স্বাধীনতার ৭৫ উদযাপন বর্ষে বিজেপি-আরএসএস পড়েছে মহা বিপাকে। এই পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বুক ফুলিয়ে এটা বলা যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন-পূর্ব বহিরাগত মুসলিম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তথাকথিত হিন্দু ভারতের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রামই ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রাম, এবং তাকে পুনরুজ্জীবিত করার মধ্যেই সাধের সঙ্ঘবাদী হিন্দুত্বের ‘আজাদী’র চাবিকাঠি রয়েছে; এই উন্মাদনা সৃষ্টি করে একদিকে যেমন ওরা পরিবেশ-পরিস্থিতিকে বিষিয়ে দেওয়া থেকে বিরত হচ্ছেনা, তেমনই অন্যদিকে তাদের বিকৃত অনৈতিহাসিক আজগুবি তত্ত্বায়নে দেশবাসীকে বশীভূত করাও সহজ হচ্ছে না। বিজেপি-আরএসএস আর তাদের স্যাঙাত বাহিনী সব বিদ্ধ হচ্ছে বিদ্বেষ-বিভাজন-ঘৃণার মতাদর্শ-রাজনীতি-সংস্কৃতির সওদাগর হিসেবে। ভারতের জনগণের মনে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বলতে গেঁথে আছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা মুক্তির সংগ্রাম। যে স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলিম জনগণ একসাথে অগনিত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, অসীম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছিল। রাজনৈতিক হিসেবে অবদান ছিল কংগ্রেসী জাতিয়তাবাদী, সমাজবাদী ও সাম্যবাদী ধারার। পক্ষান্তরে, হিন্দুত্ববাদীদের গৈরিক ধারার কোনও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল না, তারা কেবল লিপ্ত ছিল বিশ্বাসঘাতকতা-আত্মসমর্পণ-অনুচরবৃত্তিতে। শত চেষ্টা করেও এই সামগ্রিক সত্য কিছুতেই ভোলানো সম্ভব নয় বুঝে আজ মোদীজীরা এরমধ্যে ঢুকে পড়ে উঠে পড়ে লেগেছেন সাধু সাজতে। ক্ষমতা ধরে রাখার খাস স্বার্থে এছাড়া গত্যন্তর দেখছেন না। সেই মনোভাব থেকেই নামানো হয়েছে ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ কর্মসূচি। এতে বাহানা বানানো হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের উপেক্ষিত জননায়কদের মর্যাদার আসনে বসানোর। এই ধূয়ো তুলে বিজেপি চায় জাতীয় কংগ্রেস সহ সমস্ত আঞ্চলিক শাসক শক্তিকে নস্যাৎ করে দিতে। তারজন্য মূল নিশানা বানানো হচ্ছে কংগ্রেসকে, আর প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রদর্শনী কর্মসূচিতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঠানো সুভাষ চন্দ্র বসু’র মূর্তির ট্যাবলো, কেরল ও তামিলনাড়ুর ট্যাবলো ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’র নামে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। আরও হয়ত কত বিক্রম প্রদর্শন অপেক্ষা করছে! মোদী অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যদের ভূমিকাকে গৌণ, ম্লান বা অনুচ্চারিত করে রেখেছে, আর কৃতিত্বের সমস্ত আলো টেনেছে কেবল নেহরু ও গান্ধী পরিবার। একথা বিজেপি বলছে বলে নয়, কংগ্রেস কালচারের মধ্যে উপরোক্ত অভিযোগের সত্যতা রয়েছে বিগত সাতদশক যাবত। একে বিজেপি আজ পুঁজি করছে নিজেকে ‘স্বমহিমায়’ প্রতিস্থাপিত করতে। সেই উদ্দেশ্যে বিশেষত নেহরুর বিপরীতে সুভাষ চন্দ্র তথা গান্ধী-সুভাষ চন্দ্রের উত্তরসাধক সাজতে মরীয়া। কিন্তু গান্ধীর হত্যাকারী গডসে বিজেপি-আরএসএস ধারার কাছে বিশ্বাসঘাতক সাভারকারের মতোই ‘মহান’। গডসে’কে ‘গৌরবের’ দাবি করে কখনও গান্ধীর জন্ম-মৃত্যুদিবস পালনের নৈতিক অধিকার থাকতে পারে না। আর, আদর্শগতভাবে সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারার ঘোর বিরোধী। তাই তাঁর মূর্তি বানিয়ে ভাবমূর্তির উত্তরসূরী দাবি করার বিজেপি’র বজ্জাতি বরদাস্ত করা উচিত নয়।
পশ্চিমবাংলার গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি উন্মত্ত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের হাওয়া তুলে টেক্কা দিতে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। তবু ব্যর্থতাকে স্বীকার না করতে ফের হিন্দুত্বের জিগির তুলতে চায়, বলে — সংখ্যালঘুদের এককাট্টা ‘ভেটো’ ভোটে হারিয়ে দিয়েছে। সামনে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, বিজেপি রয়েছে বেশ রাজনৈতিক সংকটে। পরিত্রাণ পেতে চালাচ্ছে চরম সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচার। হরিদ্বারের হিন্দু ধর্মসংসদ থেকে হুঙ্কার দেওয়া হয়েছে মুসলিম গণহত্যা চালানোর, খোদ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও হুমকি দিয়েছেন এবারের উত্তরপ্রদেশের ভোট হবে ৮০ শতাংশ (সংখ্যাগুরু) বনাম ২০ শতাংশের (সংখ্যালঘু) মধ্যে। প্রবল ধিক্কারের চাপে কপটতার কৌশল নিয়ে ধর্মসংসদের অপরাধী ক’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বটে, কিন্তু যোগীর ভরসা মোদী। এরপরেও তারা সাজতে চায় ‘সুভাষপ্রেমী’! কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইতিহাসে উপেক্ষিতদের ভূষিত আর করা হল কোথায়? বরং মুসলিম নামাঙ্কিত স্থানগুলোর নাম পাল্টে হিন্দুত্বের নেতাদের নামাঙ্কিত করা হয়ে আসছে। এমনকি কলকাতায় গঙ্গাতীরের ‘নেতাজী’ নামাঙ্কিত বন্দরের জোরজবরদস্তি নয়া নামকরণ করা হয়েছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নামে! এরপরেও চলছে ‘সুভাষ-বিগলিত ভাব’ প্রদর্শনের ভন্ডামী! সুভাষ চন্দ্রের দেশ চালনার মূল ভাবনায় অন্যতম বিষয় ছিল — প্ল্যানিং কমিশন। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে পরিকল্পনা বিষয়ক যোজনা কমিশন তুলে দিয়েছে। চর্চার প্রশ্নে বহু ত্রুটিপূর্ণ অতীত থাকলেও যার বুনিয়াদী ধারণায় ছিল কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে মতামতের আদানপ্রদানের ভিত্তিতে সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বরাদ্দ বণ্টন। মোদী সরকার তা অবলুপ্ত করে বানিয়েছে কেন্দ্রের স্বেচ্ছাচারিতার ‘নিতি আয়োগ’।
স্বাধীনতার ৭৫ উদযাপনের সময়ে মোদী জমানা সুভাষচন্দ্রের জাতিয়তাবাদী ভাবনার পুনরুল্লেখ করছে সম্পূর্ণ বিপরীত উদ্দেশ্যে। তাকে এমন এক কঠোর রাষ্ট্রবাদী কাঠামোয় দেশকে শেকল পরানোর সপক্ষে যুক্তি জাহির করছে — যেখানে শাসন ও শাসকের প্রতি নাগরিকের সংগঠিত-অসংগঠিত যে-কোনও প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জকে ‘শান্তি-সুস্থিতি-বিকাশ বিরোধী’, এমনকি প্রয়োজনে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী-দেশদ্রোহী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। আর, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অন্তরাত্মা সংবিধানকে লোকদেখানো ললাট স্পর্শ করে কার্যত লোপাট করে দেওয়া হয়।
প্রকৃত আধুনিক ও প্রগতির জাতিয়তা ও সাংবিধানিক বোধ আদৌ শাসন ক্ষমতার অতি কেন্দ্রীকরণ ও কঠোর রাষ্ট্রবাদের ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না। বরং সেই ধারণা এক গৌরবময় মালার মতো, যাতে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে থাকা উচিত একগুচ্ছ আবশ্যিক উপাদান — জনগণের গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমালোচনা ও বিরোধিতার অধিকার, দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, বহুত্বের মর্যাদা, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতিভেদ ও বর্ণপ্রথার অবসানমুখী সামাজিক সংস্কার, পিতৃতন্ত্রের অর্গল থেকে মুক্তির নারী-পুরুষের সম মর্যাদা সমানাধিকার, ছোট-বড় সমস্ত ভাষাভাষি জাতিসত্ত্বাগুলির এবং জাতীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বর্গের সম্প্রীতি ও স্বেচ্ছাসম্মিলনের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য, প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক এবং সার্বভৌমত্বের স্বাধীনতা। এর সবকিছুরই বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে বিজেপি’র রাজনৈতিক ধারণা ও রাষ্ট্রবাদ।