি টাকার তুলনায় এবছরের প্রথম দু’মাসের জিডিপি কমেছে ৩.১৭ লক্ষ কোটি টাকা।
অন্যদিকে গত বারোমাসে চলতি মূল্যে বা বাজারমূল্যে জিডিপি’র পরিমাণ মোটামুটিভাবে ২২০ লক্ষ কোটি টাকা (২.৯ ট্রিলিয়ন ডলার) দাঁড়িয়েছে। ফলে ওই পরিমাণকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে গেলে দেশের জিডিপি’র বৃদ্ধির হার আগামী আড়াই বছর বার্ষিক ১৮ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অনন্ত গঙ্গায় ডুব দিলেও সেটি হওয়ার নয়। তবু দেশবাসীকে অসচেতন রাখার কাজটি প্রধানমন্ত্রী করে যাবেন। দেশ কতটা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে এব্যাপারে একটা মোহ তৈরি না করতে পারলে, ক্ষুধাসূচক-লিঙ্গবৈষম্যসূচক-অসাম্য-বন্টন বৈষম্য- দারিদ্র-বেকারি — এই সমস্ত বাস্তব বিষয় থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে রাখা যাবে কী করে? সেটা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর প্রচার সহায়করা ভালোই বোঝেন। তা নাহলে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারেই যখন অন্তত ৫৭ লক্ষ ছোট-মাঝারি সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে করোনা কালের একবছরে, যখন দেশজুড়ে পাইকারি মূল্য সূচক হু হু করে বাড়ছে বার্ষিক ১৪.২ শতাংশ হারে, যখন বেকারির হার ১০ শতাংশ ছাড়াচ্ছে তখন বারংবার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বা হাজার হাজার কোটি টাকার স্ট্যাচু তৈরি, মন্দির বানানো বা গঙ্গা থেকে মন্দির পর্যন্ত পথ বানাতে হাজারো কোটি টাকা খরচার ঢাক বাজানো সত্যিই অসহ্য।
মন্দির ও প্রাসাদ বানাতে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে তখনই ছোট মাঝারি শিল্পের নাভিশ্বাস উঠছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ীই কোভিডের সময়ে লকডাউনের পরে ৯ শতাংশ ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এনসিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করেছেন ৯,০৫২ জন ব্যবসায়ী, ২০২০ সালে সেই সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়ে ১১,৭১৬-তে পৌঁছেছে। ধরাই যেতে পারে আত্মহত্যাকারী ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই ছোট ব্যবসায়ী, কারণ নামী ব্যবসায়ী (যেমন ‘কাফে-কফি-ডে’র মালিক ভিজি সিদ্ধার্থ) আত্মহত্যা করলে তা খবরের পাতায় চর্চিত হতে থাকে, ছোট ব্যবসায়ীরা আত্মহত্যা করলে কোনো খবর হয় না। তাঁরা কেবল একটি সংখ্যা। ধনী বনাম গরিবের দ্বন্দ্বটিকে মন্দির-মসজিদের বাচনে রূপান্তর করতে পারলে আরএসএস-বিজেপি’রও সুবিধে, আবার অর্বুদপতি শিল্পপতিদেরও দিলখুশ। কেউ আর অসাম্য নিয়ে প্রশ্ন করবেনা, সবই তো তেনার ইচ্ছে। এদিকে ভারত এক চরম অসাম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ল্যাবের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ভারতে ১ শতাংশ ধনীর কাছে ৩৩ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। অন্যদিকে নিচের ৫০ শতাংশের কাছে রয়েছে ৬ শতাংশেরও কম সম্পদ। একদিকে ১ শতাংশ ধনী আয় করে ২২ শতাংশের মতো, অন্যদিকে নীচের ৫০ শতাংশ গরিবের মোট আয় সামগ্রিকের মাত্র ১৩ শতাংশ। দেশের সরকার রামমন্দির তৈরির জন্য যত উৎসাহ দেখায় তাঁর ছিটেফোটাও অসাম্যের তথ্য পরিসংখ্যান সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করাতে দেখান না। ওই রিপোর্ট অনুসারে ভারতের অসাম্য সংক্রান্ত তথ্য সঙ্কলন ও প্রকাশন গত তিনবছরে এতটাই খারাপ হয়েছে যে তার ভিত্তিতে অসাম্যের পরিমাপ প্রায় অচল।
মোদী সরকার যখন দাবি করছে দেশ ‘আত্মনির্ভর’ হচ্ছে তখন জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। গত নভেম্বরে শেষ হওয়া বারোমাসে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার ৪.৯ শতাংশ। কিন্তু ওই বৃদ্ধি যেহেতু গতবছর নভেম্বরে শেষ হওয়া বারোমাসে ছিল ৬.৯ শতাংশ তাই খুচরো বাজারে গত দু’বছরের গড় বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। ফলে গত ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে যে জিনিসের দাম ছিল ১০ টাকা তা এখন বেড়ে ১১ টাকা ২২ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। সারাদেশে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি একই রকম নয়। দেখা যাচ্ছে যে, বিজেপি শাসিত অধিকাংশ রাজ্যেই ওই বৃদ্ধি জাতীয় গড়ের থেকে বেশি। যেমন হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড। অবশ্য গুজরাটে ওই হার গড় হারের থেকে কম। নভেম্বরে শেষ হওয়া ১২ মাসে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১৪ শতাংশের বেশি, অক্টোবরে সেটি ছিল ১২ শতাংশের বেশি। সাধারণত পাইকারি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটি সম্পর্ক আছে। পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার খানিক পরে খুচরো মূল্যে তার ছাপ পড়ে। ফলে পাইকারি বাজারে এই ১২-১৪ শতাংশ বৃদ্ধি, খুচরো মূল্যের উপর চাপ ফেলবে বলেই মনে হয়। তাছাড়া, এখনকার সরকারি পরিসংখ্যান এতটাই অস্বচ্ছ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে কমিয়ে দেখানো হতেই পারে কারণ ওই পরিসংখ্যানের উপরে দাঁড়িয়ে সরকারি মজুরির হার, মহার্ঘভাতা এগুলি তৈরি হয়। তবে বাজার যে অগ্নিমূল্য তা দেশের মানুষ বুঝতেই পারছে।
সব মিলিয়ে ক্ষুধা, লিঙ্গবৈষম্য, অসাম্য, বন্টনবৈষম্য, দারিদ্র, বেকারি বিবিধ সমস্যাসঙ্কুল এক দেশ তৈরি করতে মোদী সরকার জোর কদমে এগিয়ে চলেছে জিডিপি বৃদ্ধির কল্পকথার গল্প ফেঁদে।
- অমিত দাশগুপ্ত