সাধারণতন্ত্র দিবসের দিনকয়েক আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক নীতি নৈতিকতার বিরুদ্ধে মোক্ষম এক আঘাত হানলেন। আপাদমস্তক এক অরাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ব্রহ্মকুমারী সংগঠনের অনুষ্ঠানে আদ্যন্ত রাজনৈতিক বক্তব্য হাজির করে নির্লজ্জভাবে বেআব্রু ঘটালেন নিজের ফ্যাসিবাদী মনোভঙ্গি। তিনি বললেন, “এটা স্বীকার করতে হবে, নিজেদের কর্তব্যকে উপেক্ষা করাটা জাতীয় জীবনে এক বদরোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৭৫ বছর ধরে আমরা সারাক্ষণ অধিকার নিয়ে চেঁচামেচি করেছি, অধিকারের দাবিতে লড়েছি আর এভাবেই সময় নষ্ট করেছি। অধিকারের উপর প্রধান নজর রাখতে গিয়ে নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য ভুলতে বসেছি, আর এজন্যই, স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পর আমাদের দেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।” এই বদরোগের দাওয়াই মোদী কী দিয়েছেন? তাঁর মতে, “পরবর্তী ২৫ বছরে কঠোর শ্রম, আত্মত্যাগ ও তপস্যার মাধ্যমে সেই পাপস্খলন করতে হবে”। গণতান্ত্রিক অধিকারকে পেছনে ঠেলে সরানোটাই নাকি এদেশের আধ্যাত্মিক চেতনা!
এক অরাজনৈতিক আধ্যাত্মিক মঞ্চে অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে এই ‘পাঠ’এর নেপথ্যে কি কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে?
১৪ জানুয়ারি, মুম্বাইয়ের একটি সভায় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি (যিনি প্রভাবশালীও বটে) রোহিংটন ফালি নারিমান তীব্রভাবে ক্ষমতাসীন শাসকদের উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে সমালোচনার তির ছুঁড়ে দেন। ভারতীয় সংবিধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৯(১) (এ)-তে বিধৃত মানবাধিকার সংক্রান্ত ধারায় বাক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারের উপর একের পর এক যে হামলা কেন্দ্রীয় সরকার নামিয়ে এনেছে ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্র ছাত্রী বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শিল্পীদের উপর, ঔপনিবেশিক আমলের চরম গণতন্ত্র বিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ফাঁসে নির্বিচারে গ্রেপ্তারিকে তিনি তীব্র সমালোচনা করেছেন। পাশাপাশি, ঘৃণা ভাষণের সাথে যারা যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে পিঠ চাপড়ানোর ঘটনাগুলিকে তিনি নিন্দা করে প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলেছেন। পুত্র হুমায়ুনকে লেখা সম্রাট বাবরের একটি চিঠি উদ্ধৃত করে তিনি সেই আমলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভারতীয় ভাবধারাকে উল্লেখ করেন, যা সরাসরি সংঘ বাহিনীর বিরুদ্ধেই তাক করা। তাঁর এই প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাষণ বিভিন্ন মহলে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখার যে রাষ্ট্রিয় কর্তব্য তিনি তুলে ধরেন, মোদী সরাসরি তাকেই নস্যাৎ করে বুঝিয়ে দিলেন চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। প্রশাসনের সর্বাধিনায়ক হয়ে তিনি বিচার ব্যবস্থাকে একটু সমঝে চলার রূঢ় ইঙ্গিত দিয়ে এটাই বোঝাতে চাইলেন যে বিচারব্যবস্থা তার স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী সরকারের সবচেয়ে দুর্বল শাখা। যত ভালো রায় বিচারসভা দিক না কেন, শেষমেশ তার রূপায়ণের জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় প্রশাসনের উপরই।
মোদী জমানা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে এক বিপরীত ধারণা হাজির করেছে যা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়।
নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত একবার বলেই বসেন, বড্ড বেশি গণতন্ত্র সংস্কারমূলক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে বাধা। আর সবাইকে ছাপিয়ে যান অজিত ডোভাল, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, মোদীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত সহচর। তিনি একবার একটা ভাষণে বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ছে নাগরিক সমাজের নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপের দরুণ।... যুদ্ধের নতুন সীমান্তরেখা, যাকে আপনারা চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ হিসাবে আখ্যা দেন, তা হল নাগরিক সমাজ।” এই কথা বলার পর তিনি নতুন এক তত্ত্ব হাজির করেন, “ব্যালট বাক্সে ভোট দেওয়াটা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নয়। ব্যালট বাক্সের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যে আইন রচনা করেন, সেই আইনই হল গণতন্ত্র।” অর্থাৎ ডোভালের কাছে রাষ্ট্রই হল সবার ঊর্দ্ধে, জনগণ নয়।
মোদী, আরএসএস, এবং এদের শাসনতন্ত্রের কাছে সংবিধান-গণতন্ত্র-নাগরিক সমাজ সম্পর্কেই রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁদের চোখে ভারতে এখনও বজায় রয়েছে ঔপনিবেশিক রাজতন্ত্র — যেখানে জনগণ ‘প্রজা’, স্বাধীন সার্বভৌম্য দেশের ‘নাগরিক’ নন। ভারতের সংবিধানের ‘প্রি-অ্যাম্বেল’ শুরুই হচ্ছে এই বাক্য দিয়ে “আমরা, ভারতের জনগণ...” আর গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এমন এক সমাজ হিসাবে, যেখানে নাগরিকরা হচ্ছেন স্বাধীন সার্বভৌম, আর তারাই রাষ্ট্রকে পরিচালনা করবেন। ‘প্রজা’ ও ‘নাগরিক’ ধারণার মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল ফারাক। এক সর্বশক্তিমান রাজাধিরাজের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে থাকে প্রজারা, যাদের অধিকার থাকেনা, যাদের কর্তব্যই হল রাজাধিরাজ বা তার সরকারের হুকুমকে নীরবে, বিনা প্রতিবাদে মেনে চলা। আর, সংবিধানের মধ্যে দিয়ে পাওয়া সর্বজনীন ভোটাধিকার মারফত নাগরিকেরা নির্বাচিত করেন নিজেদের পছন্দসই সরকার। তাই, গণতান্ত্রিক দেশে, সেই দেশের সংবিধানে নাগরিকরাই থাকেন কেন্দ্রবিন্দুতে — জনগণকে নিয়ে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসন ব্যবস্থায় নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখাটা দেশের শাসকবর্গের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, পবিত্র এক নৈতিক কর্তব্য।
কিন্তু, মোদী জমানা গোটা প্রেক্ষিতটিকেই উল্টে দিল। তাঁর শাসনে গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলাটা দেশকে দুর্বল করার সামিল, মুখ বন্ধ করে প্রজাদের করে যেতে হবে রাজাধিরাজের জন্য আত্মত্যাগ, তাঁর প্রতি দেখাতে হবে কর্তব্যপরায়ণতা। আর, রাজন্যসেবাকেই ঠাওড়ানো হচ্ছে তপস্যা হিসাবে।
মোদী তাঁর ভাষণে দেশবাসীকেও চরম অপমান করলেন। দেশের নাগরিকেরা — মোদীর কথা অনুযায়ী — এতোদিন যেন নিজেদের নাগরিক কর্তব্য পালন করেনি। আগামী ২৫ বছরে এই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত করতে তাই নিজেদের মৌলিক অধিকারে ভুলে এক এবং একমাত্র রাষ্ট্রের জন্য পালন করতে হবে নিজেদের কর্তব্য।
এক চরম শয়তানি চিন্তাভাবনাকে আধ্যাত্মিক মোড়ক দিয়ে দায়িত্ব-কর্তব্যকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে আগামী ২৫ বছর ধরে নিজের ফ্যাসিবাদী প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওকালতি করলেন মোদী।
- অতনু চক্রবর্তী