জাতিবিদ্বেষী অবমাননার বিরুদ্ধে সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা পাপিয়া মান্ডির সুবিচার পাওয়ার লড়াই আরও একধাপ এগলো। গত ২৪ জানুয়ারি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে অভিযুক্ত অধ্যাপক নির্মল বেরাকে। বিগত চারমাস লাগাতার সংগ্রাম এগিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে পাপিয়া প্রথম কলেজ কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা করেছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়ে পাপিয়ার পাশে দাঁড়ান। মেরুনা নিজেও জাতিবিদ্বেষী অবমাননার শিকার হয়েছেন এবং সুবিচার পেতে দীর্ঘ একরোখা আইনি লড়াই লড়ছেন। মেরুনা পাপিয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। অনেকগুলি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ই-মেল করা হয়। অভিযোগ দায়ের করায় পাপিয়ার ওপর যাতে নতুন করে প্রতিহিংসামূলক হয়রানি না নেমে আসে তা নিশ্চিত করার আবেদনই জানানো হয়েছিল শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। বলা বাহুল্য মন্ত্রী মহাশয় চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে একটা উত্তর দেওয়ার দায়বদ্ধতাটুকুও দেখাননি। এবং আমাদের আশঙ্কা বাস্তব করে সবং কলেজের অধ্যক্ষ তপন দত্ত মহাশয় পাপিয়া মান্ডির প্রতিবাদ দমন করতে নতুনভাবে হয়রানি ও অপমান শুরু করেন। কিন্তু পাপিয়া দমে না গিয়ে ১৯ অক্টোবর সবং থানায় এফআইআর দায়ের করেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল। সবং ব্লকের পারগানা মহলের লড়াকু নেতা মিঠুন মুর্মুর নেতৃত্বে প্রথম বিক্ষোভ সংগঠিত হয় এবং পুলিশ ‘এসসি-এসটি (প্রিভেনশন অব এট্রসিটিস) অ্যাক্ট’ বা ‘পোয়া’ আইনের কয়েকটি ধারা-উপধারায় অধ্যাপক নির্মল বেরা ও অধ্যক্ষ তপন দত্তর বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করে। নির্মল বেরা ও অধ্যক্ষ তপন দত্তকে গ্রেপ্তার করার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চলে। আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা, ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল, দিশম আদিবাসী গাঁওতা, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, সাঁওতালি সাহিত্য একাডেমি মেদিনীপুর, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি সহ বিভিন্ন সংগঠন ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়েছে। ‘প্রতিবাদী ঐক্য মঞ্চ’ গড়ে ৬ ডিসেম্বর জেলাশাসককে স্মারকলিপি প্রদান, ২১ ডিসেম্বর ভাজামাপামের ডাকে কলেজ ঘেরাও ও যাদবপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভসভা, ৯ জানুয়ারি মেদিনীপুর শহরে গণকনভেনশন, ১৭ জানুয়ারি সাতটা জেলায় ডেপুটেশন ও প্রতিবাদসভা ইত্যাদি সংগঠিত করার পর আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানির দিন মেদিনীপুর আদালতের সামনে মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাকও আছে। এসবের পর একজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হল। আদালতে তোলার পর ধৃত নির্মল বেরাকে একদিনের জন্য জেল হেফাজতের নির্দেশ দেয় আদালত।
এখন প্রশ্ন উঠেছে আরেক অভিযুক্ত, অধ্যক্ষ নির্মল বেরাকে কেন গ্রেপ্তার করা হল না? রাজ্যের শাসক দলের পক্ষ থেকে অপরাধিদের আড়াল করার অপচেষ্টা দেখা গেছে। সবঙের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্রীযুক্ত মানস রঞ্জন ভুঁইয়া কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি। তিনি জাতিবিদ্বেষী অপরাধের দোসর হিসেবে অবতীর্ণ হন। সংবাদ মাধ্যমের সামনে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে তিনি বলেন যে, কোনও অসম্মানের ঘটনা ঘটেইনি। নির্মল বেরাকে গ্রেপ্তারের পর প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে একজন পুলিশ আধিকারিক বলেছেন যে, অধ্যক্ষর অপরাধের ক্ষেত্রে নাকি ‘পোয়া’ আইন প্রযোজ্য নয়। অথচ এফআইআর’এ পাপিয়া তাঁর প্রতি অধ্যক্ষের করা জাতিবিদ্বেষী অন্যায়গুলি সুস্পষ্ট ভাষাতেই উল্লেখ করেছেন। মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে বৈষম্য, কলেজের অনুষ্ঠানমঞ্চে প্রকাশ্যে পাপিয়াকে খাটো করা, প্রাপ্য এরিয়ারের ক্ষেত্রে বৈষম্য ইত্যাদি তো ছিলই, অভিযোগ জমা করার পর পাপিয়াকে কলেজে জয়েন করতে বাধা প্রদান এবং পাপিয়াকে পাগল প্রতিপন্ন করার চেষ্টাও চালিয়েছেন অধ্যক্ষ এবং এই সমস্ত কিছুর প্রত্যক্ষ প্রমাণও আছে। এসব সত্ত্বেও অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার না করায় একথা স্পষ্ট হয়েছে যে পুলিশের ওপর মন্ত্রী মহোদয়ের চাপ কাজ করছে। ইতিমধ্যে, অধ্যক্ষের আসনে বসে থেকে, তদন্তকে প্রভাবিত করতে তপন দত্ত মহোদয় সাক্ষি ছাত্রছাত্রীদের ভীতি প্রদর্শন ও নানারূপ ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন পাপিয়ার পরিবার। ফলত অবিলম্বে অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। এবং আদালতে শেষ পর্যন্ত পাপিয়া যাতে সুবিচার পান তা নিশ্চিত করতে আন্দোলন জারি রাখা দরকার। একেতো কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পোয়া আইনকে ইতিমধ্যেই অনেকটা দুর্বল করে দিয়েছে, তাছাড়া এরাজ্যে পোয়া আইনের প্রয়োগের রেকর্ড খুব আশঙ্কাজনক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পোয়া আইনের ধারায় এফআইআর নিতে চায়না পুলিশ, নিলেও সময় মতো চার্জশিট দেওয়া হয় না এবং চার্জশিট জমা পড়ার পর বিচারের নামে দীর্ঘদিন প্রহসন চলে, ধীরে ধীরে মামলাগুলি অকেজো করে দেওয়া হয়। এই বিষয়ে এই মাসেই রাজ্য হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আদিবাসী আন্দোলনের একজন কর্মী শ্রী দেবেন্দ্রনাথ হাঁসদা মহাশয়। জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সুবিচার পাওয়ার লড়াই তাই লাগাতার চলবে। আগামি ৪ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানীর দিনে তাই মেদিনীপুর আদালতের সামনে মৌন প্রতিবাদ প্রদর্শনের জন্য সকল সংগঠনকে আহ্বান জানিয়েছে প্রতিবাদী ঐক্য মঞ্চের নেতা মনু হাঁসদা ও লবান হাঁসদা।
- মলয় তেওয়ারি