এক বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কাজ আছে, তবু চেয়েও শ্রমিক অমিল চটকলে’ শীর্ষক সংবাদের সূত্রে কয়েকটি কথা। বেকার যুবকদের চটকলে কাজের অনীহার অন্যতম কারণ কী? এমনকি কর্মীর অভাবে এবছর মিলগুলো বস্তার যোগানও ঠিক সময়মতো দিতে পারেনি। ফলে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রক গম প্যাকেজিংয়ে চটের বস্তার বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চটের বস্তার চাহিদা ও যোগানের মধ্যে এতো পার্থক্য কেন? মিল কর্তৃপক্ষ বেশি মুনাফার লোভে, শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার সুযোগগুলো আত্মসাৎ করছে। প্রতিটি মিলে নথিভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমেছে। ‘ভাউচার’ প্রথায় কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। ‘ভাউচার শ্রমিকদের’ মিলে কোনও আইনি অস্তিত্ব নেই, বেওয়ারিশ শ্রমিক হিসাবেই তারা থেকে যান। মিল কর্তৃপক্ষ যখন তখন এই সব শ্রমিকদের ‘গেট বাহার’ করে দেয়। ‘হায়ার এন্ড ফায়ার’ নীতি চটকলে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে মিলগুলো আধুনিকীকরণের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রথমে তাঁত বিভাগে এস-৪ ও ভিক্টর লুম দিয়ে শুরু হয়, এখন চেইন বিমিং, ওয়ার্প ওয়াইন্ডিং, স্পিনিং এবং ফিনিশার কার্ডরোল ফিডিং পর্যন্ত নতুন মেশিনে কাজ হচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রতিটি বিভাগেই নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হবে। অর্থাৎ কম সংখ্যক মজুর দিয়ে অধিক উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এদিকে ম্যান-মেশিন রেশিও পুরনোই থাকছে। এর ফল হল কম শ্রমিক, উৎপাদন বেশি ও মজুরি কম।
চটকল মালিকদের অজুহাতের শেষ নেই। কিছুদিন আগে তারা বলতে থাকলো, বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে কম দামে চোরাপথে বস্তা ঢুকছে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সীমন্তে উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করুক। এর কিছুদিন বাদেই হঠাৎ করে ১০-১২টি মিল বন্ধ হয়ে গেল। ‘যুক্তি’ — পাটের অভাব। কেন্দ্রের বস্ত্রমন্ত্রক রাজ্য সরকারের শ্রমদপ্তর যৌথভাবে অনুসন্ধান করে জানতে পারে বেশকিছু মিল মালিক পাট মজুত করেছে। এই প্রসঙ্গে ইউনিয়নগুলো রাজ্য শ্রমদপ্তরকে মুখোমুখি মিটিংয়ে বসার আবেদন করতে থাকে। রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসে। জুন ও অক্টোবর মাসে দুটি মিটিং হয়। এখানে ইউনিয়ন, আইজেএম এবং সরকারের বক্তব্য তুলে ধরা হল।
ত্রিপাক্ষিক মিটিংয়ে ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা বলেন, “কাঁচা পাটের সংকটের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী একদল অসাধু ব্যবসায়ীর অবৈধ মজুতদারী। তারা পরামর্শ দিয়েছে সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারের পাট কমিশনার মজুত বিরোধী অভিযান করুক। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কাঁচা পাট আমদানির সম্ভাব্য উপায় বার করুক।” ইজমার চেয়ারম্যান বলেন “কাঁচা পাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং জুট কমিশনারের ৩০ সেপ্টেম্বরের নির্দেশিকায় কাঁচা পাটের ঘাটতি মেটাতে এবং পাটের বিধিবদ্ধ যে মূল্য নির্ধারণ করেছে সেই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আশঙ্কা করেন, অদূর ভবিষ্যতে কাঁচা পাটের ঘাটতির কারণে বেশ কয়েকটি পাটকলের কাজ স্থগিত হওয়ার পথে।”
শ্রম দপ্তরের স্বাধীন প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না মিটিংয়ে উপস্থিত সবাইকে অবহিত করেন, “পাট কমিশনার এবং ইন্ডিয়ান জুট মিল অ্যাসোসিয়েশন ও জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’এর প্রতিনিধিদের সাথে ২৮ মে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে জুট কমিশনার তার আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাঁচা পাট সংক্রান্ত বিষয় ১০ জুনের মধ্যে ব্যবসায়ীদের জানাবে, মিলগুলির কাজ চালিয়ে যেতে হবে। নতুন পাট বাজারে না আসা পর্যন্ত মজুত পাট দিয়ে মিলে উৎপাদন চালু রাখতে হবে। রাজ্য সরকার যখনই প্রয়োজন হবে তখন জুট কমিশনারের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করবে।”
মন্ত্রী আরও জানান, “এই মরসুমে পাটের সন্তোষজনক উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও চটের বস্তা চাহিদা অনুযায়ী সরবারহ করতে না পারলে, প্যাকেজিং আইনের উদ্দেশ্য বিফল হবে। অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যশস্যে প্যাকেজিংয়ে সিন্থেটিক ব্যবহার হবে”। তিনি আরও বলেন যে “পাট শিল্পে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে বিশেষ করে স্পিনিং এবং তাঁত বিভাগে দক্ষ শ্রমিকের অভাব, মজুরি কাঠামো না থাকা, স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা ইত্যাদি। তিনি মিটিংয়ে উপস্থিত সবাইকে অবহিত করে বলেন, কাঁচাপাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং খাদ্যশস্য প্যাকেজিংয়ে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে সিন্থেটিক ব্যাগ ব্যবহারের বিষয়টি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে তিনি এনেছেন। মজুরি সংশোধন, শ্রমিকদের বিভাগীয় করা, ‘গ্রেড-অ্যান্ড-স্কেল’ চালু করা, উন্নত জীবনযাত্রার লক্ষ্যে বাসস্থান প্রদান এবং স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলি সরকারের প্রাথমিকতায় আছে।”
এখন কেন্দ্রীয় সরকার পাটের দড় কুইন্টাল প্রতি ৬,৫০০ টাকা করেছে, মিল মালিকদের বক্তব্য বাজারে ৭,৫০০ টাকা দড়ে পাট বিক্রি হচ্ছে, এতো দামে পাট কিনে মিল চালানো সম্ভব না। এদিকে শ্রমিকদের মজুরির কোনও স্থিরতা নেই। শ্রমিকদের বর্তমান মজুরিকাঠামো মোটামুটি এই রকম। ২০০২ সালে যে শ্রমিকরা নিযুক্ত হয়েছেন তারা ২০ বছর কাজ করে হাতে পান দৈনিক মাত্র ৪৩৭ টাকা। ২০১৯ সালে যারা ভর্তি হয়েছেন তারা দৈনিক পাচ্ছেন ৩৮১ টাকা মাত্র। প্রতিটি শ্রমিককে মজুরির উপর ৪২ শতাংশ টাকা সামাজিক সুরক্ষা বাবদ মিল মালিকের দেওয়ার কথা। কিন্তু মিল মালিকরা এই টাকার বড় অংশই আত্মসাৎ করছে। দুর্ভাগ্যবশত চটশিল্পই একমাত্র শিল্প, যেখানে সাত-আট রকমের মজুরি চালু আছে। রাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল — চটশিল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করবে এবং শ্রমিকদের জন্য ‘গ্রেড-অ্যান্ড-স্কেল’ চালু করবে। সেসব অথৈ জলে। চটকলে মানা হয় না কোনও শ্রম আইন। এই শিল্পের বাজার নিশ্চিত, উৎপাদিত মালের পুরোটাই কেন্দ্রীয় সরকার কিনে নেয়। কিন্তু মালিকরা বস্তার চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না, কেন? অপদার্থ রাজ্য সরকার সব জেনেশুনেও অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। নাকের ডগায় বেআইনি কাজ চালাচ্ছে ফড়ে-ফাটকাবাজ মালিকরা। এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস প্রশাসন বা শ্রমদপ্তরের নেই।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ৫৬টি জুটমিল আছে। এই মিলগুলোতে নথিভুক্ত শ্রমিক সংখ্যা ১৫-২০ শতাংশ মতো হবে। নথিভুক্ত শ্রমিকরা মূল (বেসিক) ও ডিএ’র উপর ৪২ শতাংশ অন্যান্য বিধিবদ্ধ সুবিধাগুলো (ফ্রীঞ্জ বেনিফিট) পাওয়ার কথা। যেমন রাতের কাজের ভাতা ১.৬ শতাংশ, ছুটির ভাতা ৩.৩ শতাংশ, বিধিবদ্ধ ছুটি ৫ শতাংশ, ঘরভাড়া ৫ শতাংশ, পিএফ ১০ শতাংশ, ডিএলআই ০.৬৯ শতাংশ, ইএসআই ৩.২৫ শতাংশ, গ্রাচ্যুইটি ৪.৮ শতাংশ, বোনাস ৮.৩ শতাংশ। নথিভুক্ত শ্রমিকরা এই টাকাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। ইএসআই’এর টাকা ঠিক সময়মতো জমা না পড়ার জন্যে শ্রমিকরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হছেন। পিএফ তহবিলে সময়মত টাকা জমা পড়ছে না। এই টাকা ঠিক সময়ে জমা হলে শ্রমিকরা পেতে পারতেন নিশ্চিত সুদ — অবসর নেওয়ার পর পেতেন পেনশন যা তাদের বিরাট সহায় হোত। কর্মীদের কোম্পানির খাতায় নাম, নাম্বার থাকলে পিএফ-ইএসআই’এর পাশাপাশি অন্যান্য আইনি সুযোগগুলোও পেতে পারতেন। মালিকরা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে শুধু মুনাফাই লুটছে। এখন একজন রাজমিস্ত্রী যখন দৈনিক ন্যূনতম মজুরি পান ৬০০ টাকা, তখন চটকলে এতো কম মজুরিতে কেন বেকাররা জুটমিলে ঢুকবে? মিল মালিকরা যদি সত্যিই মিল চালাতে ও নতুন শ্রমিক নিয়োগ করতে চান তাহলে শিল্প আইন মোতাবেক মিল চালাতে হবে। শ্রমনিবিড় সংগঠিত শিল্প হিসাবে কর্মসংস্থানের এতোবড় ক্ষেত্রটি মালিকদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লালসা, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ঔদাসিন্য ও মালিকদের বেআইনি কাজের পরিণামে চটশিল্প আজ চরম অবহেলিত। সরকারি বিজ্ঞাপন অনুযায়ী এই শিল্পে ১,০০,০০০ কর্ম সংস্থানের সুযোগ আছে। এখনই যদি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ব্যবস্থা না নেয় তাহলে কর্মীর অভাবেই একদিন বাংলার চটশিল্প উঠে যাবে।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত