আজকের দেশব্রতী : ৬ জানুয়ারী ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrait-6-January-2022

corona rise in the state

মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২০-২১ সাল জুড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় করোনা সংক্রমনের ঢেউ এরাজ্যে আছড়ে পড়েছিল। বহু প্রিয়জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তাকে কীভাবে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কাজে লাগানো যায়, তা ছিল সকলের চিন্তায়। অতিমারী ও মহামারী প্রতিরোধে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এই ছিল রাজ্যের সংবেদনশীল মানুষের প্রত্যাশা। অথচ আশ্চর্য হয়ে রাজ্যবাসী দেখলেন, জনস্বাস্থ্যের এত বড় বিপর্যয়ের পরও সবাই আমরা ভুলে গেলাম অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু পথযাত্রী প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা। ভুলে গেলাম, বেড পাওয়ার আশায় অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে মায়ের ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য। ভুলে গেলাম অক্সিজেন সিলিন্ডার জাপটে হাসপাতালের বারান্দায় মৃত্যু পথযাত্রী প্রিয়জনের বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টার কথা।

ঢেউ চলে যেতে না যেতেই সরকারি আধিকারিক ও তাঁদের হাতে গোনা পরামর্শদাতারা অপচয় বন্ধে সেফ হোম বা আইসোলেশন সেন্টারগুলি তুলে দিলেন। করোনা বেডগুলি প্রায় তুলেই দেওয়া হল। অতিরিক্ত কিছু স্বাস্থ্যকর্মী যাদের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়েছিল, তাদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে বিদায় জানানো হল। কেউ ভাবতেই পারেন যে ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য নতুন নতুন ভাইরোলজি ইনস্টিটিউট খোলার জন্য সরকার উদ্যোগী হয়ে পড়ায় ঐসব অপচয় বন্ধ করা হয়েছিল। না, না। এধরনের ভ্রম থাকা ঠিক নয়। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা এরাজ্যের ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কোনো বৈঠক করতেও দেখা যায়নি। বরং আরজিকর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে জীবনদায়ী দামী ওষুধ চুরির গল্প নজরে আসল। কোনো কোনো হাসপাতালে বেড পাইয়ে দেওয়ার জন্য টাকার লেনদেনের কাহিনী শোনা গেল। শাস্তি কি হয়নি? নিশ্চয় হয়েছে। একজন অভিযুক্ত চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছে। যার পরামর্শে এসএসকেএম হাসপাতালে অসুস্থ কুকুরের ডায়ালিসিস হয়, বা জীবনদায়ী ওষুধ কেলেঙ্কারি ঘটে, তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।

যা হওয়ার তাই হল। এখন করোনা (ওমিক্রন সহ) সংক্রমণে আমাদের রাজ্য দ্বিতীয় স্থানে, মহারাষ্ট্রের ঠিক পরেই। লাগামহীন মেলা, খেলা, উৎসব ইত্যাদি প্রভৃতি সবই আমরা করলাম। করোনা হয়ত এরজন্যই অপেক্ষা করছিল। তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কাল বেড়িয়ে পড়ার মুখে। সবার আগে আক্রান্ত হলেন চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা, শয়ে শয়ে।

এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের জনগণের স্বার্থে সমস্ত পরামর্শ, উদ্যোগ, শক্তিকে একত্রিত করা প্রয়োজন। জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে সামিল করার জন্য সরকারের উদ্যোগ। প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা মানুষের ঘরে ঘরে খাবার, ওষুধ ইত্যাদি পৌঁছে দিয়েছেন তাদেরও সামিল করা হোক। আসুন, আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই। আর একটি প্রাণও যেন অসহায় ভাবে অক্সিজেন, ওষুধ বা চিকিৎসার অভাবে হারিয়ে না যায়।

জরুরিভিত্তিতে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকুন মূখ্যমন্ত্রী। শুধু বিধানসভায় উপস্থিতি দেখে নয়, সমস্ত রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হোক। বাংলা পথ দেখাক। সকলের মতামত গ্রহণ করুন জরুরি জরুরি, জরুরি ভিত্তিতে।

dewcha rally on 6 January 2022

(সিউড়ি শহরে ৬ জানুয়ারি বিভিন্ন সংগঠন ও ব‍্যক্তিবর্গের যৌথ বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন, ডেউচা-পাচামি খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে। জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে জমায়েতে বক্তব‍্য রাখছেন অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ‍্যাসোসিয়েশনের নেতা রুদ্র প্রভাকর দাস। বিস্তারিত রিপোর্ট পরবর্তী সংখ‍্যায়।)

poor in the ration!

নতুন বছরে কিছু নতুন পাওয়ার আশা জাগে মানুষের, বিশেষ করে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষজন মুখিয়ে থাকেন যদি অভাব মোচনে কিছু নতুন প্রাপ্তিযোগের খবর মেলে। কিন্তু ২০২২ সালের সূচনায় বাংলার গরিব জনগণের উল্টে শুরু হল বঞ্চনার পালা। এরাজ্যের ‘গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’র আওতায় গণ্য হওয়া মানুষেরা জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রের কোটা অনুযায়ী খাদ্যশস্যের পরিষেবা পাবেন না। এরকমই জানিয়েছে অল ইন্ডিয়া ফেয়ার প্রাইস শপ ফেডারেশন। এআইএফপিএসএফ’এর কাছে খবর পৌঁছেছে বাংলার জন্য কেন্দ্রের উপরোক্ত বরাদ্দের ভাঁড়ারে লেগেছে টান। আরও খবর হল, এফসিআই নাকি রাজ্যের চাহিদা অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করে উঠতে পারেনি! কিন্তু কেন করে উঠতে পারেনি তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। শুধু জানা যাচ্ছে, জানুয়ারির কোটা ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া হবে — ফেব্রুয়ারির কোটা মার্চে দেওয়া হবে। তারপর মার্চের পাওনা কবে মেটানো হবে, আদৌ হবে কিনা সে খবর নেই। বরাদ্দ সরবরাহের দায় কেন্দ্র স্থির করেছে একমাস করে পিছিয়ে দেবে। তাহলে জানুয়ারির এই খাদ্যশস্য পাওয়ার ঘাটতিটা পূরণ হবে কোথা থেকে? হয় অনাহার-অর্ধাহার থাকতে হবে। বাজার থেকে চাল-আটা কিনে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোর উপায় কৈ!

সরকারপক্ষ খাদ্যশস্যের প্রশ্নে বাজার অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিণামে বাস্তবে কোপটা পড়ছে দু’ভাবে। একদিকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান-চালের সরকারি সংগ্রহ অভিযানে দেওয়া হচ্ছে চরম ঢিলা। ফলত অবিলম্বে ব্যয় উসুলের তাড়নায় চাষিকে বাধ্য করা হচ্ছে ফড়ে-দাদনদার চক্রের মাধ্যমে বাজারের শক্তিগুলোর কাছে খাদ্যশস্য বেচে দিতে, এবং অতি লোকসানে। ফলে চাষিসমাজ পড়ছে সংকটের আবর্তে। এই কারণে গত একবছর যাবত কৃষক আন্দোলন চলেছে। অন্যদিকে সেই খাদ্যশস্যের বাজার দাম চড়া হয়েই চলেছে। বিশেষত পশ্চিমবাংলায় পরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক শস্যহানি হওয়ায় মওকা বুঝে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলো ভীষণ সক্রিয় হয়েছে। আরও চড়িয়ে দিয়েছে সবরকমের চাল-আটা ইত্যাদির দাম। তাই গরিব মানুষেরা ক্ষুধার জ্বালা মেটাবে কী করে? ঋণ করে পেট ভরানোর উপায় করতে গেলে উপরন্তু তাড়া করবে সুদের ভোগান্তি। নাহলে অগত্যা খাদ্যশস্য গ্রহণের পরিমাণ কমে যাওয়াই অনিবার্য। ২০২১ সালের নভেম্বরেও কেন্দ্র দম্ভ দেখাতে ছাড়েনি, মোদী আমলে ভারত হয়ে উঠেছে বাইরের দুনিয়ায় যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য খাদ্যশস্যের রপ্তানীকারক দেশ। অথচ এরা লজ্জার মাথা খেয়ে স্বীকার করে না বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ২০২০ সালে ৯৪, আর ২০২১ সালে ১০১। সামনে আবার সেই আরও দুঃসহ দুরবস্থারই সম্মুখীন হতে হবে। কেন্দ্রের তরফে বলা হচ্ছে, উদ্ভুত সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে নাকি কেবল এই পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে। এখানে এফসিআই মারফত খাদ্যশস্য ঠিকমতো সংগ্রহ না হওয়ার কারণেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এভাবে কেন্দ্র সংগ্রহে ভাটা চলার পেছনে যদি ‘যুক্তিজাল’ বিছোতে চায় যে, যেহেতু এই রাজ্য থেকে এফসিআই মারফত ধান-চাল সংগ্রহ করে রেশনে উপরোক্ত বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের কোটা মেটানো হয়, আর সেটা যেহেতু অতি সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংগ্রহ করার উপায় থাকেনি, তাই মাসিক সরবরাহ একমাস করে পিছোবে। কিন্তু এই যুক্তির ধৃষ্টতা ধোপে টেঁকে না। কারণ, প্রথমত কেন্দ্রের বরাদ্দ কোটার নির্ধারিত মেয়াদকাল হল চারমাস। প্রতি চারমাস অন্তর খতিয়ে দেখে কোটা বৃদ্ধি-হ্রাসের পলিসি পুনর্বিন্যাস করার কথা। তাহলে এরাজ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটার আগে সময় থাকতে মজুদ সারা হয়নি কেন? তাছাড়া এই রাজ্য থেকে মজুদ করা না গেলেও জরুরি প্রয়োজনে অন্য রাজ্য থেকে সংগ্রহ করে দেওয়া হবে না কেন? ‘এক দেশ, এক রেশন’এর ঢাক পেটানোয় বিরতি হয় না। অথচ যখন-তখন পোহাতে হয় রেশন-বঞ্চনা।

কেন্দ্রের ‘গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ প্রকল্পে রয়েছেন এরাজ্যের ৬ কোটি ১ লক্ষ মানুষ। কেন্দ্র জাহির করছে এবাবদ বিগত চারমাসে খাদ্যশস্য সরবরাহ করার সর্বশেষ নির্ধারিত পরিমাণ হল ৩০ কোটি ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। কেন্দ্রের কথা হল, রাজ্যের চাহিদার ভিত্তিতেই বরাদ্দের পরিমাণ স্থির করা হয়। যদিও রাজ্য সরকারের রিপোর্ট কার্ডও স্বচ্ছ নয়। এবিষয়ে তাই কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যেকার তর্কাতর্কি থেকে দোষের ভাগের প্রকৃত তল পাওয়া খুব মুশকিল। তবে কেন্দ্র এটা ভোলাতে পারবে না যে, সহজে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবারাহের এই দায় নিতে চায়নি। ক’দিন আগেও শোনা গেল কেন্দ্র-রাজ্যের শাসকরা যে যার লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ‘ভূয়ো’ ছেঁটে ফেলার অভিযান শুরু করতে চলেছে। মোদী জমানায় বেকারি বৃদ্ধি ৪৫ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তার ওপর ২০২০’র প্রথম ত্রৈমাসিক পর্ব থেকে অতিমারীর চোটে কর্মসংস্থানের সংকট এক ধাক্কায় চরমে উঠে যায়। প্রচন্ড বিধ্বস্ত হয় সমগ্র অসংগঠিত ক্ষেত্র। রাজ্যে রাজ্যে দৃশ্যমান হতে থাকে কপর্দকশূন্য ভুখা জনতার ক্রমবর্ধমান ভীড়। এই প্রেক্ষিতে ২০২০ থেকেই দেশজুড়ে ঝড় ওঠে — “ভাষণ নয়, রেশন দাও, প্রতি শূন্য হাতে নগদ দাও!!” এরই চাপে কেন্দ্র কেবল বিনামূল্যে রেশন দিতে শুরু করে। তাও পর্যাপ্ত নয়, কিছু পরিমাণে। নগদ দেওয়ার নাম আজ পর্যন্ত করেনি। ২০২১ সালের শেষের শুরুর দিনগুলো থেকেই কেন্দ্র খবর ভাসাতে থাকে, বিনামূল্যে রেশন আর দেওয়া হবে না। সুতরাং সন্দেহ জাগা অবিচিত্র নয়, পশ্চিমবাংলায় গরিব কল্যাণ খাতে অন্ন বণ্টনের মাসিক কোটা স্থগিত রাখা ও একমাস পিছিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনও পরিকল্পিত প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হচ্ছে না তো!

hate speech

জাতীয় রাজধানী দিল্লীতে, উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে, আর ছত্তিশগড়ের রাইপুরে সমাবেশ সংগঠিত করে গেরুয়াধারী নেতারা মুসলমানদের গণহারে হত‍্যা করার আহ্বান রাখলেন এবং ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার শপথ পাঠ করালেন। ‘ধর্ম সংসদ’ নাম দেওয়া এই সমাবেশগুলির পুরোভাগে আছে সন্ত্রাসবাদীদের এক ভয়ঙ্কর হিংস্র নেটওয়ার্ক। ধর্মের নামে তারা প্রকাশ‍্যে হিন্দু শিশুদের সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত করছে এবং অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছে।

ওরা প্রকাশ‍্যেই গডসের প্রতি ওদের আনুগত‍্য ঘোষণা করে। সেই গডসের প্রতি, যে গডসে গান্ধীকে হত‍্যা করেছিল এবং যাকে স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী বলা হয়। বিবিধের মাঝে মহান মিলনের গণতান্ত্রিক এই ভারতকে ওরা গডসের ভারতে পর্যবসিত করার ঘোষণা দেয়। ওদের এইসব কথাগুলির প্রতিধ্বনি তোলে বিজেপি’র নেতা, মন্ত্রী ও অন‍্যান‍্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্যাঙ্গালুরুর বিজেপির এমপি তেজস্বী সুরিয়া সম্প্রতি সার্বিক ‘ঘর ওয়াপসি’, অর্থাৎ মুসলমান ও খ্রিস্টানদের গণহারে ধর্মান্তরিত করার আহ্বান রাখলেন। তারপর অবশ‍্য তিনি মন্তব‍্য ‘প্রত‍্যাহার’ করে নিলেন ‘বিতর্ক এড়াতে’। নতুন বছর এগিয়ে আসার সাথে সাথে দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে হাজির হল সংঘ পরিবারের সন্ত্রাসবাদী এজেণ্ডা যা বিজেপি ও তার সরকারগুলির দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত হচ্ছে।

দেশে যখন সবচেয়ে বেশি দরকার কৃষকের, শ্রমিকের, যুবদের, ছাত্রছাত্রীদের, মহিলাদের ‘সংসদ’ সংগঠিত করে কাজ, ক্ষুধা, স্বাস্থ‍্য, শিক্ষা, সামাজিক ন‍্যায় ও সমতার প্রশ্নগুলি চর্চায় আনা, তখন ধর্ম ও বিশ্বাসের নামে এরকম ঘৃণা-সংসদ সংগঠিত করছে এরা কোন শক্তি? উত্তরটা অজানা নয়। নজরটা ওদের আসন্ন নির্বাচনের দিকেই। চাকরি, কৃষি, স্বাস্থ‍্য ও শিক্ষায় বিজেপি সরকারের অপরাধসম ব‍্যর্থতা থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দিতেই এই ঘৃণার জমায়েতগুলি সংগঠিত করছে ওরা। আর মহান মিলনের গণতান্ত্রিক ভারতকে কর্তৃত্ববাদী ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানানোর যে ঘৃণ‍্য উদ্দেশ‍্য সংঘ পরিবারের আছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন‍্যও সংগঠিত হচ্ছে এই জমায়েতগুলি।

নরসিংহানন্দ বা সাধ্বী অন্নপূর্ণার মতো ঘৃণা প্রচারকেরা এখন হিন্দুদের বিভিন্ন প্রখ‍্যাত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মাথা (নরসিংহানন্দ যেমন জুনা আখড়ার প্রধান) এবং একই সাথে তারা বজরং দলের মতো সংঘী বাহিনীরও নেতা। হিন্দুদের জন‍্য সবচেয়ে বড় বিপদ এইসব পুরুষ ও নারীদের দিক থেকেই আসছে যারা হিন্দু ঘরের শিশুদের মনকে বিষিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের টেররিস্ট কার্যকলাপের দিকে চালিত করছে।

এইসব নেতারা মুসলমান বিক্রেতাদের বয়কট করতে, অস্ত্র শানাতে, গডসের আদর্শ গ্রহন করতে এবং সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়টাকেই মুছে ফেলতে হিন্দুদের উস্কানি দেওয়ার জন‍্য হিন্দু ধর্মের দোহায় দেয়। এতদসত্বেও অধিকাংশ শংকরাচার্য, আচার্য, সদগুরু ইত‍্যাদি বিভিন্ন হিন্দু বিশ্বাসের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতারা তো লজ্জাজনকভাবে মৌন আছেনই, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত, যারা কিনা ভারতের সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার শপথ নিয়েছেন তাঁরাও, সম্পূর্ণ নীরব আছে।

Be vocal against spreading hate speech

ক্রিস্টমাস ডে খ্রিস্টানদের জন‍্য পবিত্র দিন এবং সকলের জন‍্যই উৎসবের দিন। কিন্তু সংঘীদের কাছে এটা সান্তা ক্লজের কুশপুতুল পোড়ানোর দিন হয়ে যায়। এই আক্রমণগুলোর সাথে আসে খ্রিষ্টানদের পরিচালিত স্কুল ও প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর সংঘীদের হিংস্র হামলা। মাদার টেরেসা প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অব চ‍্যারিটি ভারতের মুমূর্ষু ও দুস্থদের কল‍্যাণে বিবিধ দাতব‍্য ও সেবামূলক কার্যকলাপের জন‍্য পরিচিত। মোদী সরকার এদের তহবিলে দান আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মুসলমান সংখ‍্যালঘুদের পাশাপাশি খ্রিস্টান সংখ‍্যালঘুরাও সংঘী সন্ত্রাসবাদের নিশানা।

একথা খুব স্পষ্ট যে বিজেপি’র প্রতি ভারতের জনতার খুব দ্রুতই মোহভঙ্গ হচ্ছে এবং বিজেপি জমি হারাচ্ছে। হিমাচল প্রদেশের উপনির্বাচনে হারের পর চণ্ডীগড় কর্পোরেশন ইলেকশনে ভোট ও আসনসংখ‍্যা উভয় কমে যাওয়া তার সর্বশেষ সূচক। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও উন্মাদনা এখন মোদী সরকারের শেষ আশ্রয়। সম্ভবত মোদী সরকার বিশ্বাস করে যে কৃষি আইন প্রত‍্যাহারের সাথে সাথে কৃষক আন্দোলন সহ অন‍্যান‍্য আন্দোলন পেছনের সারিতে চলে যাবে এবং অনুপ্রেরণাময় সংগ্রামের মধ‍্যে দিয়ে যে লড়াকু মানসিকতা ও সংহতির মেজাজ তৈরি হয়েছে তা স্তিমিত ও নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। আর বিজেপি সেই সুযোগে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দিয়ে, জনতাকে দমিয়ে দিয়ে, ক্ষমতা ও রাজনৈতিক এজেণ্ডার ওপর নিজেদের কব্জা পুনরায় কায়েম করে নেবে।

এই এজেণ্ডা নামিয়ে আনতে বিজেপি কেবলমাত্র নিজস্ব সংগঠন ও নেটওয়ার্কের ওপরই নির্ভর করে এগোচ্ছে না। বিরোধী পক্ষের দুর্বলতাকেও সে কাজে লাগাচ্ছে। এবং বিজেপিরই মতাদর্শগত ময়দানে বিজেপি’রই তৈরি করা শর্তে বিজেপি’কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যে প্রবণতা কংগ্রেসের একাংশ ও আপ’এর মতো নতুন দল সহ বিভিন্ন অবিজেপি দলগুলির মধ‍্যে দেখা যাচ্ছে সেই প্রবণতাকেও কাজে লাগিয়ে এগোচ্ছে বিজেপি। রাইপুরের কর্মসূচিতে কংগ্রেস নেতাদের কয়েকজনের উপস্থিতি এবং বাঘেলা সরকারের জড়দগব নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এই বিষয়টা দেখিয়ে দেয়।

হিন্দু বিশ্বাসের নামে চলা এই সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধ করতে সক্রিয়ভাবে সংগঠিত হওয়া ভারতের প্রতিটি গণআন্দোলন এবং প্রতিটি নাগরিকের অবশ‍্যকর্তব্য। এপ্রশ্নে নীরবতা আসলে কুকর্মের সহযোগিতার নামান্তর। প্রত‍িটি নগর শহর গ্রাম মহল্লা, প্রতিটি গলি ও রাজপথ, প্রত‍্যেক এলাকায় প্রতিবাদ সংগঠিত করতে হবে বিজেপি’র পৃষ্ঠপোষকতায় চলা এই সন্ত্রাসবাদী জমায়েতগুলির বিরুদ্ধে। এটাই নতুন বছরের অঙ্গীকার।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যা)

India's Freedom Movement

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

মোদী সরকার ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীকে ভারতের ইতিহাস পাল্টে লেখা তথা হাইজ্যাক করার এক বিশাল মহড়ায় পরিণত করে ফেলেছে। আজকের বিজেপি’র মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক পূর্বসূরীদের ভারতের ঔপনিবেশিক-বিরোধী জাতীয় গণজাগরণে প্রায় কোনও ভূমিকাই ছিল না, কারণ তারা তখন ঔপনিবেশিক শাসকদের সহযোগী হয়ে, তাদের ‘ভাগ করে শাসন কর’ কৌশলের বাস্তবায়নে সহায়তা করতে ব্যস্ত ছিল। আর একাজে তাদের হাতিয়ার ছিল তাদের হিন্দুত্ব বা হিন্দু আধিপত্যবাদী সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের রাজনীতি যাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বিভক্ত ও বিপথগামী করতে তারা সচেষ্ট ছিল। আজ, তাদের উত্তরসূরীরাও সেই একই ভয়ানক পথে ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখন এবং ভারতকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যস্ত।

মোদী সরকার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীকে ভারতের স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব হিসাবে উদযাপন করছে, বা বলা ভাল ‘অমৃতের’ নামে আসলে মিথ্যা ও ঘৃণার বেসাতি ছড়িয়ে বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে। ঐ অনুষ্ঠানের ঘোষিত লক্ষ্য হল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উপেক্ষিত নায়কদের, শ্রদ্ধা-স্মরণ উদযাপনের মাধ্যমে জনমানসে তুলে ধরা। এই উল্লিখিত উদ্দেশ্য নিয়ে খুব আপত্তির কিছু থাকতে পারে না, কিন্তু বিজেপি’র স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ উপেক্ষিত নায়ক’ হিসাবে হিন্দুত্বের প্রথম তাত্ত্বিক নেতা ভি ডি সাভারকরকে তুলে ধরায় অবশ্যই আপত্তি আছে, যিনি ভারতের বিপর্যয়কর দেশভাগের মতাদর্শগত ভিত তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয় ঔপনিবেশিক প্রভুদের কাছে ‘অবিমৃশ্যকারী পুত্র’ হিসাবে নিজের মুক্তির জন্য দয়া ভিক্ষা করে এবং তাদের স্বার্থরক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারংবার তাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গৌরবময় ঐতিহ্যকেও কলঙ্কিত করেছিলেন। সঙ্ঘ পরিবারের অনেকেই প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী নাথুরাম গডসের ‘উত্তরাধিকার’ও উদযাপন করেন, যিনি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন!

সংঘ পরিবারের আইকনদের তথাকথিত ‘উপেক্ষিত নায়ক’ হিসাবে পুনর্বাসিত করা ও সঙ্ঘ পরিবারকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘উপেক্ষিত ধারা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সংগ্রামের বিভিন্ন পর্বকে এবং কিংবদন্তীপ্রতীম বীরদের বিকৃত ও অপব্যবহার করা — ইতিহাস নিয়ে বিজেপি’র এই ধ্বস্তাধ্বস্তির আসল উদ্দেশ্য স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্য ও অর্জনগুলির অবমূল্যায়ন ও অসম্মান করা এবং স্বাধীনতাকে কার্যত ‘দেশভাগের ভয়াবহতায়’য় পর্যবসিত করা। যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণভাবে, সরকার এবার ১৪ আগস্ট, পাকিস্তান গঠনের দিনটিকে ‘দেশভাগের ভয়াবহতা স্মরণ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের ‘দুর্বৃত্ত’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যারা নাকি ভারতের কিছু অংশকে তাদের ‘নিজস্ব ভূমি’ হিসাবে নিয়ে চলে গেছে; আর কেবল হিন্দুদেরই দেশভাগের যন্ত্রণার শিকার হিসাবে দেখানো হয়েছে। দু’পারের সম্প্রদায়গুলিই যে সেই যন্ত্রণার শিকার, যে যন্ত্রণা দেশভাগকে চিরচিহ্নিত করে রেখেছে — এইভাবে তাকে অস্বীকার করা হয়েছে।

ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকী উদযাপনে আমাদের অবশ্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রধান ঘটনা, সন্ধিক্ষণ এবং অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকে ফিরে দেখতে হবে, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। বরং তার মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং ধারণাগত ক্রমবিকাশকেও উপলব্ধি করতে হবে, আঁকড়ে ধরতে হবে, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন; যা তার বৈপ্লবিক উত্তরাধিকার গড়ে তুলেছে যা স্বাধীনতার সাতটি দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও, আজও আমাদের শিহরিত করে, অনুরণন জাগায়। মোদী সরকার আমাদের প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পদদলিত করে চলেছে এবং পূর্বতন ঔপনিবেশিক শাসকদের উত্তরসূরীর মতো শাসন করছে, ভগৎ সিং যাদের ‘ভুরে আংরেজ’ বা বাদামি সাহেবদের শাসন বলে সতর্ক করে গেছেন, সেই ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির চলমান লড়াইকে জারি রাখার জন্য আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৈপ্লবিক উত্তরাধিকারকে আহ্বান জানাতে হবে।

ঔপনিবেশিক যুগে স্বাধীনতার অর্থ ছিল সর্বপ্রথম ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি। এটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, এবং জাতীয় মুক্তির এই রূপকল্পটির উপর সারা ভারতের মানুষ ‘জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা’ হিসাবে আস্থা রেখেছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব গ্রহণের অনেক আগেই, ভারতে ঔপনিবেশিক-বিরোধী যোদ্ধারা স্বাধীনতা এবং লোক(গ্রাহ্য) সার্বভৌমত্বের ধারণাটিকে স্পষ্ট রূপ দিতে শুরু করেছিলেন। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমবেত সঙ্গীতে ভারতের জনগণকে ‘দেশের মালিক’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, “হাম হ্যায় ইস্কে মালিক, হিন্দুস্তান হামারা” (আমরা এই জমির মালিক, হিন্দুস্তান/ভারত আমাদের)। বিরসা মুণ্ডার উলগুলান জনতার উদ্দেশে উদ্দীপ্ত আহ্বান রেখেছিল “আবুয়া দিশুম, আবুয়া রাজ” (আমাদের রাজ্য, আমাদের শাসন)। লোক সার্বভৌমত্ব বা মানুষের হাতে ক্ষমতার এই আবেগদীপ্ত চেতনা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল সংবিধানের প্রস্তাবনায়, “আমরা, ভারতের জনগণ” কর্তৃক ভারতকে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র রূপে গঠন করার সশ্রদ্ধ আন্তরিক অঙ্গীকার ঘোষণায়। এইভাবেই ভারত এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন জনগণ।

ভারতের মানুষ সবসময়ই বৈচিত্র্যময়। জাতিগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় — এই বৈচিত্র্যই ভারতের ঐক্যের ভিত্তিগত মূলসূত্র। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং চলাচল বৃদ্ধি অবশ্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধন এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যেকে সম্ভব করেছিল, তবে এই ঐক্যকে ‘অভিন্নতা’ বা ‘একজাতীয়তার’ সন্ধান বলে ভুল করা উচিত নয়। অভিন্নতা বা একজাতীয়তা চাপানোর প্রচেষ্টা সর্বদাই ঐক্যকে দুর্বল করেছে এবং বিরূপ প্রভাবিত অঞ্চল বা সম্প্রদায়গুলি দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক সেই চরম দেশভাগ বৈচিত্র্যকে কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু দেশভাগ-পরবর্তী ভারত এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ। স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের বৈচিত্র্যের প্রতি একটি সুস্থ বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতির মনোভাবের বিকাশ ঘটিয়েছিল, এক এবং একমাত্র যেটি ভারতের জাতীয় ঐক্যের সহনশীল প্রাণোচ্ছলতা এবং শত শত রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যের (হিন্দু ও মুসলিম শাসকদের অধীনে থাকা) ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত মিলে যাওয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

সংবিধান আমাদের বৈষম্যহীন এবং সমান নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি রাষ্ট্রকে তুলনামূলকভাবে/ আপেক্ষিকভাবে ধর্ম থেকে মুক্ত রেখেছে। আর যদিও এটি ভারতকে সুস্পষ্টভাবে একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও রাজ্যগুলির অনেক বিষয়েই স্বশাসনের ক্ষমতা ছিল। প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন এবং ভারতের অপরিহার্য বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদের বৃহত্তর স্বীকৃতির প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু মোদীর অধীনে বিজেপি সরকার ঠিক তার বিপরীত অভিমুখে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে — সিএএ নাগরিকদের মধ্যে এবং অভিবাসী, যাদের ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হচ্ছে, তাদের মধ্যে বৈষম্যের সূচনা করেছে; রাষ্ট্র ক্রমশ একটি হিন্দুরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে; কেন্দ্র নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাজ্যগুলিকে কার্যত বড়সড় পৌরসভার সমপর্যায়ে নামিয়ে এনেছে; বহুত্ববাদকে ক্রমাগত কলঙ্কিত এবং অভিন্নতার অধীন করা হচ্ছে।

আজাদী বা স্বাধীনতা ছাড়াও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্য মূল শব্দটি ছিল ‘ইনকিলাব’ বা বিপ্লব, যা ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ শ্লোগানে অমর হয়ে আছে। উর্দু কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মৌলানা হাসরাত মোহানি কর্তৃক উদগীত এবং ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডদের দ্বারা অমর হয়ে থাকা এই শ্লোগানটি স্বাধীনতার বৈপ্লবিক তাৎপর্য, এবং প্রগতিশীল পরিবর্তন, অধিকারের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম এবং সদা সতর্কতার কেন্দ্রিকতার (গুরুত্বের) দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আর এই বিপ্লব, নিজেকে একটি আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণজাগরণের অংশ হিসেবেই দেখেছে।

বস্তুত, ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত কেন্দ্রীয় পরিষদে (সেন্ট্রাল অ্যাসেম্ব্লি) অন্য যে শ্লোগানটি তুলেছিলেন তা ছিল ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে একটি বিচ্ছিন্ন এবং স্বতন্ত্র লড়াই ছিল না, এটি আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিরোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বেড়ে ওঠে। আর ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর যখন ইউরোপ ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়ার উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রগতিশীল ধারা ইউরোপে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধকে সমর্থন করেছিল। ছয় ভারতীয় — লেখক মুলক রাজ আনন্দ, সাংবাদিক গোপাল মুকুন্দ হুদ্দার, ডাক্তার অটল মোহনলাল, ডাঃ আইয়ুব আহমেদ খান নকশবন্দি ও ডাঃ ম্যানুয়েল পিন্টো এবং ছাত্র রামাসামি বীরপান — জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দিয়েছিলেন। লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয়রা তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন; জওহরলাল নেহরু ১৯৩৮ সালে স্পেনে সংহতি সফর করেছিলেন। ভারতে বসে আরএসএস যখন মুসোলিনি এবং হিটলার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল, তখন ভারতের প্রগতিশীল স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইউরোপে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধে সামিল হয়েছিলেন।

স্বাধীনতা আন্দোলন শুধুমাত্র ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্যই নয়, একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ভারত গড়াও তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। আদিবাসী এবং অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায় যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় গণভিত্তি গঠন করেছিলেন, তারা জমিদার ও মহাজনদের হাত থেকে মুক্তির জন্য নিরলসভাবে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। আদিবাসী বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন নিজের শক্তিকে সুদৃঢ় ও সুসংহত করেছিল কেবল সামরিক নিয়ন্ত্রণ এবং দমনমূলক আইনের মাধ্যমে নয়, বরং ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এবং অন্যান্য রাজস্ব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণীর মাধ্যমে সামন্ত শক্তিকে শক্তিশালী করে, দেশীয় রাজ্যের ক্ষমতার স্থায়ীকরণ এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন ও শাসনের নীতির কঠোর প্রয়োগ করে। সেই সময়ের একজন ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ সামরিক আধিকারিকের ফাঁস হয়ে যাওয়া কথায়, “আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত সর্বশক্তিতে (আমাদের জন্য সৌভাগ্যের) বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে বিদ্যমান বিভেদকে বিচ্ছেদে পরিণত করা .... ভারত সরকারের নীতি হওয়া উচিত ভাগ করো, শাসন করো” (লে. কর্নেল কোকার, মোরাদাবাদের কমান্ড্যান্ট; ইন্ডিয়া টুডে, ১৯৪০-এ রজনী পাম দত্ত দ্বারা উদ্ধৃত)। কিছু সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া, ভূস্বামী ও দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যগুলির পুতুল শাসকরা ঔপনিবেশিক শাসনের সামাজিক ভিত্তি তৈরি করেছিল। আর তাই ঔপনিবেশিক-বিরোধী সংগ্রাম জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রাম থেকে শক্তি পেয়েছিল।

ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক আন্দোলনে ভূস্বামী ও মহাজনী ব্যবস্থার উচ্ছেদ কেন্দ্রীয় শ্লোগান হিসেবে উঠে আসে। গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহ আন্দোলন এই মূল এজেন্ডাকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় এবং জঙ্গী কৃষক আন্দোলনের সমস্ত সংস্পর্শ থেকে সন্তর্পণে দূরে সরে যাওয়ায়, কৃষক আন্দোলন ‘নিখিল ভারত কিষাণ সভা’ নামে তাদের নিজস্ব সংগ্রামী মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে। অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীকে এর প্রথম সভাপতি হিসাবে নিয়ে গঠিত হয়েছিল এবং এটি জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং গ্রামীণ ঋণ বাতিলের দাবিতে ১৯৩৬ সালের আগস্টে একটি ‘কিষাণ ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছিল। শক্তিশালী কৃষক সংগ্রাম গ্রামীণ ভারতে শুধু সামন্তী-ঔপনিবেশিক শক্তিকেই দুর্বল করেনি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও হিংসার বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ ভাষ্য এবং প্রতিরোধ শক্তিও তৈরি করেছে। স্বাধীনতার পর, জমিদারির পুরানো রূপটি আইনত বিলুপ্ত হয়েছিল, কিন্তু তারপরে ভূমি সংস্কারের কাজ অনেকাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যায়; আর এখন আমরা ভূমি সংস্কারের বিপরীত প্রক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি। ঔপনিবেশিকের জায়গায় কর্পোরেটকে রাখুন, তাহলেই আমরা দেখতে পাব কর্পোরেট জমিদারি এবং ঋণ সংকটের নতুন হুমকির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন কীভাবে লড়ছে!

সংগঠন করার এবং কাজের পরিবেশ ও জীবনযাত্রার উন্নত মানের জন্য লড়াইয়ের অধিকার সহ শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৈপ্লবিক উত্তরাধিকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করেছে। এই সংগ্রামের ফলে ঔপনিবেশিক আমলেই শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত বেশ কিছু আইন পাশ হয়েছিল। ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট এবং ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, ১৯২৬ থেকে পেমেন্ট অফ ওয়েজেস অ্যাক্ট এবং ন্যূনতম মজুরি আইন পর্যন্ত ভারতের অনেক মূল শ্রম আইন স্বাধীনতার আগেই পাশ হয়েছিল। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং ১৯২০ সাল থেকে সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলন ছাড়াও, ১৯৩৬ সালে ডঃ আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টিও ঔপনিবেশিক ভারতে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য বিরাট অবদান রেখেছিল। আইএলপি, যা ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং পুঁজিবাদ — উভয়কেই শ্রমিক শ্রেণীর শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হিসাবে উঠে এসেছিল, বড় নির্বাচনী জয় পেয়েছিল এবং বিধানসভা নির্বাচনী পরিসরের পাশাপাশি বৃহত্তর শ্রমিক-কৃষক সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

সত্যি ১৯৩৬ সালটা ছিল এমন একটি বছর, যে বছরটি দু’টি সংগ্রামী আহ্বানের জন্ম দিয়েছে। একদিকে কিষাণ সভা জমিদারী অবসানের ডাক দিয়েছিল, অন্যদিকে আম্বেদকর জাতিপ্রথা নির্মূলের দৃপ্ত আহ্বান নিয়ে জনপরিসরে এসেছিলেন। বর্ণব্যবস্থার অবলুপ্তির আহ্বান খুব কার্যকরীভাবে সামাজিক ন্যায়বিচারের এজেন্ডাকে সামাজিক রূপান্তরের উচ্চতর মঞ্চে তুলে ধরেছিল। অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের সীমিত গান্ধীবাদী ভাবনা থেকে সরে এসে, আম্বেদকর গোটা জাতিভেদ প্রথাটাকেই দূর করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শ্রম বিভাজনের নামে জাতপাতকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে, আম্বেদকর উন্মোচিত করেছিলেন কীভাবে জাতিভেদ প্রথা শ্রমিকদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। উত্তরটি স্পষ্টতই নিহিত রয়েছে জাতপাত-বিরোধী ভিত্তিতে শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যসাধনে, যেখানে বর্ণ শ্রেণীতে বিলীন হয়ে যাবে। এইসব প্রাগ্রসর ভাবনার এক বিন্দুতে এসে মিলে যাওয়া — জমিদারির বিলুপ্তি, জাতপাতের অবলুপ্তি এবং শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যসাধন — শ্রেণী ঐক্য ও শ্রেণী সংগ্রামকে অনেক বড় পরিসরে এবং উচ্চতর স্তরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সন্ধিক্ষণে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ঠিক এখানেই আমাদের আজকের ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই অপূর্ণ সম্ভাবনা এবং উত্তরাধিকারকে খুঁজে পেতে হবে, অনুসন্ধান করতে হবে।

Legacy of India's Freedom Movement

স্বাধীনতা আন্দোলনকে অবশ্যই বুঝতে হবে আরও এক অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে — গণবিক্ষোভে নারীদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, যার ফলশ্রুতিতে পিতৃতান্ত্রিক অনুশীলন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে এবং নারীর সমান অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। নারীদের অংশগ্রহণ শুধুমাত্র কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না — সাঁওতাল হুল এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযান এবং তেভাগা ও তেলেঙ্গানার মতো জঙ্গী কৃষক বিদ্রোহ — প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই সংগ্রামের প্রধান পর্যায় এবং ধরনগুলিতে মহিলারা অগ্রণী ছিলেন। কম আলোচিত মণিপুরের নুপি ল্যান সংগ্রামের (১৯০৪ এবং ১৯৩৯) মতো কয়েকটি লড়াইয়ে নারীরা নেতৃত্বও দিয়েছেন। মণিপুরীতে নুপি ল্যানের আক্ষরিক অর্থ হল ‘নারী বাহিনীর যুদ্ধ’ এবং নুপি ল্যান সংগ্রামে মণিপুরের মহিলারা স্থানীয় রাজা এবং ধনী ব্যবসায়ী আর সেইসঙ্গে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সমাজে নিজেদের তুলনামূলকভাবে উচ্চ মর্যাদা রক্ষায় লড়াই করেছিলেন, পিতৃতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক শক্তি যে মর্যাদা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। এই যুদ্ধ মণিপুরের পুরুষ শ্রমিকদেরও দাসত্ব ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি নিশ্চিত করেছিল। প্রকৃত অর্থেই এটি ছিল আজকের শাহীনবাগের বৈষম্য ও বিভাজনমূলক সিএএ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আফস্পা এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মণিপুর ও কাশ্মীর উপত্যকায় মহিলাদের শক্তিশালী প্রতিবাদের অগ্রদূত।

বিজেপি’র জন্য, জাতীয়তাবাদ মানে হিন্দুত্ব, এবং আজাদীর অমৃত মহোৎসব উদযাপন হল সঙ্ঘ বাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে একটি ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অসমাপ্ত প্রকল্পটি সফল করার উদ্দেশ্যে ইতিহাস ছিনতাইয়ের মহড়া। আমাদের জন্য, স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার হল — সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং টিঁকে থাকা ঔপনিবেশিক উপাদানগুলোর বিপদগুলির বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ সতর্কবাণী, কাজে না লাগানো সম্ভাবনাগুলিকে আয়ত্তে আনা এবং “আমরা, ভারতের জনগণ”এর সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক ভারত গঠনের লক্ষ্যে অভিযাত্রার অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি পূরণের এক স্থায়ী অনুপ্রেরণা। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারায় ভারতবাসী ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করেছিলেন, স্বাধীনতার সাত দশক পরে আবারও তারা ফ্যাসিবাদী চক্রান্তকে পরাস্ত করবে!

Various organizations and individuals are vocal

দেউচা-পাঁচামী কয়লা খনি প্রকল্প প্রত্যাহার করার দাবি সংক্রান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়েছে গত ৩ জানুয়ারি কলকাতা প্রেস ক্লাবে। বিবৃতির মূল মূল বিষয়গুলি এই পত্রিকার বিগত বর্ষশেষ সংখ্যায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। উপরোক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিবিশেষ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ‘জনস্বার্থ’ দেখার নামে স্থানীয় ব্যাপক আদিবাসী ও অআদিবাসী নির্বিশেষে অধিবাসী উচ্ছেদ, পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনা, ভয়ভীতি ছড়ানো, দমন নামানো ইত্যাদি মূল্যে এক অগণতান্রিক উপায়ে জনস্বার্থ বিরোধী প্রকল্প রূপায়ণের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল জনগণ ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতায় সোচ্চার ও সক্রিয় হতে এগিয়ে আসুন।

এই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছেন,

পার্থ ঘোষ, অভীক সাহা, প্রসেনজিৎ বসু, অভিজিৎ মজুমদার, সঞ্জীব মুখার্জি, সাগুন হেমব্রম, অমর্ত্য রায়, কুমার রাণা, অনিন্দ্য সরকার, মলয় তেওয়ারি, শুভপ্রতীম, সুরিন্দর সিং, জয়তু দেশমুখ, প্রবীর মিশ্র, জগন্নাথ টুডু, ইন্দ্রানী দত্ত, সুফিয়া খাতুন, সমর বাগচি, অজিত রায়, পানমুনি হাঁসদা, পার্থ চৌধুরী, নব দত্ত, শামিম আহমেদ, সরস্বতী বেসরা, বোবাই হেমব্রম, বুধি টুডু, সোমনাথ চ‍্যাটার্জি, মীর রাকেশ রৌশান, স্বর্ণেন্দু মিত্র, রণজয় সেনগুপ্ত, শরদিন্দু বিশ্বাস, সন্দীপ রায়, সজল অধিকারী, মোহন মন্ডল, বাসুদেব ব‍্যানার্জী, অম্লান ভট্টাচার্য, মঙ্গল হাঁসদা, সুনিরাম মুর্মু, পরিমল মুর্মু, অনন্ত হাঁসদা, রতন হেমব্রম, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, স্বরাজ ইন্ডিয়া, আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা, ইয়ং বেঙ্গল, আমরা - এক সচেতন প্রয়াস, এআইসিসিটিইউ, সারা ভারত কিসান মহাসভা, জয় কিষাণ আন্দোলন (সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা শরিক), দেউচা-পাঁচামী ভূমিরক্ষা কমিটি, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, মহিলা স্বরাজ, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী নাগরিক মঞ্চ (শিলিগুড়ি), বীরভূম গগ গাঁওতা, দামামা নাট্য সংস্থা, নাগরিক মঞ্চ, সাহিত‍্যিক, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ, খেড়োয়াল ভাষা বন্ধন কমিটি, হড় সমাজ সুসৌরিয়া, মহলন্দী নাগরিক মঞ্চ, অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ‍্যাসোসিয়েশন, বিপ্লবী যুব অ‍্যাসোসিয়েশন, জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক, কালধ্বনি, সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি, উৎনৌ, পিইউসিএল, সান্তাড় মহল মারাংবুরু সমিতি, সিধো কানু চাঁদ ভৈরোব সেবাদল, আদিবাসী যৌয়ন গাঁওতা, ‘ল’ বীর মানঝি জলাবাঁধ, সাঁওতাল ইতিহাস সংসদ।

closing the educational institution

এআইএসএ (আইসা)-র পক্ষ থেকে গত ৩ জানুয়ারি ২০২২ প্রচারিত প্রেস বিবৃতি

অবিলম্বে ছাত্র ও সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে আলোচনায় বসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্প মডেল তৈরি করতে হবে সরকারকে। শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের ব্যয়ভার সরকারকে নিতে হবে।

রাজ্যে কোভিড সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের চোখ রাঙানি যেমন আছে; তাকে অজুহাত করে প্রথম কোপ পড়ল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। সরকার আবার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে আদেশ দিয়েছে। আমরা দেখেছি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার দরুণ কত শিক্ষার্থী আর পড়াশোনার মধ্যে ফেরেনি, পরিসংখ্যান বলছে এই হার বেড়েছে। সংক্রমন রোধে দেড়-দু বছরেও এখনও পর্যন্ত সরকার কেন কোনো সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি, এর কোনো উত্তর নেই। আর উত্তর নেই বলেই আজ আবার বিধিনিষেধ ঘোষণার নামে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সমস্যার সমাধান হিসাবে দিয়েছে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা, যারফলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই, ফলে খুব স্বভাবতই তারা বিভিন্ন ধরণের শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষার্থীরা যখন মাঝে কিছুদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার পর আবার স্বাভাবিক পড়াশোনার মধ্যে ফিরতে পারতো, তাদেরকে আবার পড়াশোনার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে উৎসাহিত করার পরিকল্পনাও সরকার নেয়নি, যে দায়িত্ব একান্তই এই সরকারের ছিল। অথচ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার যে নয়া শিক্ষানীতি ২০২০, এনেছে তার পথ আরো সুগম করছে এই সরকার। ওই নীতিতে ‘অনলাইন’ এই শব্দ একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। দেখা যায় যে অনলাইন ব্যবস্থা একটা আনুষঙ্গিক ব্যাপারমাত্র পড়াশুনা করতে, জ্ঞান আরোহণের ক্ষেত্রে! অথচ একে শুধু কর্পোরেটদের সুবিধে করতে শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে বিক্রি করার এক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘টাকা যার, শিক্ষা তার’, অতিমারির অজুহাতে এই নীতিই বলবৎ করছে সরকার।

আমরা, ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ মনে করি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকার একদমই চিন্তিত নয়, তারা কোভিড’এর মতো বিশালাকায় সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে মুনাফার চাটুকারিতা করছে। শিক্ষার্থীদের সবার ঐচ্ছিক টিকাকরণের ব্যবস্থা করানো, অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যাতে কোভিড সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখা যায়। আমাদের দাবি হল এই পর্যায়ে হস্টেল ও লাইব্রেরি খোলা রাখতে হবে এবং ক্লাসরুমে শিক্ষার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে, ক্যাম্পাসে সর্বদা একটা মেডিকেল টিম জরুরি ভিত্তিতে নিযুক্ত করে রাখতে হবে, নিয়মিত স্যানিটাইজেশানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের ব্যয়ভার সরকারকে নিতে হবে। দ্রুত ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-অধ্যাপক সংগঠনগুলো ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে আলোচনায় বসুক সরকার। কিভাবে দ্রুত স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্ষেত্রে ফিরতে পারে, তার দিশা নির্ধারণ করুক সরকার, অন্যথায় আন্দোলনই একমাত্র রাস্তা।

Kisan Mahasabha in Chunchura

অকাল বর্ষণে শস্যহানির ক্ষতিপূরণ, কৃষিঋণ মকুব ও গ্রামে গ্রামে সরকারি উদ্যোগে ধান কেনার দাবিতে সারা ভারত কিষাণ মহাসভার ডাকে বৈঁচিতে অনুষ্ঠিত গণকনভেনশন থেকে হুগলীর জেলা শাসকের নিকট ডেপুটেশন কর্মসূচি ঘোষিত হয়। এই ঘোষণা অনুসারে জেলার এক বড় অংশ জুড়ে কৃষক-কৃষিশ্রমিক-কৃষিজীবী মানুষদের মধ্যে সপ্তাহব্যাপী গণস্বাক্ষর অভিযান চালানো হয়। সহস্রাধিক কৃষকের গণস্বাক্ষর সম্বলিত দাবিসনদ নিয়ে গত ৪ জানুয়ারি হুগলী জেলা শাসকের দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। জেলা শাসকের পক্ষে তাঁর প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা শাসক (জেলা পরিষদ) শান্তনু বালা এই ডেপুটেশন গ্রহণ করেন। শান্তনুবাবু জানান, ধানের ক্ষতিপূরণের দাবি এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের বিবেচনায় নেই। এআইকেএম’র প্রতিনিধিদল সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ধানেরও ক্ষতিপূরণের দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলে এডিএম বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। আলুর ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে তিনি জানান, বাংলা শস্যবীমা যোজনার (বিএসবিওয়াই) আওতায় জেলার দেড় লক্ষ আবেদনকারীর প্রত্যেকেই ক্ষতিপূরণ পাবেন। ক্ষতিপূরণের পরিমাণের প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে বিএসবিওয়াই’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বীমা কোম্পানি সমীক্ষা শুরু করেছে। সমীক্ষা শেষে ক্ষতিপূরণের শতাংশ নির্ধারণ করা হবে। এর প্রেক্ষিতে প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়, “সমীক্ষার ফলাফল যাই হোক, কৃষকদের ১০০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।” যাদের নিজস্ব জমি নেই এমন গরিব ঠিকা ও ভাগচাষিদেরও ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে এডিএম বলেন, “এই ধরনের কোনও কৃষক ক্ষতিপূরণের জন্য ব্লকের সহকারি কৃষি অধিকর্তার (এডিএ) নিকট আবেদন জানাতে পারেন। এডিএ শংসাপত্র দিলে ওই কৃষকও ক্ষতিপূরণ পাবেন।” প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতে কমপক্ষে একটি করে সরকারি উদ্যোগে ধান সংগ্রহের স্থায়ী শিবির স্থাপনের দাবিকে এডিএম স্বীকার করেন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিষয়টি জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। ডেপুটেশন দলে ছিলেন মহঃ ইউসুফ মন্ডল, ইদ্রিশ সেখ ও মুকুল কুমার।

ডেপুটেশন কর্মসূচির পূর্বে চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভসভায় বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন বাগ, কিষাণ মহাসভার রাজ্য যুগ্ম-সম্পাদক তপন বটব্যাল, এআইসিসিটিইউ নেতা ভিয়েত ব্যানার্জী এবং পার্টির জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার।

Women's Association

দেউচা-পাঁচামীতে কয়লা খনির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে রাজ্য সরকারের লোকেরা বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গ্রামে ঢোকে খনির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে। কিন্তু গ্রামের মহিলারা রুখে দাঁড়ান, তাঁরা জানিয়ে দেন কয়লা খনি তারা চান না। পুলিশ মহিলাদের ওপর লাঠি চালিয়ে আহত করে এবং আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেও বাধা দেয়। এই নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও দেউচা-পাঁচামী কয়লা খনির বিরোধিতা করে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির কলকাতা জেলা কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রচার কর্মসূচি সংগঠিত করা হয় যাদবপুরের সন্ধ্যাবাজার ও পালবাজারে। দু’টি ছোটো সভা অনুষ্ঠিত করা হয়। বক্তব্য রাখেন চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, সৌমি জানা, সম্প্রীতি মুখার্জি, ইন্দ্রাণী দত্ত। সভা সঞ্চালনা করেন মমতা ঘোষ। বক্তারা তুলে ধরেন যে, জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মেয়েদের সামনের সারিতে দেখা যায় কারণ জমির সঙ্গে মেয়েদের নিবিড় সম্পর্ক থাকে। মদ খাইয়ে তাদের আন্দোলনে কেউ পাঠান না। আদিবাসী মানুষদের উচ্ছেদ করে ও পরিবেশকে ধ্বংস করে দেউচা-পাঁচামী কয়লা খনি তৈরি করা চলবে না, এই হুঁশিয়ারি সভায় দেওয়া হয়।

rally at Faleya Bazaar of RYA

২৩ ডিসেম্বর থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশন (আরওয়াইএ) একমাসকালীন প্রচার অভিযান নিয়েছে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তার অংশ হিসেবে ২ জানুয়ারি ফলেয়া বাজারে এক বিক্ষোভসভা সংগঠিত হয়। উল্লেখ্য, ঐদিন ফলেয়া অফিসে আরওয়াইএ’র সম্মেলন পরবর্তী কার্যকরি কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। মিটিং শেষে বিক্ষোভসভা হয়। সভা শুরু হয় শেখ সাবিরের (রাজা) গলায় গণসঙ্গীত দিয়ে। বক্তব্য রাখেন আরওয়াইএ’র রাজ্য কমিটির সদস্য সন্তু ভট্টাচার্য, শুভদীপ পাল ও কার্যনির্বাহী সভাপতি সজল দে। সকলেই তাদের বক্তব্যে জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনে বছরে ১০০ দিনের কাজ পাওয়ার প্রশ্নে দুর্নীতি থেকে শুরু করে এসএসসি টেট সহ বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরেন। তাছাড়াও সারারাজ্যে হঠাৎ করে কোভিড বিধি নিষেধ নামিয়ে আনা এবং বিশেষ করে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার যে পদক্ষেপ রাজ্য সরকার করল তারফলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে জনসমাজ ও বিশেষত ছাত্রসমাজ, এই বিষয়গুলিও তুলে ধরা হয়। এছাড়া রাজ্য সরকার দেউচা-পাঁচামীতে আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষদের উচ্ছেদ করে প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকারক যে কয়লা খনি প্রকল্প নিয়েছে তারও বিরোধিতা করা হয়। সভায় আরওয়াইএ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির সদস্য আনসারুল আমন মন্ডল। সভা চলাকালীন বহু পথচলতি মানুষ ও ছোট ছোট দোকানদার ও স্থানীয় মানুষ সমাবেশিত হয়েছিলেন।

Many workers were killed in Bihar

গত ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ সকালে বিহারের মুজাফ্ফরপুরের ‘বেলা’ শিল্পাঞ্চল এলাকায় কুরকুরে নুডলস্ কারখানার ২নং ইউনিটে একটি বয়লার ভয়ঙ্কর শব্দে ফেটে পড়ে। ঘটনার অভিঘাত এতটাই যে অকুস্থল থেকে ৫ কিমি দূরের ঘরবাড়ি বিল্ডিং কেঁপে ওঠে। আকাশ থেকে নামতে থাকে অসংখ্য লোহার টুকরো। সর্বত্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয় আসন্ন ভূমিকম্পের সম্ভাবনায়। প্রত্যক্ষদর্শী পিন্টু, যিনি দুর্ঘটনায় মৃত সন্দীপ কুমারের তুতোভাই, অভিযোগ করেন গত ছ’মাস যাবৎ বয়লারে ফুটো ধরা পড়ে। বারংবার কারখানার ম্যানেজার উদয় শঙ্কর এবং অন্যান্য পরিচালন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোনও ফল হয়নি। বয়লার ঐ অবস্থাতেই চলতে থাকে এবং তা ফেটে পড়ে ২৬ ডিসেম্বর। জেলা প্রশাসন মৃতের সংখ্যা ঘোষণা করে ৭ জন। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা এবং কারখানার শ্রমিকরা বলেন মৃতের সংখ্যা ও আহতের সংখ্যা কয়েক ডজন হবে। যেহেতু সময়মতো বয়লার সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তি করেননি পরিচালন কর্তৃপক্ষ, তাই ঘটনার জন্য তারা পুরোপুরি দায়ী। একমাত্র উচ্চপর্যায়ের তদন্তে জানা যাবে প্রকৃত সত্য।

কারখানার এক শ্রমিক পঙ্কজ বললেন, “সকালে ডিউটি করতে এসেছিলাম। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে বয়লার ফেটে কারখানার ছাদ উড়ে যায়। অনেক শ্রমিকের ছিন্নভিন্ন দেহ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচাই।” আরেক শ্রমিক বিকাশ যাদব বললেন, “আমার বাবা লালন ঐ বয়লারের হেড অপারেটর ছিলেন। তিনি দুর্ঘটনায় মৃত। ছ’মাস আগেই ধরা পড়ে বয়লারের ফুটো ও সেফটি ভালভ্ কাজ করছে না। অভিযোগে কাজ না হওয়ার প্রতিবাদে শ্রমিকরা ২ দিনের ধর্মঘটও করেন।”

স্থানীয় আবাসিকরা বলেন প্রশাসনের ঘোষণা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সংখ্যা তাঁরা বিশ্বাস করেন না। ২৬ ডিসেম্বর অন্তত ১৫০ জন শ্রমিক কারখানায় কাজ করছিলেন। কর্তৃপক্ষ বলেন ৭ জন মৃত ও ৭ জন আহত। কারখানায় ঐদিনের কর্মরত শ্রমিকের কোনও তালিকাও তারা দেননি।

‘বেলা’ শিল্পাঞ্চলে ২৫০’র বেশি কারখানা আছে। শ্রমিকের সংখ্যা ৪০,০০০’র বেশি। বেশিরভাগ কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থার মান ও যন্ত্রপাতির খামতি আছে। মোদী নুডলস্ (কুরকরে) কারখানার উপযুক্ত ছাড়পত্রও নেই। শ্রম আইন মেনে চলা হয় না। বেশিরভাগ শ্রমিক চুক্তি প্রথায় দৈনিক ১০-১২ ঘন্টা কাজ করেন। বেতন সাকুল্যে ৪,০০০-৫,০০০ টাকা মাসিক। ঐ শিল্পাঞ্চলে কোনও অগ্নিনির্বাপণ বাহিনী নেই। নেই কোনও হাসপাতাল। এসমস্ত কিছুই চলছে কারখানার মালিক ও প্রশাসনের অশুভ আঁতাতে। নীতীশ সরকার ও শিল্পমন্ত্রী এরজন্য সম্পূর্ণ দায়ী। এইজন্য বেলা শিল্পাঞ্চলে প্রতিটি কারখানা উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি দ্বারা তদন্ত করাতে হবে।

বিহার সরকারের ভূল শিল্প কর্মসূচী ও অবহেলার জন্য শুধুমাত্র বেলা শিল্পাঞ্চলের ঘটনা একমাত্র উদাহরণ নয়। কয়েকদিন আগেই বারাউনি ও সুগাউলিতে একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সরকারের টনক নড়েনি।

boiler explosion at Muzaffarpur

উপরোক্ত সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন সিপিআই(এমএল)-র তদন্তকারী টীম। টীমের নেতৃত্বে ছিলেন ফুলওয়ারি শরিফের বিধায়ক গোপাল রবিদাস। দ্রুত তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে কুরকরে কারখানা ও হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। তাঁরা অন্যান্য কারখানাও পরিদর্শন করেন। সিপিআই(এমএল) বিহার রাজ্য সম্পাদক কুণাল বলেন, নীতীশের জমানায় ক্রমশই কারখানার সংখ্যা নিম্নমুখী, কতিপয় বেসরকারি কারখানা চলছে কিন্তু তাদের প্রতি সরকার অমনোযোগী। এইসব কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার মান নিদারুণভাবে ভাঙ্গা হচ্ছে। কারখানার মালিকরা প্রশাসনকে সংকুচিত করেছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অবহেলা করেছে, ফলস্বরূপ বহু সংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু প্রশাসন মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে লুকোছাপা করছে। মৃতের পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দিতে হবে। আহতদের প্রত্যেককে ২৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে। কারখানার ম্যানেজারকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে হত্যার মামলা দায়ের করতে হবে। ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করতে হবে। বিধায়ক গোপাল রবিদাস অভিযোগ করেন, কারখানা ম্যানেজার সরকার এবং বিজেপির সমর্থনপুষ্ট। তাই ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত আবশ্যক। দুর্ঘটনার তদন্তকারী টীমে অন্যান্য সদস্যরা হলেন মুজাফ্ফরপুর জেলা সম্পাদক কৃষ্ণ মোহন, শত্রুঘ্ন সাইনি, আফতাব আলম, ফাহাদ জামান, আসলাম রহমানি, মনোজ যাদব, মোহঃ আইজাজ, আকবর-ই-আজম সিদ্দিকি, নৌসাদ আলম এবং আমোদ পাসওয়ান।

তিনবছর আগে মুজাফ্ফরপুর জেলার বোছাহানে একটি কারখানায় আগুন লেগে ১১ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সরকার, প্রশাসন সেই ঘটনা থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। সিপিআই(এমএল) এবং এআইসিসিটিইউ মুজাফ্ফরপুর শহরে প্রতিবাদ মিছিল করেন ২৮ ডিসেম্বর। পরের দিন ২৯ ডিসেম্বর নীতীশ কুমার ‘সমাজ সুধার যাত্রা’র জন্য মুজাফ্ফরপুর শহরে পরিদর্শনে আসে। মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী অপরাধজনক অবহেলার দায় অস্বীকার করতে পারেন না।

sarna JharkhandSarna religions

বিজেপি-সঙ্ঘীদের ষড়যন্ত্রমূলক সাম্প্রদায়িক বিভাজনের খপ্পর থেকে সারনা জনগোষ্ঠীকে দূরে রাখার জন্য এক ভিন্ন সারনা ধর্মবিধির দাবি করল বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনের নেতৃত্ব ঝাড়খণ্ড সরকারের কাছে।

সিপিআই(এমএল) এবং আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা আদিবাসীদের এই আলাদা সারনা ধর্মবিধির দাবিকে সমর্থন জানালো। তাদের বক্তব্য হল আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিশ্বাস এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় অটুট ঐতিহ্য বজায় রেখে তাদের সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখেছেন। বিজেপি-সঙ্ঘীরা আদিবাসী সম্প্রদায়কে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য দাবার বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। আদিবাসী সমাজ তাদের এই চাল ভেস্তে দিতে রুখে দাঁড়িয়েছে। সঙ্ঘী-বিজেপি প্রচার করছে সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি অংশ হল আদিবাসী সমাজ — যা আদতে কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন। হিন্দুধর্মের ভিত্তিই হল জাতপাত ব্যবস্থা। আদিবাসী সামাজিক-ধর্মীয় ব্যবস্থা এর থেকে মুক্ত। সারনা ধর্মবিশ্বাসের অনুগামীরা জাতপাত নিয়ে সংঘর্ষ, মহিলাদের প্রতি হিংসা, উগ্র ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত। সারনা ধর্মবিশ্বাসীদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করার ষড়যন্ত্রের জন্য হিন্দুত্ববাদীরা আদিবাসী রাজ্যগুলিতে ও অঞ্চলগুলিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনছে এবং আদিবাসীদের সংরক্ষণের অধিকার হরণ করতে চাইছে।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ঝাড়খন্ড রাজ্য সম্পাদক মনোজ ভক্ত, বিধায়ক বিনোদ সিং এবং ঝাড়খণ্ড আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার রাজ্য আহ্বায়ক দেবকী নন্দন বেদীয়া মিলে ঝাড়খণ্ড রাজ্যপালকে একটি ভিন্ন সারনা ধর্মবিধি তৈরি করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য স্মারকপত্র দেন।

Suicide is on the rise in the country

দিন কয়েক আগে স্বয়ং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানিয়েছিলেন, গত সাতবছরে শুধু আইআইটি, এনআইটি’র মতো কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১২২ জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছেন। সংসদে বিরোধীদের প্রশ্ন ছিল, হাতে গোনা কয়েকটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে ছবিটা যদি এই হয়, তা হলে দেশের পুরো ছবিটা কতটা ভয়াবহ! সেই উত্তর মিলছে কেন্দ্রেরই আর এক সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বা এনসিআরবি’র তথ্যে। ২০১৬ থেকে ২০২০ — এই পাঁচবছরে লাফিয়ে বেড়েছে দেশে পড়ুয়াদের আত্মহত্যা।

প্রত্যাশার চাপ বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পড়ুয়াদের উপরে। প্রত্যাশা পূরণ না হতেই ‘থ্রি-ইডিয়েটস’ সিনেমার জয় লোবোর সেই লাইন — “আই কুইট” — ফিরে ফিরে আসছে পড়ুয়াদের জীবনে। এনসিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-এ সারাদেশে পড়ুয়া আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৯,৪৭৮, যেটা ২০২০-তে তা পৌঁছেছে ১২,৫২৬-এ। ধাপে ধাপে এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে। ইঁদুর দৌড়ে ছাত্রছাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। তারসঙ্গে সারাদেশে ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ববাদও বেড়েছে।

অন্যদিকে ২০১৬-তে বাংলায় ১,১৪৭ জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করলেও ২০২০-তে তা নেমে এসেছে ৩২৩-এ। যদিও রাজ্যের বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া তথ্যে গলদ রয়েছে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের বক্তব্য, “প্রত্যাশার চাপ, ব্যর্থতাকে মেনে নিতে না পারার সমস্যা আছেই। কিন্তু বাংলার ক্যাম্পাসগুলি অনেক বর্ণময়। যেসব ক্যাম্পাসে কর্তৃত্বের বেড়াজাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে, সেখানে সমস্যা বেশি।” দেবশঙ্কর হালদারের বক্তব্য, “এখন কেবল প্রমাণ করলেই হবেনা, প্রত্যেককেই বিশেষ কেউ হতে হবে বলে দৌড় চলছে। এই গোলকধাঁধায় মানিয়ে উঠতে না পেরেই আত্মহত্যার রাস্তা নিচ্ছে অনেকে।” তাঁর সংযোজন, “নাটক, রাজনীতি, ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো পড়াশোনাও কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ কাজ। বাংলার পরিবেশে সেই সঙ্ঘবদ্ধতা এখনও রয়েছে। ফলে চাপ সত্ত্বেও পড়ুয়াদের একটা অন্য জীবন রয়েছে।”

এনসিআরবি’র তথ্যেও এই নিরিখে আত্মহত্যার সূচক ঊর্ধ্বমুখীই। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, গুজরাট ও দিল্লী’র মতো রাজ্য রয়েছে এই পরিসংখ্যানে উপরের দিকে। তবে আইআইইএসটি, শিবপুরের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বষ্ট বক্তব্য, “ক্যাম্পাসে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিনিয়ে নিয়ে ছাত্রদের কেরিয়ারসর্বস্ব করার ব্যবস্থায়, প্রকল্প আর মনোবিদে কিন্তু আত্মবহত্যার প্রবণতা কমবে না।”

- এই সময়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১

The story of the rapid growth

৪ সপ্তাহ আগে, নভেম্বরের ৩০ তারিখ বিকেলে, যথাবিহিত বর্তমানকালে দেশের অর্থনৈতিক ‘প্রগতি’র একমাত্র সূচক ত্রৈমাসিক ‘জিডিপি’ তথা ‘জিভিএ’, অন্যকথায়, যথাক্রমে ‘মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন’ বা ‘মোট মূল্যযোগের হিসেব’ ঘোষিত হয়েছিল। দেশের মানুষকে সুশিক্ষিত বা সচেতন করার প্রচেষ্টা কোনো সরকার, কেন্দ্রীয় বা পশ্চিমবঙ্গ, করেছে, এমনটা তাদের ঘোর সমর্থক প্রমাণ করতে পারবেন না। কারণ তা না করলে পরিসংখ্যানের জাগলারির মধ্য দিয়ে অনায়াসে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো যায়। সেটা গত সাতবছরের কেন্দ্রীয় সরকার ও গত এগারো বছরের রাজ্য সরকারের আচরণ ও ঔদ্ধত্যে পদে পদে প্রমাণিত। তা নাহলে রাজ্য সরকার তিনবছর আগে অনায়াসে বলতে পারেনা যে আমরা কৃষকদের আয় ৩ গুণ করে দিয়েছি, বা কেন্দ্রীয় সরকার বলতে পারে না যে, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করতে চলেছি বা, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের জাতীয় আয় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার (বর্তমান মূল্যে ৩৮০ লক্ষ কোটি টাকা) করে ফেলব। ফলে প্রতিবার ওই ত্রৈমাসিক ফলাফল ঘোষণার সময়ে আমরা অর্থনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী হলাম তার গুণকীর্তন করা হয়। এবারও হয়েছে।

গতবছরে সারা বিশ্বের সর্বনিকৃষ্ট ভয়ঙ্কর লকডাউনের চারমাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই আমাদের বিচক্ষণ সর্বজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী বলতে শুরু করেন, দেশের অর্থনীতিতে নব অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে ও দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সেই যে অর্থনীতি ঘুরতে শুরু করেছে, তা ঘুরেই চলেছে। লক্ষণীয় সেই বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে তার আগের বছরের অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় জিডিপি ৭.৪ শতাংশ কমেছিল। মনে রাখা দরকার প্রধানমন্ত্রী ঘুরে দাঁড়ানোর কথাটি বলেছিলেন, ২০২০’র জুলাইয়ের গোড়ার দিকে। ২০২০’র জুলাই–সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে ২০১১-১২ সালের স্থিরমূল্যে জিডিপি ছিল ৩২.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা যা পূর্ববর্তী বছরের অনুরূপ সময়ের জিডিপি ৩৫.৬২ লক্ষ কোটি টাকার তুলনায় ২.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা কম। সেই যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর স্তোকবাক্য শুরু হয়েছে তা আর থামছেনা। এবছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপি ২০২০’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপির তুলনায় ২০.১ শতাংশ বেড়েছিল বলে কী বিপুল উচ্ছাস শুরু হয়েছিল টুইটারে ফেসবুকে ও হোয়াটসএ্যাপে। মোদী-সিতারামন-গোয়েল-মালব্য-শাহ-জাভরেকার-ঠাকুররা কেউ বলেননি যে পুরো বৃদ্ধিটাই অত্যন্ত নিম্ন ভিত্তির উপরে হিসেব করার ফল। কারণ ২০২০’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপি ২০১৯’র অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২৪.৪ শতাংশ কমেছিল। তাই ২০২১’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপির বৃদ্ধির হার ২০.১ শতাংশ হওয়া সত্বেও ওই জিডিপি’র পরিমাণ (৩২.৩৮ লক্ষ কোটি টাকা) তার দু’বছর আগের অনুরূপ সময়কালের জিডিপি (৩৫.৬৭ লক্ষ কোটি টাকা)-র নিরিখে ৩.২৯ লক্ষ কোটি টাকা কম ছিল।

ঠিক একই চালাকি আবার করা হচ্ছে। ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকের জিডিপি’র নিম্ন ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে এবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকের জিডিপি’র বৃদ্ধি ঘটেছে ৮.৪ শতাংশ। কিন্তু যদি ওই জিডিপি’র পরিমাণ (৩৫.৭৩ লক্ষ কোটি টাকা)-কে ২০১৯ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকের জিডিপি’র পরিমাণের (৩৫.৬২ লক্ষ কোটি টাকা) সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়াবে ০.১১ লক্ষ কোটি টাকা বা ০.০৩ শতাংশ মাত্র। যদি ২০১৯-২০ সালের প্রথম দুটি ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২০২১-২২ সালের প্রথম দুটি ত্রৈমাসিকের জিডিপি’কে দেখা হয়, তাহলে দু’বছর আগের ৬ মাসের জিডিপি ৭১.২৮ লক্ষ কোটি টাকার তুলনায় এবছরের প্রথম দু’মাসের জিডিপি কমেছে ৩.১৭ লক্ষ কোটি টাকা।

অন্যদিকে গত বারোমাসে চলতি মূল্যে বা বাজারমূল্যে জিডিপি’র পরিমাণ মোটামুটিভাবে ২২০ লক্ষ কোটি টাকা (২.৯ ট্রিলিয়ন ডলার) দাঁড়িয়েছে। ফলে ওই পরিমাণকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে গেলে দেশের জিডিপি’র বৃদ্ধির হার আগামী আড়াই বছর বার্ষিক ১৮ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অনন্ত গঙ্গায় ডুব দিলেও সেটি হওয়ার নয়। তবু দেশবাসীকে অসচেতন রাখার কাজটি প্রধানমন্ত্রী করে যাবেন। দেশ কতটা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে এব্যাপারে একটা মোহ তৈরি না করতে পারলে, ক্ষুধাসূচক-লিঙ্গবৈষম্যসূচক-অসাম্য-বন্টন বৈষম্য- দারিদ্র-বেকারি — এই সমস্ত বাস্তব বিষয় থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে রাখা যাবে কী করে? সেটা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর প্রচার সহায়করা ভালোই বোঝেন। তা নাহলে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারেই যখন অন্তত ৫৭ লক্ষ ছোট-মাঝারি সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে করোনা কালের একবছরে, যখন দেশজুড়ে পাইকারি মূল্য সূচক হু হু করে বাড়ছে বার্ষিক ১৪.২ শতাংশ হারে, যখন বেকারির হার ১০ শতাংশ ছাড়াচ্ছে তখন বারংবার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বা হাজার হাজার কোটি টাকার স্ট্যাচু তৈরি, মন্দির বানানো বা গঙ্গা থেকে মন্দির পর্যন্ত পথ বানাতে হাজারো কোটি টাকা খরচার ঢাক বাজানো সত্যিই অসহ্য।

মন্দির ও প্রাসাদ বানাতে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে তখনই ছোট মাঝারি শিল্পের নাভিশ্বাস উঠছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ীই কোভিডের সময়ে লকডাউনের পরে ৯ শতাংশ ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এনসিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করেছেন ৯,০৫২ জন ব্যবসায়ী, ২০২০ সালে সেই সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়ে ১১,৭১৬-তে পৌঁছেছে। ধরাই যেতে পারে আত্মহত্যাকারী ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই ছোট ব্যবসায়ী, কারণ নামী ব্যবসায়ী (যেমন ‘কাফে-কফি-ডে’র মালিক ভিজি সিদ্ধার্থ) আত্মহত্যা করলে তা খবরের পাতায় চর্চিত হতে থাকে, ছোট ব্যবসায়ীরা আত্মহত্যা করলে কোনো খবর হয় না। তাঁরা কেবল একটি সংখ্যা। ধনী বনাম গরিবের দ্বন্দ্বটিকে মন্দির-মসজিদের বাচনে রূপান্তর করতে পারলে আরএসএস-বিজেপি’রও সুবিধে, আবার অর্বুদপতি শিল্পপতিদেরও দিলখুশ। কেউ আর অসাম্য নিয়ে প্রশ্ন করবেনা, সবই তো তেনার ইচ্ছে। এদিকে ভারত এক চরম অসাম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ল্যাবের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ভারতে ১ শতাংশ ধনীর কাছে ৩৩ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। অন্যদিকে নিচের ৫০ শতাংশের কাছে রয়েছে ৬ শতাংশেরও কম সম্পদ। একদিকে ১ শতাংশ ধনী আয় করে ২২ শতাংশের মতো, অন্যদিকে নীচের ৫০ শতাংশ গরিবের মোট আয় সামগ্রিকের মাত্র ১৩ শতাংশ। দেশের সরকার রামমন্দির তৈরির জন্য যত উৎসাহ দেখায় তাঁর ছিটেফোটাও অসাম্যের তথ্য পরিসংখ্যান সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করাতে দেখান না। ওই রিপোর্ট অনুসারে ভারতের অসাম্য সংক্রান্ত তথ্য সঙ্কলন ও প্রকাশন গত তিনবছরে এতটাই খারাপ হয়েছে যে তার ভিত্তিতে অসাম্যের পরিমাপ প্রায় অচল।

মোদী সরকার যখন দাবি করছে দেশ ‘আত্মনির্ভর’ হচ্ছে তখন জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। গত নভেম্বরে শেষ হওয়া বারোমাসে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার ৪.৯ শতাংশ। কিন্তু ওই বৃদ্ধি যেহেতু গতবছর নভেম্বরে শেষ হওয়া বারোমাসে ছিল ৬.৯ শতাংশ তাই খুচরো বাজারে গত দু’বছরের গড় বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। ফলে গত ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে যে জিনিসের দাম ছিল ১০ টাকা তা এখন বেড়ে ১১ টাকা ২২ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। সারাদেশে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি একই রকম নয়। দেখা যাচ্ছে যে, বিজেপি শাসিত অধিকাংশ রাজ্যেই ওই বৃদ্ধি জাতীয় গড়ের থেকে বেশি। যেমন হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড। অবশ্য গুজরাটে ওই হার গড় হারের থেকে কম। নভেম্বরে শেষ হওয়া ১২ মাসে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১৪ শতাংশের বেশি, অক্টোবরে সেটি ছিল ১২ শতাংশের বেশি। সাধারণত পাইকারি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটি সম্পর্ক আছে। পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার খানিক পরে খুচরো মূল্যে তার ছাপ পড়ে। ফলে পাইকারি বাজারে এই ১২-১৪ শতাংশ বৃদ্ধি, খুচরো মূল্যের উপর চাপ ফেলবে বলেই মনে হয়। তাছাড়া, এখনকার সরকারি পরিসংখ্যান এতটাই অস্বচ্ছ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে কমিয়ে দেখানো হতেই পারে কারণ ওই পরিসংখ্যানের উপরে দাঁড়িয়ে সরকারি মজুরির হার, মহার্ঘভাতা এগুলি তৈরি হয়। তবে বাজার যে অগ্নিমূল্য তা দেশের মানুষ বুঝতেই পারছে।

সব মিলিয়ে ক্ষুধা, লিঙ্গবৈষম্য, অসাম্য, বন্টনবৈষম্য, দারিদ্র, বেকারি বিবিধ সমস্যাসঙ্কুল এক দেশ তৈরি করতে মোদী সরকার জোর কদমে এগিয়ে চলেছে জিডিপি বৃদ্ধির কল্পকথার গল্প ফেঁদে।

- অমিত দাশগুপ্ত

due to lack of staff

এক বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কাজ আছে, তবু চেয়েও শ্রমিক অমিল চটকলে’ শীর্ষক সংবাদের সূত্রে কয়েকটি কথা। বেকার যুবকদের চটকলে কাজের অনীহার অন্যতম কারণ কী? এমনকি কর্মীর অভাবে এবছর মিলগুলো বস্তার যোগানও ঠিক সময়মতো দিতে পারেনি। ফলে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রক গম প্যাকেজিংয়ে চটের বস্তার বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চটের বস্তার চাহিদা ও যোগানের মধ্যে এতো পার্থক্য কেন? মিল কর্তৃপক্ষ বেশি মুনাফার লোভে, শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার সুযোগগুলো আত্মসাৎ করছে। প্রতিটি মিলে নথিভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমেছে। ‘ভাউচার’ প্রথায় কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। ‘ভাউচার শ্রমিকদের’ মিলে কোনও আইনি অস্তিত্ব নেই, বেওয়ারিশ শ্রমিক হিসাবেই তারা থেকে যান। মিল কর্তৃপক্ষ যখন তখন এই সব শ্রমিকদের ‘গেট বাহার’ করে দেয়। ‘হায়ার এন্ড ফায়ার’ নীতি চটকলে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে মিলগুলো আধুনিকীকরণের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রথমে তাঁত বিভাগে এস-৪ ও ভিক্টর লুম দিয়ে শুরু হয়, এখন চেইন বিমিং, ওয়ার্প ওয়াইন্ডিং, স্পিনিং এবং ফিনিশার কার্ডরোল ফিডিং পর্যন্ত নতুন মেশিনে কাজ হচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রতিটি বিভাগেই নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হবে। অর্থাৎ কম সংখ্যক মজুর দিয়ে অধিক উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এদিকে ম্যান-মেশিন রেশিও পুরনোই থাকছে। এর ফল হল কম শ্রমিক, উৎপাদন বেশি ও মজুরি কম।

চটকল মালিকদের অজুহাতের শেষ নেই। কিছুদিন আগে তারা বলতে থাকলো, বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে কম দামে চোরাপথে বস্তা ঢুকছে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সীমন্তে উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করুক। এর কিছুদিন বাদেই হঠাৎ করে ১০-১২টি মিল বন্ধ হয়ে গেল। ‘যুক্তি’ — পাটের অভাব। কেন্দ্রের বস্ত্রমন্ত্রক রাজ্য সরকারের শ্রমদপ্তর যৌথভাবে অনুসন্ধান করে জানতে পারে বেশকিছু মিল মালিক পাট মজুত করেছে। এই প্রসঙ্গে ইউনিয়নগুলো রাজ্য শ্রমদপ্তরকে মুখোমুখি মিটিংয়ে বসার আবেদন করতে থাকে। রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসে। জুন ও অক্টোবর মাসে দুটি মিটিং হয়। এখানে ইউনিয়ন, আইজেএম এবং সরকারের বক্তব্য তুলে ধরা হল।

ত্রিপাক্ষিক মিটিংয়ে ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা বলেন, “কাঁচা পাটের সংকটের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী একদল অসাধু ব্যবসায়ীর অবৈধ মজুতদারী। তারা পরামর্শ দিয়েছে সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারের পাট কমিশনার মজুত বিরোধী অভিযান করুক। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কাঁচা পাট আমদানির সম্ভাব্য উপায় বার করুক।” ইজমার চেয়ারম্যান বলেন “কাঁচা পাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং জুট কমিশনারের ৩০ সেপ্টেম্বরের নির্দেশিকায় কাঁচা পাটের ঘাটতি মেটাতে এবং পাটের বিধিবদ্ধ যে মূল্য নির্ধারণ করেছে সেই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আশঙ্কা করেন, অদূর ভবিষ্যতে কাঁচা পাটের ঘাটতির কারণে বেশ কয়েকটি পাটকলের কাজ স্থগিত হওয়ার পথে।”

শ্রম দপ্তরের স্বাধীন প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না মিটিংয়ে উপস্থিত সবাইকে অবহিত করেন, “পাট কমিশনার এবং ইন্ডিয়ান জুট মিল অ্যাসোসিয়েশন ও জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’এর প্রতিনিধিদের সাথে ২৮ মে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে জুট কমিশনার তার আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাঁচা পাট সংক্রান্ত বিষয় ১০ জুনের মধ্যে ব্যবসায়ীদের জানাবে, মিলগুলির কাজ চালিয়ে যেতে হবে। নতুন পাট বাজারে না আসা পর্যন্ত মজুত পাট দিয়ে মিলে উৎপাদন চালু রাখতে হবে। রাজ্য সরকার যখনই প্রয়োজন হবে তখন জুট কমিশনারের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করবে।”

মন্ত্রী আরও জানান, “এই মরসুমে পাটের সন্তোষজনক উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও চটের বস্তা চাহিদা অনুযায়ী সরবারহ করতে না পারলে, প্যাকেজিং আইনের উদ্দেশ্য বিফল হবে। অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যশস্যে প্যাকেজিংয়ে সিন্থেটিক ব্যবহার হবে”। তিনি আরও বলেন যে “পাট শিল্পে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে বিশেষ করে স্পিনিং এবং তাঁত বিভাগে দক্ষ শ্রমিকের অভাব, মজুরি কাঠামো না থাকা, স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা ইত্যাদি। তিনি মিটিংয়ে উপস্থিত সবাইকে অবহিত করে বলেন, কাঁচাপাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং খাদ্যশস্য প্যাকেজিংয়ে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে সিন্থেটিক ব্যাগ ব্যবহারের বিষয়টি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে তিনি এনেছেন। মজুরি সংশোধন, শ্রমিকদের বিভাগীয় করা, ‘গ্রেড-অ্যান্ড-স্কেল’ চালু করা, উন্নত জীবনযাত্রার লক্ষ্যে বাসস্থান প্রদান এবং স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলি সরকারের প্রাথমিকতায় আছে।”

এখন কেন্দ্রীয় সরকার পাটের দড় কুইন্টাল প্রতি ৬,৫০০ টাকা করেছে, মিল মালিকদের বক্তব্য বাজারে ৭,৫০০ টাকা দড়ে পাট বিক্রি হচ্ছে, এতো দামে পাট কিনে মিল চালানো সম্ভব না। এদিকে শ্রমিকদের মজুরির কোনও স্থিরতা নেই। শ্রমিকদের বর্তমান মজুরিকাঠামো মোটামুটি এই রকম। ২০০২ সালে যে শ্রমিকরা নিযুক্ত হয়েছেন তারা ২০ বছর কাজ করে হাতে পান দৈনিক মাত্র ৪৩৭ টাকা। ২০১৯ সালে যারা ভর্তি হয়েছেন তারা দৈনিক পাচ্ছেন ৩৮১ টাকা মাত্র। প্রতিটি শ্রমিককে মজুরির উপর ৪২ শতাংশ টাকা সামাজিক সুরক্ষা বাবদ মিল মালিকের দেওয়ার কথা। কিন্তু মিল মালিকরা এই টাকার বড় অংশই আত্মসাৎ করছে। দুর্ভাগ্যবশত চটশিল্পই একমাত্র শিল্প, যেখানে সাত-আট রকমের মজুরি চালু আছে। রাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল — চটশিল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করবে এবং শ্রমিকদের জন্য ‘গ্রেড-অ্যান্ড-স্কেল’ চালু করবে। সেসব অথৈ জলে। চটকলে মানা হয় না কোনও শ্রম আইন। এই শিল্পের বাজার নিশ্চিত, উৎপাদিত মালের পুরোটাই কেন্দ্রীয় সরকার কিনে নেয়। কিন্তু মালিকরা বস্তার চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না, কেন? অপদার্থ রাজ্য সরকার সব জেনেশুনেও অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। নাকের ডগায় বেআইনি কাজ চালাচ্ছে ফড়ে-ফাটকাবাজ মালিকরা। এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস প্রশাসন বা শ্রমদপ্তরের নেই।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ৫৬টি জুটমিল আছে। এই মিলগুলোতে নথিভুক্ত শ্রমিক সংখ্যা ১৫-২০ শতাংশ মতো হবে। নথিভুক্ত শ্রমিকরা মূল (বেসিক) ও ডিএ’র উপর ৪২ শতাংশ অন্যান্য বিধিবদ্ধ সুবিধাগুলো (ফ্রীঞ্জ বেনিফিট) পাওয়ার কথা। যেমন রাতের কাজের ভাতা ১.৬ শতাংশ, ছুটির ভাতা ৩.৩ শতাংশ, বিধিবদ্ধ ছুটি ৫ শতাংশ, ঘরভাড়া ৫ শতাংশ, পিএফ ১০ শতাংশ, ডিএলআই ০.৬৯ শতাংশ, ইএসআই ৩.২৫ শতাংশ, গ্রাচ্যুইটি ৪.৮ শতাংশ, বোনাস ৮.৩ শতাংশ। নথিভুক্ত শ্রমিকরা এই টাকাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। ইএসআই’এর টাকা ঠিক সময়মতো জমা না পড়ার জন্যে শ্রমিকরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হছেন। পিএফ তহবিলে সময়মত টাকা জমা পড়ছে না। এই টাকা ঠিক সময়ে জমা হলে শ্রমিকরা পেতে পারতেন নিশ্চিত সুদ — অবসর নেওয়ার পর পেতেন পেনশন যা তাদের বিরাট সহায় হোত। কর্মীদের কোম্পানির খাতায় নাম, নাম্বার থাকলে পিএফ-ইএসআই’এর পাশাপাশি অন্যান্য আইনি সুযোগগুলোও পেতে পারতেন। মালিকরা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে শুধু মুনাফাই লুটছে। এখন একজন রাজমিস্ত্রী যখন দৈনিক ন্যূনতম মজুরি পান ৬০০ টাকা, তখন চটকলে এতো কম মজুরিতে কেন বেকাররা জুটমিলে ঢুকবে? মিল মালিকরা যদি সত্যিই মিল চালাতে ও নতুন শ্রমিক নিয়োগ করতে চান তাহলে শিল্প আইন মোতাবেক মিল চালাতে হবে। শ্রমনিবিড় সংগঠিত শিল্প হিসাবে কর্মসংস্থানের এতোবড় ক্ষেত্রটি মালিকদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লালসা, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ঔদাসিন্য ও মালিকদের বেআইনি কাজের পরিণামে চটশিল্প আজ চরম অবহেলিত। সরকারি বিজ্ঞাপন অনুযায়ী এই শিল্পে ১,০০,০০০ কর্ম সংস্থানের সুযোগ আছে। এখনই যদি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ব্যবস্থা না নেয় তাহলে কর্মীর অভাবেই একদিন বাংলার চটশিল্প উঠে যাবে।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত

Hindutva terrorists

উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে পেরিয়ে যাওয়া বছরটার ১৭-১৯ ডিসেম্বর সংগঠিত হল ধর্ম সংসদ। এর আয়োজক ছিলেন উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের ডসনা দেবী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত যতি নরসিংহানন্দ সরস্বতী। আয়োজক নরসিংহানন্দ হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে মুসলিমদের গণহত্যার আহ্বান জানালেন। হিন্দুদের আজ প্রভাকরণ, ভিন্দ্রানওয়ালের মতো অস্ত্রধারীদের প্রয়োজন বলেও তিনি ঘোষণা করেন। আরএসএস’এর শাখা সংগঠন হিন্দু মহাসভার নেত্রী অন্নপূর্ণা মা বলেন, “আমরা ১০০ সেনা চাই জেতার জন্য, যারা ওদের ২০ লক্ষ জনকে মারবে”। তাঁর অভিমতে ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ভারতের সংবিধান ভুল এবং গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেই হিন্দুদের আদর্শ। বিহার থেকে আসা ধর্মগুরু ধর্মদাস জানালেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে হত্যার তাঁর অভিলাষের কথা, কেননা, মনমোহন সিং নাকি সংসদে রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলেছিলেন। ধর্ম সংসদে আর এক ব্যক্তিত্ব, হিন্দুরক্ষা সেনার প্রবোধানন্দ গিরির সহিংস আহ্বান ছিল এই রকম, “মায়ানমারের মতো আমাদের পুলিশ, সেনা, রাজনীতিবিদ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। এবার ‘সাফাই অভিযান’ চালাতে হবে।”

একই ধরনের ঘটনা ১৯ ডিসেম্বর ঘটল জাতীয় রাজধানী দিল্লীর গোবিন্দপুরি এলাকায়। দু’দশক আগে যোগী আদিত্যনাথ প্রতিষ্ঠিত হিন্দু যুব বাহিনী নামক সংগঠনের ডাকা সভায় বেশকিছু হিন্দু যুবককে শপথ বাক্য পাঠ করালেন সুদর্শন নিউজ চ্যানেলের সম্পাদক সুরেশ চাভাঙ্ক। সেই শপথটা ছিল — “ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে হলে লড়ো, মরো এবং দরকার হলে মারো”। নাৎসিরা যেভাবে স্যালুট জানাত, সেই ঢঙে ডান হাত সামনে বাড়িয়ে ‘শপথ’ আওড়ালেন হিন্দু যুবরা। এই শপথ আরো কয়েকটি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়, এবং উদ্যোগগুলোর পিছনে যে একটা পরিকল্পনা কাজ করছে তা প্রতিভাত হয়।

ছত্তিশগড়ের রায়পুরেও সংগঠিত হয় ধর্ম সংসদ। সেখানে ধর্মগুরু কালীচরণ মহারাজ ওরফে অভিজিৎ সরগ নাথুরাম গডসের কাজকে দেশপ্রেমের নিদর্শন বলে অভিহিত করলেন। তিনি বললেন, গান্ধীর জন্যই ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হতে পারেনি। কংগ্রেসের কয়েকজন নেতা ধর্ম সংসদে যোগ দিলেও গান্ধী বিরোধিতা ও গডসে বন্দনায় অস্বস্তি বোধ করে সংসদ ছেড়ে চলে যান। এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভূপেন বাঘেল সরকার কালীচরণ মহারাজের বিরুদ্ধে এফআইআর করে এবং গোপন স্থান থেকে তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হয় ৩০ ডিসেম্বর।

একটা কথা এখানে স্পষ্টভাবে বলাটা জরুরি। যারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে মুসলিমদের গণহত্যার কথা বলে, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলতে তৎপর হয়, গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে আদর্শ বলে জ্ঞান করে, তারা নির্ভেজাল সন্ত্রাসবাদী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

তবে, হিন্দুত্বর এই সংখ্যালঘু বিরোধী আস্ফালনের বিরুদ্ধে নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজ নিশ্চুপ থাকেনি। বিভিন্ন রাজ্যের নানা স্থানে মুসলিম বিদ্বেষী উন্মাদনাকে বন্ধ করা এবং হিন্দুত্ববাদকে প্রতিহত করার সক্রিয়তা দেখা যায়। সুপ্রিম কোর্টের ৭৬ জন আইনজীবী, প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণাকে চিঠি দিয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই উগ্ৰতাকে অপরাধ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, ধর্ম সংসদে সাধু-সাধ্বীরা যা বলেছেন তা শুধু ঘৃণা-ভাষণই নয়, মন্তব্যগুলো একটা গোটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার কথাই বলে। প্রধান বিচারপতির কাছে তাঁদের তাই বিনীত নিবেদন, “রেওয়াজ হয়ে ওঠা ঘটনাগুলোকে প্রতিহত করতে জরুরী বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন”। পাঁচ প্রাক্তন সেনাপ্রধান (নৌসেনা প্রধান এল রামদাস, বিষ্ণু ভগত, অরুণ প্রকাশ ও আর কে ধাওয়ান এবং প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান এস পি ত্যাগি) রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছেন, যে চিঠির প্রতিলিপি তাঁরা প্রধান বিচারপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের কাছে পাঠিয়েছেন। তাঁদের চিঠিতে বলা হয়েছে, “মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই ধরনের প্রচেষ্টাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার নিবেদন আমরা জানাচ্ছি, এবং হিংসার এই উস্কানিকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ধিক্কার জানানোর আবেদন করছি”। প্রাক্তন এক লেফটেন্যান্ট জেনারেলও তাঁর প্রতিবাদপত্রে বলেছেন, “ঘৃণার এই কারবারিরা ধর্মান্ধ এবং দেশের সামাজিক কাঠামোর কাছে এক বিপদ। সরকার কেন তাদের গ্ৰেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ এবং দেশদ্রোহী আইন প্রয়োগ করছে না?” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন টেনিস তারকা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাও হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম-বিরোধী হিংসার উস্কানির নিন্দা করেছেন বলেও খবর বেরিয়েছে।

Hindutva terrorists are being pampered

রাজনৈতিক ময়দানে সিপিআই(এমএল) প্রতিবাদে সক্রিয় থেকেছে। দিল্লীতে নাগরিকদের সংগঠিত প্রতিবাদে সিপিআই(এমএল), এআইএসএ এবং এআইসিসিটিইউ অংশ নেয়। ঐ প্রতিবাদসভা থেকে দাবি ওঠে — যতি নরসিংহানন্দ, অন্নপূর্ণা মা এবং ধর্ম সংসদে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা অন্যান্য ঘৃণা প্রচারকদের গ্ৰেপ্তার করতে হবে। সেদিনের প্রতিবাদ সভায় সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, দেশে বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজেপি সমর্থিত এই চরম দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিগণ ও সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িক তাস খেলছে। উত্তরাখণ্ডে ঘৃণা-ভাষণগুলোতে মুসলিমদের গণহত্যার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তারসঙ্গে নাজি জার্মানির ‘চূড়ান্ত সমাধান’এর মিল আছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, সামনের নির্বাচনগুলোতে এই ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলোকে পরাস্ত করতে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের যে স্বপ্ন স্বাধীনতা আন্দোলন তুলে ধরেছিল, সেই ঐতিহ্যকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত হওয়ার রাজ্য উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন স্থানেও সিপিআই(এমএল) প্রতিবাদ সংগঠিত করে। সংগঠনের গাড়োয়াল শাখা ঘৃণা প্রচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে রাজ্যের ডিজিপি’কে একটা স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে গাড়োয়াল শাখার সম্পাদক ইন্দ্রেশ মইখুরি বলেছেন, ঘৃণা-ভাষণগুলোতে হিংসাকে উস্কিয়ে তোলা, অস্ত্র সংগ্রহ করা এবং গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের আইন ও শৃঙ্খলাকে এইভাবে দূষিত করে তুলতে কাউকেই দেওয়া যাবে না। বিন্দূখাট্টার লালকুঁয়াতে প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত হয় যা শেষে একটা জনসভায় পরিণতি লাভ করে। সেই সভায় দলের উত্তরাখণ্ড রাজ্য সম্পাদক রাজা বহুগুণা বলেন, ভারত গণতান্ত্রিক দেশ, সমাজকে সংবিধান মেনে পরিচালিত হতে হবে, ধর্মীয় হুমকির কোনো স্থান এখানে হতে পারে না। পাঁচটা রাজ্যে নির্বাচনের আগে জনগণ ধর্মের এই হুমকিবাজিকে মেনে নেবেন না। তিনি অভিযোগ করেন, উগ্ৰ ধর্মান্ধরা উত্তরাখণ্ড সরকারের সুরক্ষা পাচ্ছে, আর তাই এর দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে।

Hindutva terrorists are being pampered - bihar

বিহারের পাটনায় সিপিআই(এমএল) ও এআইপিএফ ২৭ ডিসেম্বর প্রতিবাদ সংগঠিত করে। প্রতিবাদ সভাগুলোতে বক্তারা বলেন, গান্ধীর দেশে গডসের মাহাত্ম্যের প্রচার কাজে দেবে না। দেশের জনগণ ঘৃণার এই প্রচারকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করবেন। সারা ভারত কিষাণ মহাসভার সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং বলেন, মুসলিম বিরোধী ঘৃণার এই প্রচারের পিছনে রয়েছে বিজেপি ও আরএসএস। জাতি-বিরোধী শক্তিগুলো সংবিধানকে প্রহসনে পরিণত করছে এবং দেশের মিশ্র সংস্কৃতি ও ঐক্যের বিপর্যয় ঘটালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা। পাটনা ছাড়াও প্রতিবাদ সংগঠিত হয় বেগুসরাই, আরা, বেতাইয়া, ডুমরাঁও ও অন্যান্য জেলায়। এই সমস্ত প্রতিবাদ অনুষ্ঠান থেকে কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা যতি নরসিংহানন্দ, প্রবোধানন্দ ও অন্যান্যদের গ্ৰেপ্তারের দাবি ওঠে। যারা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলছে তারা যোগ্য জবাব পাবে বলেও বক্তারা জানান।

এআইপিএফ’এর বক্তারা ভারতের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে অটুট রাখা এবং ধর্মের নামে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দুরভিসন্ধিকে ব্যর্থ করার অঙ্গীকার করেন।

ঘটনাবলীর বিকাশ ক্রমান্বয়ে দেখিয়ে চলেছে যে, ন্যায়-অন্যায়ের সিদ্ধান্তে নরেন্দ্র মোদী সরকার চূড়ান্ত রূপেই একদেশদর্শী। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের তারা বিনাবিচারে বছরের পর বছর জেলে আটক রাখে, আর ঘৃণা-ভাষণের মহা আয়োজন থেকে মুসলিমদের গণহত্যার ডাক দেওয়া হলেও পুলিশ-প্রশাসনের কোনো হেলদোল দেখা যায়না। ঘটনার কয়েকদিন পর মূল অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশ চিহ্নিত করে ধর্ম সংসদের সংগঠনে গুরুত্বহীন এক ব্যক্তি ওয়াসিম রিজভি ওরফে জিতেন্দ্র নারায়ণ ত্যাগীকে। এই রিজভি গতবছরের ৮ ডিসেম্বর মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্ৰহণ করেন এবং আরো জানা যায়, সিয়া ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকার সময় আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই’এর তদন্ত চলছে। ধর্ম সংসদের মূল হোতা এবং মুসলিম গণহত্যার আহ্বানের পয়লা নম্বরের পাণ্ডা নরসিংহানন্দের অপরাধে পুলিশ হাত গুটিয়ে থাকে। ঘটনার দু’সপ্তাহ পর আর কয়েকজনের সঙ্গে পুলিশ তাঁর নামে অভিযোগ দায়ের করলেও এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্ৰেপ্তার করা হয়নি। নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার ওজর হিসাবে উত্তরাখণ্ডের ডিজি বলেন — ঘটনা নিয়ে কোনো অশান্তি হয়নি, কাউকে তাই গ্ৰেপ্তার করা হয়নি! হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনে “লড়াই কর, মর এবং প্রয়োজন হলে মারো”র শপথ গ্ৰহণ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও অমিত শাহ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লী পুলিশ কোনো পদক্ষেপ করেনা। নরসিংহানন্দ যখন ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত করতে হরিদ্বার আসেন, বা সুদর্শন নিউজ চ্যানেলের প্রধান হিন্দুরাষ্ট্রের বাস্তবায়নে যুবকদের ‘মর ও মারো’র শপথ বাক্য পাঠ করান, তখন তাঁদের এই বোধে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না যে, তাঁদের কাজ প্রশাসনের পরিপূর্ণ সমর্থন পাবে। ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ ঘটানোতেই যাদের যাবতীয় তৎপরতা চালিত হয়, সংখ্যাগুরুবাদই যাদের চালিকা নীতি, সংখ্যালঘু গণহত্যার ডাক তাদের যে একটুও বিচলিত করবেনা, অনুষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তারা সেকথা খুব ভালো করেই জানতেন।

প্রতিবেদনের শেষে একটা প্রশ্ন — নরসিংহানন্দ সরস্বতী জানিয়েছেন, তিনি ২২-২৩ জানুয়ারি আলিগড়ে আর একটা ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত করবেন। প্রশাসন কি হাত গুটিয়ে থেকে সেই আয়োজনে সবুজ সংকেত দেবে? ভালো সংখ্যক মুসলিম বাস করা আলিগড়েও কি মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষকে উস্কিয়ে তোলা হবে? মুসলিম গণহত্যার আওয়াজ আবার ওঠানো হবে?

Posh Act

ভারতবর্ষে মহিলা কর্মীদের বিরুদ্ধে যৌন হিংসার ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনই এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো প্রতি মুহূর্তে তাদের আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা সে সংগঠিত কর্মক্ষেত্র হোক বা অসংগঠিত। যৌন হেনস্থার কোনও ঘটনায় এই সমাজ নিগৃহীতার প্রতি কতটা সংবেদনশীলতা দেখায় তা আমাদের জানা আছে! অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের এগিয়ে এসে হেনস্তার বিরদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এবং নিজের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করা এবং তা আদায় করা এককথায় অসাধ্য বলা যেতে পারে।

আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিকে এক বৃহত্তর সামাজিক ও জাতিগত প্রেক্ষাপটের নিরিখে বোঝার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সার্বিকভাবে গড়ে অভিযোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে প্রায় চারলক্ষ অভিযোগ দায়ের করা হয়। যৌনহেনস্থা এমন একটি অপরাধ যা মূলত একটি কাঠামোর ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের শক্তি ও হিংসা প্রদর্শন, এক্ষেত্রে জাতি ও ধর্মের পিরামিডের আকারে যদি দেখি নির্যাতিতার সংখ্যা বাড়তে থাকবে যত আমরা পিরামিডের নীচের দিকে তাকাবো।

এছাড়াও প্রায় ৯০ শতাংশ মহিলা শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে রয়েছেন, যেখানে তাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, নেই সবেতন ছুটি, নেই কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষা। অর্থাৎ সেক্ষত্রে যৌনহেনস্থার ঘটনায় কোনো কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়া এবং অভিযোগকারিনী বা সমস্ত মহিলা কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে এই সংস্থাগুলি কতটা দুর্বল হতে পারে তা যে কেউ আন্দাজ করতে পারবে।

বিশাখা গাইডলাইন ছিল প্রথম পদক্ষেপ, কর্মক্ষেত্রে চলমান যৌন হিংসার বিরূদ্ধে। ১৯৯২ সালে রাজস্থান রাজ্য সরকারের নারী উন্নয়ন দপ্তরের একজন কর্মী, দলিত সমাজ কর্মী ভানোয়ারী দেবী, এক পরিবারের বাল্যবিবাহে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। রাজ্য সরকারের একজন কর্মী হিসাবে তিনি সেখানে ছিলেন। পরিবারটি ছিল উঁচু জাতির গুর্জ্জর সম্প্রদায়ের। কাজেই এই প্রতিবাদের জবাব নিতে পাঁচজন পুরুষ তাকে গণধর্ষণ করে। এই ঘটনায় ভানোয়ারী দেবী রাজস্থান হাইকোর্ট থেকে কোনো ন্যায়বিচার পাননি এবং অভিযুক্তেরা জামিন পেয়ে যায়। এই ঘটনা সমাজে বিরাট সাড়া জাগায়, বেশকিছু মহিলা সংগঠন এবং এনজিও সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন জমা করে। ভানোয়ারী দেবীর ঘটনার পর মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট, ভার্মা কমিটির বেঞ্চ এই প্রশ্নে ইতিবাচক রায় দেয়। এই গাইডলাইন অনুযায়ী সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি কর্মসংস্থাগুলিকে যৌনহেনস্থা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উদ্দ্যেশ্যে অবশ্যই কিছু নীতি এবং নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করতে হবে। এই নির্দেশিকার গুরুত্ব অনুধাবন করার পর পরবর্তীকালে প্রায় ১৬ বছর পর ২০১৩ সালে ‘দি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস (প্রিভেনশন, প্রহিবিশন অ্যান্ড রিড্রেসাল) অ্যাক্ট’, বা ‘পশ অ্যাক্ট’ হিসাবে গৃহীত হয়।

পশ আইনের অধীনে, যৌন হয়রানিকে নিম্নলিখিত যেকোনো এক বা একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ বা আচরণ দ্বারা (প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে) চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন -

(১) শারীরিক সংযোগ, অথবা
(২) যৌন সুযোগের জন্য দাবি বা অনুরোধ করা, অথবা
(৩) যৌন প্ররোচনামূলক মন্তব্য করা, অথবা
(৪) পর্নোগ্রাফি দেখানো, অথবা
(৫) যৌন প্রকৃতির অন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক, মৌখিক বা অমৌখিক আচরণ।

আইনটি সমস্ত সরকারি, বেসরকারি সংস্থাগুলির পাশাপাশি সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করে।

পশ আইনে দশজনের বেশি কর্মচারী সহ যে কোনও কোম্পানির একটি অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে যার মধ্যে থাকবেন একজন সিনিয়র মহিলা কর্মচারী, কমপক্ষে দুইজন অন্যান্য কর্মচারী এবং যৌন হয়রানির সমস্যাগুলির সাথে পরিচিত একটি বেসরকারি সংস্থার একজন সদস্য। প্রতিটি জেলায় ১০ জনের কম কর্মচারী সংস্থার জন্য এবং গৃহকর্মী, রাস্তার বিক্রেতা, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহস্থালির কর্মী যেমন বুননের সাথে জড়িত, আশা কর্মীসহ সমস্ত অসংগঠিত কর্মীদের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি স্থানীয় অভিযোগ কমিটি গঠন করা উচিত।

তাহলে এইবার দেখা যাক পশ অ্যাক্ট লাগু হওয়ার পর কী ধরনের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করতে পারছি।

Posh Act: How much has been used

২০১৩ ও ২০১৪-তে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয় কর্মক্ষেত্রে মহিলা পুলিশ কর্মীদের পরিস্থিতি (যৌন হয়রানির ঘটনাও এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত) পরীক্ষা করার জন্য, কিন্ত তাসত্ত্বেও এই বিষয়ে সেরকম তথ্য মেলেনা। এই কমিটির ২০১৩’র রিপোর্ট থেকে জানা যায় — মহিলা পুলিশ কর্মীদের যৌনহেনস্থার অভিযোগগুলির সমাধান হয়েছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয় সরকারের কাছে। সরকার থেকে জানানো হয় যৌনহেনস্থার অভিযোগগুলিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হলেও এবিষয়ে তথ্য তাদের কাছে নেই এবং সাথে তারা স্বীকার করে যে তারা এই ধরনের পরিকাঠামো ঠিকমত বানিয়ে উঠতে পারেনি।

২০১৫ সালে, ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ (এফআইসিসিআই) এবং কনসালটেন্সি ‘আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং’এর এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ৩১ শতাংশ কোম্পানি এই পশ আইনকে মানতে নারাজ, ৩৫ শতাংশ সচেতন ছিল না শাস্তি বা জরিমানা সম্পর্কে এবং প্রায় ৪০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ কমিটির সদস্যদের কোনো ট্রেনিং দেওয়াই হয়নি। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ নামক নিউ ইয়র্কের একটি এনজিও ২০২০ সালে একটি রিপোর্টে প্রকাশ করে যে ভারতবর্ষে মহিলা শ্রমিকদের যৌন হয়রানির ঘটনায় প্রতিকার পাওয়ার প্রক্রিয়া কতটা দুর্বল এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্থাগুলি মহিলার প্রতি তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। এই এনজিও’টি সরকারকে সুপারিশ করে যে প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এবং কতগুলি ঘটনা স্থানীয় জেলা কমিটি দ্বারা সমাধান হয়েছে, সমস্ত কিছুর তথ্য প্রকাশ করা উচিত এবং গোটা দেশজুড়ে একটি অডিট করা যেখানে এই কমিটিগুলির কার্যকারিতা আরও স্পষ্ট হবে।

২০১৮-তে যখন সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘মি-টু’ আন্দোলনের ঝড় উঠেছে, সেই সময় বিভিন্ন তারকা ও বিখাত ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা নিয়ে প্রকাশ্যে বলতে দেখা যায়। প্রিয়া রামানি, এক জার্নালিস্ট প্রাক্তন ইউনিয়ন মন্ত্রী এম জে আকবরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। তার কর্মজীবনের একদম গোড়াতে যে সময় এম জে আকবর ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক, ইন্টারভিউয়ের অছিলায় একটি হোটেলে নিজের রুমে ডেকে পাঠান এবং অনভিপ্রেত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন।

এই ঘটনা বাইরে আসায়, এম জে আকবর মানহানির মামালা করেন রামানির বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে এই মামলার এক দৃষ্টান্তমূলক রায় আসে। বলা হয় “সমাজের খ্যতিমান ব্যক্তিও একজন যৌন হেনস্থাকারী হতে পারে” এবং “যৌন হেনস্থা ব্যক্তির আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাসকে ভেঙ্গে দেয়। তাই খ্যাতিরক্ষার স্বার্থে কারো আত্মসম্মানের বিসর্জন দেওয়া যায়না।” আদালতে, মিঃ আকবরের আইনজীবীরা প্রশ্ন করেছিলেন যে মিসেস রামানি কেন ১৯৯৩ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে আগে অভিযোগ করেননি, কিন্তু বিচারক রায় দেন “একজন মহিলার কয়েক দশক পরেও অভিযোগ উত্থাপন করার অধিকার আছে”।

- সুমন ঘোষ

== সমাপ্ত ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-1