ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের গণনিধনের এক পরিস্থিতি ক্রমশ সূচিমুখ হয়ে উঠছে। ‘জেনোসাইড ওয়াচ’এর সভাপতি ডঃ গ্রেগরি স্ট্যানটন সম্প্রতি ইউনাইটেড স্টেটস কংগ্রেসের কাছে পেশ করা এক বিবৃতিতে এবিষয়ে সতর্ক করেছেন।
গণহত্যা একটি একক ঘটনা নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া — এই জোরালো অভিমতের জন্যই ডঃ স্ট্যানটন সুবিদিত এবং তিনি এই প্রক্রিয়ার দশটি বিশেষ দিকের কথাও বলেছেন। তিনি সাম্প্রতিকতম এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, এই বিষয়গুলির প্রায় সবকটিই এখন ভারতে দেখা যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, গণহত্যার প্রস্তুতি-পর্যায়ে সংখ্যালঘু জনগণকে অনেক সময়েই বেনাগরিক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করে তাদের বৈষম্যের শিকারে পরিণত করা হয়। ঠিক এটাই হয়েছিল মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্ষেত্রে, আর তারপরই তাদের নির্বিচার হত্যার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। আমরা ভারতবর্ষেও এটাই ঘটতে দেখছি এনআরসি, সিএএ’র মতো আইন এবং ধর্মান্তর বিরোধী আইনগুলো নিয়ে, যেগুলো মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডঃ স্ট্যানটন বলেছেন কীভাবে হরিদ্বার ও অন্যত্র বিদ্বেষ-জমায়েতগুলোর ভাষণে হিংস্র ভাষা ব্যবহার করে মুসলিমদের চূড়ান্ত অবমাননা করা হচ্ছে, শুধু তাই নয়, তাদের হত্যার প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে।
জেনোসাইড ওয়াচ আরও কয়েকটি প্রক্রিয়া চিহ্নিত করেছে যেগুলো ভবিষ্যৎ গণহত্যার ইঙ্গিতবাহী। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে — সশস্ত্র খুনী বাহিনীর সংগঠন; সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুর জন্য বিপজ্জনক এমন মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে গণহত্যার প্রস্তুতি; এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জমি থেকে উৎখাত করে, সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালানো। আমরা এই সমস্ত প্রক্রিয়াগুলোকেই সম্প্রতি ভারতে দেখতে পাচ্ছি। ধর্ম সংসদগুলিতে প্রকাশ্যে এমনকি শিশুদেরও, সশস্ত্র করার ও মুসলিম নিধনে তাদের প্ররোচিত করার প্রস্তুতি চালানো হচ্ছে। বজরঙ দলের মতো হিন্দু আধিপত্যকামী দলগুলো ইতিমধ্যেই অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ শিবির চালু করেছে। হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ছদ্ম আবরণে বিদ্বেষ ছড়ানোর সমাবেশগুলোতে হিংসার ব্যাপারীরা তাদের ভাষণে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ‘আগ্রাসী’ হিসাবে তুলে ধরে। কিন্তু আসল সত্য হল ধারাবাহিকভাবে মুসলিমদের ভীড় হিংসার বলি হতে হচ্ছে, আক্রান্ত হতে হচ্ছে। ডঃ স্ট্যানটন উল্লেখ করেছেন, কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া আর আসামে এনআরসি লাগু করা — গণনিধনের পথের অশুভ ইঙ্গিত বহন করছে। তার সঙ্গে আমরা দেখছি আসামে কীভাবে মুসলিমদের জোর করে জমি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে আর ভাষাগত সংখ্যাগুরুদের ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। এইসব এবং অন্য রাজ্যগুলিতে ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মাণ সেই গণহত্যার পথেরই নিশানা।
উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে বিদ্বেষ ছড়ানোর জমায়েতগুলোর মূলচক্রী যতি নরসিংহানন্দকে হরিদ্বার পুলিশ গ্রেফতার করেছে তার ঘৃণাবর্ষী গণহত্যার প্ররোচনা সৃষ্টিকারী ভাষণের জন্য নয়, বরং শাসকদল বিজেপি’র মহিলা সাংসদদের প্রতি তার আগেকার কুমন্তব্যের জন্য! বিষয়টা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। যতি এবং অন্য যারা অনবরত বিদ্বেষের গরল ঢেলেও বিনা শাস্তিতে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে — তাতে বিন্দুমাত্র বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং তাদের সেইসব ভাষণের জন্য ‘বিখ্যাত’ যেখানে মুসলিমদের প্রতি মানুষ হিসাবে চরম অমর্যাদা প্রকাশ পায় আর তাদের বিরুদ্ধে হিংসাকে উস্কে দেয়!
ভারতের জনগণকেই সময় থাকতে এই সতর্কবার্তায় গুরুত্ব দিতে হবে এবং গণহত্যা প্রতিরোধ করতে কাজ করতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, তাদের মর্যাদা রক্ষা করে এবং বিজেপি’র ছড়ানো ঘৃণা ও হিংসার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান ও ভোটে পরাস্ত করার মাধ্যমেই সেটা করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ জানুয়ারি ২০২২ সংখ্যা)